করোনার রিপোর্টে বিভ্রান্তি

এক ল্যাবে পজিটিভ তো অন্যটিতে নেগেটিভ

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

কোভিড-১৯ তথা করোনা টেস্টে বিভ্রান্তি বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। টেস্ট রিপোর্টের বিভ্রান্তি বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট আস্থাহীনতাও তৈরি করছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরো বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত বলে মনে করছেন সবাই।
কেস স্টাডি : মোহাম্মদ সাহেদ কোভিড পজেটিভ হয়ে পনের দিন বাসায় চিকিৎসা নিলেন। তেমন কোনো উপসর্গ না ছিল না। পরবর্তীতে নগরীর ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে কোভিড টেস্ট করে তিনি নেগেটিভ রিপোর্ট পান। পজেটিভ রিপোর্টও পেয়েছিলেন ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল থেকে। নেগেটিভ হওয়ার পর তিনি বাসার সবার সাথে মিশেছেন। খাওয়া দাওয়াসহ স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। এর সপ্তাহ খানেক পর বাসার ড্রাইভারসহ কাজের তিন নারী প্রেস ক্লাবের বুথে পরীক্ষা করে নেগেটিভ রিপোর্ট পান। পরবর্তীতে পরিবারের অপর একজনের পজেটিভ রিপোর্ট এলে মোহাম্মদ সাহেদের পরিবার আবারো শংকিত হয়ে ওঠেন। এবার নমুনা দেয়া হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। সেখান থেকে একদিন পরই মোহাম্মদ সাহেদ এবং অপর চারজনকে পজেটিভ রিপোর্ট দেয়া হয়। বিষয়টি দারুণ খটকার সৃষ্টি করে।
মোহাম্মদ এমরানের অবস্থাও একই। ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল থেকে পজেটিভ এবং নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়ার এক সপ্তাহেরও আগে জেনারেল হাসপাতালের রিপোর্টে পজেটিভ হন। আবারও খটকা।
উপায়ন্তর না দেখে পরদিন নমুনা দেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে। একদিন আগে জেনারেল হাসপাতাল থেকে পজেটিভ রিপোর্ট দেয়া সেই মোহাম্মদ সাহেদ এবং এমরান গতকাল নেগেটিভ হয়েছেন মা ও শিশু হাসপাতালের টেস্টে।
শুধু উপরোক্ত দুজনই নন, অসংখ্য মানুষ কোভিড টেস্টের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
সরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করে এক ধরনের রিপোর্ট আসছে, বেসরকারি ল্যাবে অনেক ক্ষেত্রেই সেই রিপোর্ট পাল্টে যাচ্ছে। এক দুই দিনের ব্যবধানে সরকারি বেসরকারি ল্যাবে করা এই ধরনের বেশ কিছু রিপোর্ট দৈনিক আজাদীর হস্তগত হয়েছে।
পজেটিভ থেকে নেগেটিভ হওয়ার দিন কয়েকের মধ্যে সরকারি ল্যাবে দ্বিতীয়বার পজেটিভ হওয়া এবং একদিনের মাথায় বেসরকারি ল্যাবে নেগেটিভ হওয়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মোহাম্মদ সাহেদ বলেন, মানসিক একটা বড় ধকল গেল। টাকা পয়সা গেল। হয়রানিও হলাম। এত সিরিয়াস একটি বিষয় এমন হওয়া উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভুল পজেটিভ নিয়ে আমি ঘরে ছিলাম। কিন্তু ভুল নেগেটিভ তো সাংঘাতিক। একজন করোনা পজেটিভ মানুষ যদি নেগেটিভ রিপোর্ট পান তাহলে তিনি শুধু তার পরিবারই নয়, ধারে কাছের সবার জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন। দেশে কোভিডের ব্যাপক বিস্তারে এই ধরনের ভুল রিপোর্ট ভূমিকা রাখছে।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড টেস্ট ব্যয় বহুল একটি পরীক্ষা হলেও সরকার নামমাত্র মূল্যে এটির পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। পাশাপাশি বেসরকারি ল্যাবগুলোতে সাড়ে তিন হাজার টাকায় কোভিড পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোভিড পরীক্ষা একটি নতুন বিষয়। পিসিআর টেস্টে ইরোর বা ফলস রিপোর্ট হতে পারে। এটি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হওয়ার আশংকা থাকে। এই ফলস রিপোর্টই করোনার বিস্তার ঘটাচ্ছে।
