কবি আসাদ চৌধুরীর একটি চিঠি ও প্রাসঙ্গিক স্মরণ

শিশির দত্ত | শুক্রবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ at ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ

আসাদ চৌধুরীর সাথে প্রথম কোথায় দেখা, ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে যেটুকু মনে পড়ে শরীফ মিঞার ক্যান্টিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সত্তর দশকে নিজেও প্রচুর কবিতা লিখেছি লিটল ম্যাগাজিনে। কবিতা ছাপা হতো ছোটকাগজে। আসাদ ভাই তখন ছোটকাগজের প্রধান লেখক। তার আগে ‘স্পার্ক জেনারেশন’ আন্দোলন নানাভাবে পরিচিতি পেয়েছে। তখনকার প্রজন্মকে আমাদের দলগত লেখালেখি বিশেষভাবে গদ্যভঙ্গি কবিতা, লিফলেট ও পোস্টার সাহিত্য কমবেশি নজর রাখতে সাহায্য করেছে। আসাদ ভাই তখন হয়ে উঠেছেন আমাদের নিত্যসঙ্গী। ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে ‘সাধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে’ এসে পড়তেন। অনেক আড্ডা হতো, তখন কবিতার জন্য কীনা করতে পারি, আমাদের অগ্রজ আসাদ ভাই ছিলেন অনেক ক্ষেত্রের অভিভাবক। তখন আজকের মতো প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ছিল না, চিঠিই ছিল যোগাযোগ রক্ষার সেতু। প্রত্যক্ষেপরোক্ষে নানা শাসনে তিনি আমাদের নিয়ন্ত্রণও করেছেন। এই লেখার সাথে আসাদ ভাইয়ের একটি চিঠি সংযুক্ত রইল, সেসময়কালে আমাদের সাহিত্যআড্ডা, ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা পাবার জন্য। বাংলা একাডেমির দায়িত্বপূর্ণ পদে বহাল হওয়ায় তাঁর এই আসাযাওয়ায় কিছুটা ছেদ পড়ে; তবে চট্টগ্রামের প্রতি আসাদ ভাইয়ের ভীষণ অনুরাগের কথা মনে পড়ে। আমাদের সাংগঠনিক কাজগুলোতে তাঁর প্রচুর সমর্থন পেয়েছি। সম্পাদক প্রকাশনীর শুরুতেই ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়’ এই শিরোনামের কবিতাগ্রন্থটি তিনি সম্পাদকের জন্যই তৈরি করেছিলেন। এই কাব্যগ্রন্থটি যথারীতি ডিমাই ওয়ান এইট সাইজেরও ছিল না। কিছুটা দুঃসাহসিক হয়ে তিনি আমাদের প্রস্তাবিত সাইজটি সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। আমাদের পছন্দের খালিদ আহসানকে দিয়ে কবিতা বইয়ের প্রচ্ছদ করাবো, এটিও সহজে গ্রহণ করেছিলেন। এরকম নানা স্বাধীনতা দিয়ে তিনি সবসময় আমাদের আপন করে নিয়েছেন।

কবি আসাদ চৌধুরী কবি হিসেবে যত বড়, মানুষ আসাদ চৌধুরী আরও বড়। তিনি যে কেবল লেখক সাহিত্যিকদের সাথে আড্ডা দিতেন এমন নয়। সব বয়সী মানুষদের সাথে আড্ডা দেওয়া তাঁর এক সন্মোহনী ক্ষমতা ছিলো। আমাদের বাসায় যখন আসতেন তিনি আমার মায়ের সাথেও আড্ডা দিতেন, তাঁর সাথে বিষয় ছিল রান্নাবান্না। সাধারণ বিষয়কেও কৌতুকপ্রদ উপস্থাপনে তিনি প্রাণ সঞ্চার করতে পারতেন। চরম সত্যটাও সহজে বলতে পারতেন, কোনো কিছুতেই তাঁকে পোশাকী ভাষা ব্যবহার করতে দেখিনি। তাঁর আরও একটি বৈশিষ্ট্য বরাবরই আকৃষ্ট করতো, তা হলো তিনি ছিলেন খুবই মনোযোগী পাঠক। কবিতার বাঁক বদলের ধারাটা তিনি সহজেই তুলে এনেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। আমাদের কবিতার পরিবর্তনগুলো নিয়ে তাঁর অনায়াস উচ্চারণ বিনা দ্বিধায় মেনে নিতাম।

