করোনায় ফুসফুসে বিপজ্জনক সংক্রমণ

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১ অক্টোবর, ২০২০ at ৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ

করোনার লক্ষণ দেখা দিলে গত ২০ আগস্ট নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ৬০ বছর বয়সী আশিষ কুমার বড়ুয়াকে। পরে নমুনা পরীক্ষায় তাঁর শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। আশীষ বিভিন্ন সামাজিকসাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। করোনা শনাক্তের পর সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষায় তাঁর ফুসফুস আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত হন চিকিৎসকরা। যার কারণে পরবর্তী নমুনা পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ হলেও হাসপাতাল ছাড়তে পারেননি আশীষ। ঠাঁই হয় হাসপাতালের আইসিইউতে। সর্বশেষ গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাত সোয়া ৮টার দিকে আইসিইউতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘ ১ মাস ১০দিনে হাসপাতালের বিল বাবদ আশীষের পরিবারকে পরিশোধ করতে হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তাঁর বড় ভাই ডা. কল্যাণ বড়ুয়া জানান, প্রথম পর্যায়েই আশিষের ফুসফুসের প্রায় ৮০ ভাগ অকেজো হয়ে যায়। সেখান থেকে আর রিকভার করা সম্ভব হয়নি। আগে থেকেই তাঁর অ্যাজমার জটিলতা ছিল।

আগে থেকে অ্যাজমা, এলার্জি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্ত চাপসহ বিভিন্ন জটিলতা থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে করোনায় আক্রান্ত হলে ঝুঁকিটা খুব বেশি বলে জানান এই চিকিৎসক। রাজধানীর নাম করা একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ২১ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান ৫০ বছর বয়সী রনজিত কুমার সাহা। তিনি সীতাকুন্ডের কুমিরা গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক। ইনফেকশনের (সংক্রমণের) কারণে ফুসফুস অকেজো হয়ে পড়ায় তাঁকেও আর বাঁচানো যায়নি। তবে মৃত্যুর পর হাসপাতালের বিল বাবদ তাঁর পরিবারের খরচ হয় প্রায় ২১ লাখ টাকা।

একইভাবে দীর্ঘ প্রায় ২ মাস হাসপাতালে কাটিয়ে সোমবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বান্দরবানের মনোরঞ্জন বড়ুয়া। তিনি পল্লী চিকিৎসক ছিলেন। লক্ষণ দেখা দিলেও কয়েক দফা নমুনা পরীক্ষায় তাঁর শরীরে করোনা ধরা পড়েনি। তবে আগে থেকেই অন্যান্য জটিলতা থাকায় দিনদিন শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে প্রথমে বান্দরবান সদর হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের বেসরকারি একটি হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন ১৮ দিন। সেখান থেকে রোগীকে অন্য একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। এভাবে চট্টগ্রামের বেসরকারি তিনটি হাসপাতালে প্রায় দুই মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর গত সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ওই রোগী। আর এ সময়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা বাবদ বিল আসে ২০ লাখ টাকারও বেশি। ফুসফুস প্রায় শতভাগ অকেজো হয়ে যাওয়ায় রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি বলে জানান মেট্রোপলিটন হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা. কাউসার আলম।

শুধু এই কয়জন নয়, করোনা ধরা পড়ুক আর না পড়ুক ফুসফুসে সংক্রমণের (ইনফেকশন) কারণে শুধু চট্টগ্রামেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী মারা গেছেন। তবে মৃত্যুর আগেপরে নিঃস্ব করে যাচ্ছেন পরিবারকেও। এর মধ্যে অনেক পরিবারে সামর্থ্য থাকলেও বেশির ভাগ পরিবার বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ’র বিল বহনে অক্ষম। এরপরও বাঁচানোর আশায় সহায়সম্বল বিক্রি করে হলেও রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসছেন অধিকাংশ পরিবার। তবে দীর্ঘ সময় আইসিইউতে অঙিজেন সাপোর্টে থাকলেও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেই হচ্ছে এসব রোগীকে। অপরদিকে চিকিৎসা বাবদ বেসরকারি হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হতে হচ্ছে রোগীর পরিবার।

মেট্রোপলিটন হাসপাতালের জিএম মোহাম্মদ সেলিম বলেনদীর্ঘ সময় আইসিইউএইচডিওতে চিকিৎসাধীন থাকার পর বেশির ভাগ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে, হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগীর প্রায় ৩ শতাংশ রোগী এভাবে মারা যাচ্ছেন। তিনি বলেন, মূলত ফুসফুস অকেজো হওয়ার কারণে সেটি আর রিকভার করা সম্ভব হয় না।

চিকিৎসকরা জানানমা ও শিশু হাসপাতালের ডা. রুমি, মেট্রোপলিটন হাসপাতালের ডা. নুরুল হক, চমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সমীরুলসহ চট্টগ্রামের আরো বেশ কয়জন চিকিৎসককে হারাতে হয়েছে ফুসফুসে সংক্রমণের কারণেই। এদের অনেকের শরীরে করোনা শনাক্ত হলেও কারো কারো নমুনা পরীক্ষায় করোনা ধরা পড়েনি। এসব চিকিৎসকদের বাঁচাতে কম চেষ্টা করেননি সহকর্মীরা। কিন্তু সহকর্মীদের আন্তরিক সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁরা ওপারে পাড়ি জমান।

করোনায় ফুসফুসে অ্যাটাক করলেই তা বিপদজনক বলছেন চিকিৎসকরা। ইনফেকশনে ফুসফুস অকেজো করে ফেললে ওই রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশীদ। তাই চেষ্টা করেও নিজেদের অনেক সহকর্মীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি বলেও জানান এ চিকিৎসক।

কঙবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. অনুপম বড়ুয়া বলেনকরোনায় ফুসফুসে সংক্রমণ হলেই তা বিপজ্জনক। তাই ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগসহ অন্যান্য জটিলতা থাকা রোগী ও বয়স্কদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশীর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়ুয়ার আত্মসমর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধজাহালমকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