মধ্য আগস্টের পর থেকে বাড়তে থাকা ডেঙ্গুর প্রকোপ যেন কমছেইনা চট্টগ্রামে। মহানগরসহ জেলায় এখনো দৈনিক প্রায় শ’খানেক নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
গতকালের আগের ২৪ ঘন্টায়ও নতুন করে ৭৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত) চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৭১ জনে। আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যুর হারও যেন দিনদিন বাড়ছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ২০ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। এর সিংহ ভাগ মৃত্যুই গত অক্টোবরে। নভেম্বরেও মৃত্যুর এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাসের প্রথম ৮ দিনে অন্তত ৫ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না বলে অভিমত দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। সপ্তাহখানেক আগে সিভিল সার্জন বলেছিলেন, কয়দিন বৃষ্টি বন্ধ থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ের সময় ফের কয়েকদিন বৃষ্টি হয়েছে। আর থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন পাত্রে (জায়গায়) পানি জমে মশার লার্ভার সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে এডিশ মশার প্রজনন (বংশ বিস্তার) ঘটছে। যার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে হলে টানা ১৫ দিন বৃষ্টি বন্ধ থাকতে হবে। বৃষ্টি বন্ধ না হলে প্রকোপ কমার সম্ভাবনা তেমন নেই, বরং প্রকোপ আরো বাড়তে পারে।
প্রসঙ্গত, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গত ২৩ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে টানা কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হয়। তবে ঘূর্ণিঝড় শেষে ২৭ অক্টোবর থেকে আর বৃষ্টির দেখা মেলেনি। হিসেবে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী টানা প্রায় ১৫ দিন ধরে আর বৃষ্টি হয়নি চট্টগ্রামে। এরপরও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকার পরও ডেঙ্গুর প্রকোপ না কমার কারণ হিসেবে বিআইটিআইডির ক্লিনিক্যাল ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, এডিশ মশার বংশ বিস্তারে অনিয়মিত বা থেমে থেমে বৃষ্টিপাত অন্যতম ফ্যাক্টর। তবে বৃষ্টিপাত ছাড়াও আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর রয়েছে। এ দুটি ফ্যাক্টর হল- তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা। ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এডিশ মশার বংশ বিস্তারের জন্য খুবই সহায়ক। একইভাবে বাতাসের আর্দ্রতা যদি ৮০ শতাংশ থাকে, সেটিও এডিশ মশার বংশ বিস্তারের জন্য সহায়ক। এই সময়ে কিন্তু তাপমাত্রা ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে উঠানামা করছে। আর বাতাসের আর্দ্রতাও রয়েছে ৮০ শতাংশের কিছু কম-বেশি। ফলে বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকলেও তাপমাত্রা এবং বাতাসের আর্দ্রতা সহায়ক থাকায় এডিশ মশার বংশ বিস্তার ঘটছে। এতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না। তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসলে বাতাসের আর্দ্রতাও কমে আসবে। তখন ডেঙ্গুর প্রকোপও পর্যায়ক্রমে কমে আসবে।
তবে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতাসহ সার্বিক পরিবেশ এডিশ মশার বংশ বিস্তারের প্রতিকূল হলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ একদম শেষ হয়ে যাবে না বলে মনে করেন সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা কীটতত্ত্ববিদ এন্তেজার ফেরদৌস। তিনি বলেন, পুরুষ এডিশ মশার জীবনকাল মাত্র ৭দিন। কিন্তু যেটির মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায় সেই নারী (ফিমেল) এডিশ মশা ২৮ দিন পর্যন্ত বাঁচে। জীবনকালে সে যতগুলো ডিম পাড়ে সবগুলোতেই ভাইরাস থাকে। তাই ২৮ দিনে ওই মশা মারা গেলেও তার রেখে যাওয়া ডিম (লার্ভা) থেকে মশার প্রজনন ঘটে। এভাবে চক্রাকারে এডিশ মশার বংশ বিস্তার ঘটতে থাকে।
এডিশ মশার লার্ভা ৬ মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সক্রিয় বা বেঁচে থাকে জানিয়ে কীটতত্ত্ববিদ এন্তেজার ফেরদৌস বলেন, বৃষ্টিপাত বন্ধ হলেও ইনডোরের (বাসা, কারখানা, গ্যারেজ প্রভৃতি) লার্ভা থেকে মশা প্রজননের পরিবেশ থেকে যায়। মশার লার্ভা ৬ মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সক্রিয় বা বেঁচে থাকে। এই সময়ে কোনোভাবে যদি পানি পায়, তখন ওই লার্ভা থেকে এডিশ মশার প্রজনন ঘটে।
ফলে এডিশ মশার বংশ বিস্তার থেমে থাকে না।
আক্রান্ত মানুষের কাছ থেকে নিয়ে এডিশ মশা সুস্থ মানুষের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে থাকে জানিয়ে বিআইটিআইডির ক্লিনিক্যাল ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ বলেন, অন্য প্রাণীর শরীরে এই ভাইরাস ছড়ায় কী না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে একটি ধারণা আছে যে, এডিশ মশা কিছু প্রাণীর শরীরেও ডেঙ্গু ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেয়। এসব প্রাণীর মধ্যে গরু, ছাগল, ঘোড়া, শুকর রয়েছে। যদিও ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও এসব প্রাণীর জ্বর আসেনা। পরবর্তীতে এসব প্রাণীকে কামড়ানোর মাধ্যমে তাদের শরীরে ছড়িয়ে দেয়া ভাইরাস এডিশ মশা পুনরায় গ্রহণ করে থাকে। পরে মানুষকে কামড়ানোর মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়। এডিশ মশা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে ধরে নিয়ে মশা যাতে কামড়াতে না পারে সে বিষয়ে নিজেদের সুরক্ষা নিজেদের নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ডা. মামুনুর রশীদ।
এদিকে, আস্তে আস্তে তাপমাত্রা কমে আসছে জানিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। অক্টোবর এক মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৬১ জনে। যা সেপ্টেম্বর মাসের তিনগুণ। সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬০১ জন। আগস্টে ১১৪ জন এবং জুলাইয়ে ৬৪ জন আক্রান্ত হয়। এর আগে জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪ জন, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ০ জন এবং জুনে ১৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় চট্টগ্রামে। আর চলতি নভেম্বরের প্রথম ৬ দিনে চার শতাধিক ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের তথ্য দিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। সবমিলিয়ে চলতি মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৭১ জনে।