রিপোর্টের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার উপর জোর দিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, এই রিপার্টের উপরই একজন রোগীর চিকিৎসা থেকে শুরু করে সবকিছু নির্ভর করে। এটি মিথ্যা হলে যে কোনো মানুষ শারিরীকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডাক্তার শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, এটা হতে পারে। ৩০ শতাংশ ফলস নেগেটিভ হওয়ার একটি কথা কিন্তু বলা আছে। এর বাইরেও স্যাম্পল কী ভাবে কালেকশন করা হলো, কিভাবে স্লাইড তৈরি হলো তার উপরও রিপোর্টের অনেক কিছু নির্ভর করে। স্যাম্পল কালেকশন থেকে পরীক্ষা সম্পন্ন করা পর্যন্ত নিয়োজিত মানুষের দক্ষতা এক্ষেত্রে একটি বড় বিষয় বলেও সিভিল সার্জন ডাক্তার শেখ ফজলে রাব্বি উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ বলেন, অনেক সময় কোভিড স্যাম্পল নিতে সমস্যা হলেও নেগেটিভ আসতে পারে। তবে নেগেটিভ আসলেও রোগীর যদি লক্ষণ থাকে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসক চেস্ট-এঙরেতে নিউমোনিয়া কিংবা কনসোলিডেশনের কোনো ফিচার আছে কিনা সেটি দেখেন। এছাড়া অঙিজেনের স্যাচুরেশন কমে গেলে তখন সিটি স্ক্যান (এইচআরসিটি-চেস্ট) করে ফুসফুসের অবস্থা দেখে পরবর্তী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ দৈনিক আজাদীকে বলেন, কোভিড যখন শুরু হয়, তখন থেকেই বলা হচ্ছে ৩০ শতাংশ টেস্ট রিপোর্ট ‘ফলস নেগেটিভ’ হতে পারে। ফলস নেগেটিভ হলেও রোগীর যদি লক্ষণ থাকে, তাহলে তাকে সবার কাছ থেকে আলাদা থাকতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে। অনেকের কেবল জ্বর থাকতে পারে, আবার সর্দি, শরীর ব্যথা এবং অস্বাভাবিক দুর্বল লাগাটাও কোভিডের লক্ষণ হতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমাদের দেশের অনেক লোক শুধুমাত্র সর্র্দি, জ্বর কিংবা কাশি নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকের উপসর্গ তেমন থাকে না, আবার কারো কারো কিছু কিছু উপসর্গ থাকে। তাই আমরা সবাইকে বাসা থেকে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরার পরামর্শ দিচ্ছি। মাস্ক পরলে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা ১ শতাংশের নিচে নেমে আসে। কোভিড একটি নতুন রোগ। এটির রূপ পরিবর্তনের বিষয়টি কারো অজানা নয়। সুতরাং মানুষকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। কারো টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ আসলেও যদি জ্বর, সর্দি, কাশি কিংবা শরীর ব্যথার মতো কিছু কিছু লক্ষণ থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই আইসোলেশনে থাকতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগী ভিতরে ভিতরে জ্বর অনুভব করেন, কিন্তু জ্বর মাপলে পাওয়া যায় না, এটিও কোভিডের লক্ষণ হতে পারে। যেহেতু এখন মহামারী চলছে, তাই অবশ্যই প্রত্যেক ক্ষেত্রে কোভিড সন্দেহ করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাড়ছে পরিবারভিত্তিক সংক্রমণ
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় গর্তে পড়ে হাতি শাবকের মৃত্যু