নতুন করোনাভাইরাস বাদুড় অথবা অন্য কোনো প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে এসেছে। সেজন্য কি সেই প্রাণী দায়ী? না, মানুষই বারবার নিজের সীমানা পেরিয়ে অন্য প্রাণীর রাজ্যে হানা দিয়ে সংক্রমিত হচ্ছে, যার ফল হচ্ছে মহামারী। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে সেই তত্ত্বের তালাশ নিয়েছেন বিবিসির পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদক হেলেন ব্রিগস।
জিম্বাবুয়ের মাবুয়া গুয়ানো গুহা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘পবিত্র স্থান’ হিসেবে বিবেচিত। গবেষণার কাজে যতবারই ওই গুহায় যেতে হয়, তার আগে প্রতিবারই ‘আত্মার সন্তুষ্টির জন্য’ উপঢৌকন নিয়ে গ্রামের বয়োজেষ্ঠদের কাছে অনুমতি চাইতে হয় ড. ম্যাথিউ বার্গারলকে। অঙিজেন মাস্ক, দীর্ঘ ওভারঅল, তিন স্তরের গ্লাভস পরে অন্ধকারের ভেতরে দড়ির মই বেয়ে গুহার ওই সরু পথে নামতে হয়। গুহার সর্বত্র বাদুড়ের চেনা গন্ধ। মেঝেতে তাদের বিষ্ঠার স্তর পরে গেছে। ওর মধ্যে দিয়েই যেন সদ্য জমা তুষার ঠেলে ঠেলে হাঁটতে হয়। হঠাৎ কখনও চমকে ঘুম ভাঙে বাদুড়ের। ডানা ঝাপটে সে উড়াল দেয়। জিম্বাবুয়ের এই অংশে বাদুড়কে বলে ডানাওয়ালা ড্রাগন। কেউ বলে উড়ুক্কু ইঁদুর, নয়তো শয়তান। খবর বিডিনিউজের।
ম্যাথিউ বার্গারল বলেন, বিশ্বের অন্য অনেক জায়গার মতো জিম্বাবুয়েতেও উড়তে জানা এই স্তন্যপায়ীদের নিয়ে মানুষের ভুল ধারণা আছে। অথচ এরাও সুন্দর, দারুণ সব প্রাণী। ওরা তো রীতিমত মুগ্ধ হওয়ার মতো। মানুষ আসলে সেই জিনিসকে ভয় পায়, যার সম্পর্কে সে জানে না। ফ্রেঞ্চ রিসার্চ ইনস্টিটিউট সিরাডের জন্য ভাইরাস তালাশ করে বেড়ান ড. ম্যাথিউ বার্গারল। ইউনিভার্সিটি অফ জিম্বাবুয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বাদুড়ের নমুনা ও মল সংগ্রহের জন্য তাকে গুহায় যেতে হয়। এসব নমুনা ল্যাবে পৌঁছালে বিজ্ঞানীরা বাদুড়ের শরীরে থাকা ভাইরাসের জিন বিন্যাস বের করেন। এভাবে তারা কয়েক রকম করোনাভাইরাস খুঁজে পেয়েছেন, যার মধ্যে আছে সার্স এবং সার্স-সিওভি-২।
বাদুড় শরীরে যত ধরনের ভাইরাস বহন করে, সেগুলোর বিবর্তন ও জেনেটিক রূপ নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ম্যাথিউ বার্গারলদের গবেষণাও তারই অংশ।
ইউনিভার্সিটি অব জিম্বাবুয়ের ড. এলিজাবেথ গোরি বলেন, ফসলের ক্ষেতে সার হিসেবে ব্যবহারের জন্য স্থানীয়রা প্রায়ই ওই গুহায় যান বাদুড়ের বিষ্ঠা সংগ্রহ করতে। সে কারণে ওই গুহার বাদুড়ের শরীরে কোন কোন পরজীবী আছে তা জানাটা দরকার। কারণ বাদুড় থেকে তা মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে।
বাদুড় নিয়ে মানুষের মনে ভয় আর কুসংস্কার এই প্রাণীটির সংরক্ষণকে কঠিন করে তুলছে। সে কারণে বাদুড় বিশেষজ্ঞরা প্রচার শুরু করেছেন। তারা বলছেন, বাদুড়কে দোষ দেবেন না। তাদের মতে, পৃথিবীতে যে প্রাণীগুলোকে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝে এবং অবমূল্যায়ন করে, তার একটি হলো বাদুড়। দীর্ঘদিন ধরেই অনেক সমাজে একটি কুসংস্কার চালু রয়েছে, তা হলো বাদুড়ের ভেতর বাস করে ‘অপদেবতা’। আর তা মানুষের শরীরেও আছর করে। আর করোনার এই মহামারীর মধ্যে বাদুড় নিয়ে কুসংস্কার আর ভুল ধারনাগুলো যেন আরও বদ্ধমূল হলো।
পুরা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া নতুন করোনাভাইরাসের আসল উৎপত্তিস্থল কোথায় তা এখনও জানা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ একমত হয়েছেন, এই ভাইরাস মানুষের শরীরে পৌঁছেছে কোনো প্রাণীর মাধ্যমে আর সম্ভবত সেটা বাদুড়। তবে সেজন্য বাদুড়কে দোষ দিতে রাজি নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলে মানুষের আনাগোনা বাড়াই সমস্যার মূল কারণ।
মানুষ যেভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছে, তার সঙ্গে নতুন নতুন রোগের বিস্তার ঘটার যোগসূত্র রয়েছে। তাতে বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের মাঝে ভাইরাস ছড়ানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
ড. রোচা বলেন, একটি সুস্থ বাস্তুসংস্থান এবং মানুষের ভালোর জন্য বাদুড়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ফসলের জন্য ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ সাবাড় করে বাদুড়। ক্রান্তীয় অঞ্চলে ডুরিয়ান ফলের মতো অনেক গাছের পরাগায়নেও ভূমিকা রাখে। রেইন ফরেস্টের বৃক্ষের বীজ বাদুড় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়; যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জরুরি। যেসব বাদুড় পোকামাকড় খায়, তারা প্রতি বছর ফসলের ক্ষতি কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকদের ৩৭০ কোটি ডলার বাঁচিয়ে দিতে পারে। সুতরাং বাদুড়কে ‘অপদেবতা’ বানিয়ে দেওয়াটা ‘ভয়ঙ্কর বিপর্যয়’ ডেকে আনবে।