মাত্র তিন দশক আগেও কক্সবাজার শহরে মিঠা পানির জলাভূমি ছিল ২৭% এর বেশি। এখন জলাভূমি আছে ৫% এর কম। প্রায় একই অবস্থা কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় গ্রামাঞ্চলগুলোও। কিন্তু কক্সবাজারে এভাবে মিঠা পানির জলাভূমি কমে যাওয়ার কারণে ভূ–গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর দ্রুত নীচে নেমে যাচ্ছে এবং মিঠা পানির স্তরে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত লবণ ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে জানান পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা জানান, মাত্র তিন দশক আগেও কক্সবাজার শহরসহ জেলাজুড়ে মাত্র ১০ থেকে ২৫ ফুট গভীরে নলকূপ বসিয়েই সারা বছর সুপেয় মিষ্টি পানি পাওয়া যেত। এমনকি কিছু কিছু এলাকায় অগভীর নলকূপ থেকেই ঝর্ণার মতো অনবরত পানি বের হতো। আর এখন সুপেয় পানির জন্য কোনো কোনো এলাকায় যেতে হয় ৮শ ফুটের বেশি গভীরে। এভাবে ভূ–গর্ভস্থ জলাধারের পানির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে কক্সবাজার শহরসহ জেলার উপকূলবর্তী এলাকায় ভূ–গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর দিনদিন নীচে নেমে যাচ্ছে বলে মনে করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, গত তিন দশকে কক্সবাজারে ভূমির ব্যবহারে ব্যাপকমাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। এতে ভূ–গর্ভস্থ পানীয় জলের জলাধারের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর ব্যাপকভাবে নীচে নেমে যাচ্ছে এবং মিঠা পানির স্তরে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত লবণ ও কিছু ক্ষতিকর পদার্থের অনুপ্রবেশ ঘটছে। তিনি ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কক্সবাজারে মিঠাপানির জলাশয় গড়ে তোলার এবং ভূ–গর্ভস্থ পানির পরিবর্তে ভূ–উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দেন। ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুতন্ত্রে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশবিদ্যায় জলাভূমিকে কার্বন সিঙ্ক বা কার্বন শোষক, দূষণ ফিল্টার, বন্যা নিয়ন্ত্রক, বন্যজীবন নার্সারি, উর্বর খামার জমি এবং ঝড় ও বাতাস প্রতিরোধক হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জলাভূমি ভূ–গর্ভস্থ পানীয় জলের মজুদ ঠিক রাখে। ভূ–গর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহারের কারণে জলাধারে ক্ষতিকর পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে। আর এ দূষণকে ঠেকিয়ে দেয় মিঠা পানির জলাভূমি।
এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে কক্সবাজার শহরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বা ২৯.৫৮% ভাগ এলাকা ছিল লতা–গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ আচ্ছাদিত। আর দ্বিতীয় স্থানে ছিল জলাশয়, যা শহরের ২৭.২৯% ভাগ এলাকা। ওই সময় শহরের মাত্র ১২.৬৯% ভাগ এলাকায় ঘরবাড়ি ছিল, আর ৯.৯% ভাগ এলাকায় ছিল বালিয়াড়ি। এছাড়া শহরে বন ছিল ৬.৪৪% ভাগ এলাকায় এবং কৃষি জমি ছিল ১২.৮৯% ভাগ। কিন্তু মাত্র ২১ বছরের ব্যবধানে ২০১০ সালের জরিপে জনবসতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১.৩৯% ভাগে, লতা–গুল্ম–ঝোঁপঝাড় কমে দাঁড়ায় ২৩.৬০% ভাগ, জলাশয় ১৭.৩১%, কৃষি জমি ৯.৯২%, বালিয়াড়ি ২.২৭% , বন ৫% এবং আদ্র জমি ৫.৩০ ভাগ। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে ভূমির ব্যবহার আরো ব্যাপক মাত্রায় পরিবর্তিত হয়েছে বলে মনে করেন জরীপকারী গবেষক দলের অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ আশরাফুল হক। তিনি মনে করেন, গত ১০ বছরে শহরে জনবসতির হার আরো অনেক বেড়েছে, কমে গেছে জলাশয়, বন, কৃষিজমি, লতাগুল্ম ও বালিয়াড়ি। বর্তমানে শহরে ৫% মিঠা পানির জলাশয়ও আছে কীনা সন্দেহ।
বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী ড. আনছারুল করিম বলেন, মিঠা পানির জলাভূমি কমে যাওয়ার কারণে ইতোমধ্যে কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার কৃষি জমিগুলো বহুবর্ষজীবী জল ধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে। পাহাড়কাটা, বন ধ্বংস, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে কক্সবাজার পরিবেশগতভাবে এখন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। পরিবেশের উপর এই ধ্বংসযজ্ঞ না থামালে এবং হারিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা না হলে খুব শীঘ্রই কক্সবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।
তিনি পানি সংকট সমাধানে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা এবং এ জন্য প্রতিটি এলাকায় বড় বড় জলাধার তৈরির পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমরা যদি একটি এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের এক মিটার উপরে মিঠা পানি ধরে রাখতে পারি, তাহলে ‘গিবেন–হার্জবার্গ সূত্র’ অনুযায়ী ওই এলাকার আশেপাশে ভূ–গর্ভস্থ মিঠাপানির স্তর ৪০ গুণ বেশি বা ৪০ মিটার নীচে নেমে যাবে।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, জলাভূমি মাটির উপরে বৈচিত্রময় প্রাণের সমাবেশ ঘটায়। মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। মাটির নীচের আদর্শ রসায়ন ঠিক রাখতেও সহায়তা করে জলাভূমি। বিনোদন ও পর্যটনের জন্যও জলাভূমির গুরুত্ব অতুলনীয়।