করোনার বাধা পেরিয়ে এগিয়ে আসছে স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা

বিশ্ব রক্তদাতা দিবস আজ

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৪ জুন, ২০২২ at ৭:১৭ পূর্বাহ্ণ

করোনা সংক্রমণের প্রথম বছর (২০২০ সালে) স্বেচ্ছায় রক্তদান কমে যায়। এ ধারা অব্যাহত থাকে ২০২১ সালেও। যদিও রক্তের চাহিদা কমেনি। তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় চলতি বছরে (২০২২ সালে) রক্তদান ফের স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। করোনার বাধা পেরিয়ে এগিয়ে আসছেন স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা।

স্বেচ্ছায় রক্তদান নিয়ে কাজ করে রক্তদাতাদের সংগঠন সন্ধানী। সংগঠনটির চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) শাখার তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে শুধু সন্ধানীর মাধ্যমেই ৪ হাজার ১৩ জন মানুষ স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন চট্টগ্রামে। কিন্তু করোনা সংক্রমণের প্রথম বছর (২০২০ সালে) রক্তদাতার এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৯ জনে। যা আগের বছরের তুলনায় অন্তত এক হাজার কম। রক্তদানে নিম্মমুখী ধারা অব্যাহত থাকে ২০২১ সালেও। গতবছর সবমিলিয়ে আড়াই হাজারের কিছু বেশি রক্তদাতা স্বেচ্ছায় রক্ত দান করেছেন। হিসেবে আগের দুবছরের তুলনায় আরো কম সংখ্যক রক্তদাতা স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন ২০২১ সালে (গত বছর)। অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় করোনা পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছায় রক্তদান অনেকটা কমে যায়। যদিও চলতি বছরে স্বেচ্ছায় রক্তদান ফের বাড়তে শুরু করেছে। চলতি বছরের (২০২২ সালের) প্রথম ৫ মাসে দেড় হাজারের বেশি রক্তদাতা স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন বলে সন্ধানী সূত্রে জানা গেছে।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় রক্তদাতারা ফের এগিয়ে আসছেন জানিয়ে সন্ধানী চমেক শাখার সভাপতি আমজাদ হোসেন এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক উপমা ধর বলেন, করোনার কারণে দুবছর রক্তদানে প্রভাব পড়ে। রক্তদান অনেকটা কমে যায়। তবে চলতি বছর পরিস্থিতি বদলেছে। এখন রক্তদাতার সংখ্যা বাড়ছে। এতে করে গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর (২০২২ সালে) রক্তদানের সংখ্যা অনেকটা বাড়বে বলে আমরা আশা করছি।

রক্তদানের সংখ্যা বর্তমানে আবার বেড়েছে জানিয়ে চমেক হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাকালীন রক্তদানের সংখ্যা অনেকটা কমে যায়। তবে বর্তমানে রক্তদান আবার বেড়েছে। ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে এখন প্রতি মাসে ৫ হাজারেরও বেশি ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ হয়। হিসেবে দিনে দুইশর বেশি রক্তদাতা এখানে রক্তদান করে থাকেন।

সীতাকুণ্ডের ঘটনায় রক্তদাতাদের চাপ সামলাতে হিমশিম : গত ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আহতদের রক্ত দানে মধ্যরাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে জড়ো হতে শুরু করে কয়েকশ তরুণ। ভোর রাত পর্যন্ত রক্ত দিতে আসা তরুণের সংখ্যা প্রায় হাজার ছাড়িয়ে যায়। যদিও আহত খুব বেশি জনের রক্ত লাগেনি।

চমেক হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে দায়িত্বরত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এসএম বশির উদ্দিন ও মোখলেছুর রহমান জানান, সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের রক্তদানে শয়ে শয়ে তরুণ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের সামনে ভিড় করে। তবে আগ্রহী রক্তদাতাদের কাছ থেকে (চারটি নেগেটিভ গ্রুপের) দশ ব্যাগ করে রক্ত সংগ্রহ করে রাখেন তারা। যদি প্রয়োজন হয়, সে বিবেচনায় ‘ও, , বি এবং এবি’ নেগেটিভ রক্তগুলো তারা সংগ্রহ করে রাখেন। সবমিলিয়ে চার গ্রুপের ৪০ ব্যাগ নেগেটিভ রক্ত সংগ্রহ করে রাখা হয়। তবে আগে থেকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় পজিটিভ গ্রুপের রক্ত সংগ্রহ করতে হয়নি বলে জানান তারা।

ব্লাড ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণে আহতদের মাঝে এ পর্যন্ত পজিটিভ গ্রুপের অর্ধ শতাধিক ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করা হয়েছে। তবে নেগেটিভ কোনো রক্তই রোগীকে সরবরাহ করতে হয়নি। ওই সময় (৪ জুন রাতে) স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল বলে জানান ব্লাড ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।

সীতাকুণ্ডের ওই ঘটনায় সবমিলিয়ে ৬০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে সন্ধানী। এর মাঝে নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত সংগ্রহ হয় ১২ ব্যাগ। তবে সংগৃহীত রক্তের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩০ ব্যাগের মতো আহত রোগীদের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানান সন্ধানীর যুগ্ন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নওশীন জান্নাত। যদিও নেগেটিভ গ্রুপের কোনো রক্ত সরবরাহের প্রয়োজন পড়েনি বলেও জানান নওশীন।

যেভাবে চলছে রক্তদান : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজ খুলে রক্তদান কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা। সিটিজি ব্লাড ব্যাংক, ব্লাড ডোনার সোসাইটি, ব্লাড ডোনেটিং ক্লাব, লামা ব্লাড ব্যাংক, ফটিকছড়ি ব্লাড ডোনার সোসাইটিসহ আরো অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে আগ্রহী রক্তদাতাদের নিয়ে। শুরুতে ১২ জন নিয়ে গড়ে তোলা সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২১০ জন। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ইমরান ইমু। তিনিসহ আরো ১১ জন ফেসবুক গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা এডমিন।

সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের এডমিন মো. আখতার হামিদ নিজ এলাকার নামে গড়ে তোলেছেন লামা ব্লাড ব্যাংক। প্রতিষ্ঠাকালীন বন্ধু ও সহপাঠী আদনান, রুবেল হাসান, আমির, সাকিব, তৌহিদ ইসলামসহ ৭/৮ জন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা এখন ৪০ জন বলে জানান আখতার হামিদ। এ সংগঠনের মাধ্যমে পার্বত্য জনপদেও স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহ সৃষ্টির কাজ করছেন এসব তরুণ। স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের মাধ্যমে এরইমাঝে পাহাড়ের রক্ত সেনানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তারা।

আখতার হামিদ বলেন, সিটিজি ব্লাড ব্যাংক ও লামা ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা দিনে অন্তত ৩০ জনের রক্ত ম্যানেজ করে দিয়ে থাকি। বিশেষ করে আমাদের গ্রুপের সদস্যরাই স্বেচ্ছায় রক্তদান করে থাকেন। যদিও আগের স্বাভাবিক সময়ে এই সংখ্যা আরো বেশি ছিল।

সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এডমিন ইমরান ইমু বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে অনেক দূরদূরান্ত থেকে এসেও রক্তদাতারা রক্তদান করেছেন। কিন্তু করোনাকালীন বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে রক্তদানে আগ্রহ কম দেখা গেছে। অনেকের আগ্রহ থাকলেও যাতায়াত জটিলতায় আসতে পারেননি। অনেকে আবার ঘর থেকে বের হতে চাননি। সবমিলিয়ে করোনাকালে রক্তদানে আগ্রহ কমেছে। তবে পরিস্থিতি এখন আবার স্বাভাবিক হয়েছে। এখন রক্তদানে আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ছে।

এদিকে, আজ (১৪ জুন) পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ভূমিকা রাখছেন তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের উদ্দেশ্য। এদিন বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টিনারের জন্মদিন। নোবেলজয়ী এ বিজ্ঞানী রক্তের গ্রুপ ‘এ, বি, , এবি’ আবিষ্কার করেছিলেন।

বিশ্ব রক্তদাতা দিবস উপলক্ষে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সম্মাননা প্রদানের আয়োজন করেছে সন্ধানী চমেক শাখা। চমেকের শাহ বীর উত্তম মিলনায়তনে আজ (মঙ্গলবার) সকাল সাড়ে দশটায় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান। বিশেষ অতিথি থাকবেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান, চমেক অধ্যক্ষ ডা. সাহেনা আক্তার, উপাধ্যক্ষ ডা. হাফিজুল ইসলাম।

১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে। প্রতিবছর সারাবিশ্বে ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়। এখনও বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের রক্তদানের ওপর। আর অনেক দেশে পেশাদারি রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে। যদিও স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে দেয়া রক্তই ‘নিরাপদ রক্ত সরবরাহের’ মূল ভিত্তি বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন
পরবর্তী নিবন্ধমালয়েশিয়ায় যাওয়ার নিবন্ধন করা যাবে যেভাবে