আসাদ ভাই ‘কেন লিখতেন’ বিষয়টার একটা ব্যাখ্যা তাঁর কাছে ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতির ঘটনাগুলো সর্বদা তাঁকে আহত করেছে। ঐতিহাসিক বিষয়গুলোতে তিনি আপোষহীন ছিলেন। এই সত্য বলার দায় হিসেবে লেখালেখিকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি যে প্রচুর লিখতেন তাও নয়। লেখালেখির পাশাপাশি টেলিভিশনের উপস্থাপনা কিংবা জার্মান রেডিওতে চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও তিনি তাঁর নিজস্ব পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন করেননি নিজেকে, সবকিছুর ভেতর তাঁর কবিতার নিজস্ব বলার ধারা থেকে নিজেকে আলাদা করেননি। জার্মানি থাকা অবস্থায় কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

আসাদ ভাইয়ের কবিতা নিয়ে অলোকরঞ্জনকে উৎসাহী হতে দেখেছি। আসাদ ভাই সহ অলোকদার হাইডেলবার্গএর বাড়িতে এক অসীম (ঝুলন মায়া) আড্ডায় মিলিত হওয়ার স্মৃতি এখনো টানে। আসাদ ভাই নেই ভাবতে পারি না। অলোকদা নেই ভাবতে পারি না। গত কিছু বছর আসাদ ভাই কানাডাবাংলাদেশ করে কাটিয়েছেন। শেষ দেখা চট্টগ্রামে ২০২২এ জামাল খানের সিনিয়র্স ক্লাবে। একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলাম। পরিবার,আমার মা,ভাবী,স্বপনদা(কবি স্বপন দত্ত), কমলদা (কমল সেন গুপ্ত), শহীদুল হক, আবসার (কবি অবসার হাবীব),আমাদের সন্তান এই প্রসঙ্গগুলোই বেশি উচ্চারিত হয়েছে। মাঝে দেশকাল, রাজনীতি, কবিতা ইত্যাদি। ‘অরিন্দম ৪৫ পেরিয়ে’ অনেক সময় ধরে উল্টেপাল্টে দেখছিলেন। আমি তখনো ভাবিনি এই শেষ দেখা হবে আসাদ ভাইয়ের সাথে। লিফটে এসে নিচে অব্ধি এগিয়ে দিয়ে বললেন, কেউ বাসা থেকে বের হতে দিতে চায় না। আমি বললাম, ভাবীকে নিয়ে আসবেন। বললেন, পরের বার এলে বিটায় যাব। কমলকে (কমল সেন গুপ্ত ) বলবেন ঢাকায় গেলে দেখা করতে। কমলদার সাথে দেখা হয়েছিল কি না জানি না, কমলদাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। আমাদের গদ্য নিয়ে আসাদ ভাইয়ের ছিল অনেক বেশি উৎসাহ। বেশিবেশি অভিযোগ ছিল আমরা কেন লিখছি না!

আসাদ ভাই তাঁর সমকালকে ধরতে পেরেছিলেন। তাই ‘কোথায় সত্য’এর মতো কবিতা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। প্রথম কাব্য গ্রন্থেও নামকরণ করেছিলেন ‘তবক দেওয়া পান’। এর মধ্যেই খুঁজতে চেয়েছেন আমাদের সমাজের অতীত ও ঐতিহ্য। চট্টগ্রামে শুধু নয় দেশের প্রায় বিভিন্ন জায়গায় তরুণরা যারা লিখছে কারা কী লিখছে, ভাল লিখছে এসম্পর্কে তিনি একটা ধারণা রাখতেন। চট্টগ্রামে নারীদের কবিতা লেখার বিষয়েও তাঁকে সাংঘাতিক উৎসাহিত হতে দেখেছি। বিশেষভাবে সেলিনা শেলী, শুক্লা ইফতেখার, আসমা বীথি, রিমঝিম আহমেদ প্রমুখদের কবিতা। হাফিজ রশিদ খান ও ওমর কায়সারের কবিতার কথা আলাদাভাবে স্মরণ করেছেন।

সাধারণ মানুষের মতোই সহজ প্রকাশে লেখার ভিতর আবেদন তৈরি করতে পারা তাঁর এক বড় গুণ; সংবেদনশীলতার পরিচয় মেলে সেখানে। আসাদ ভাইয়ের ভেতরে এই গুণ বারবার দেখেছি তাঁর ব্যক্তি জীবনে ও কবিতায়। যেখানে তিনি একেবারেই আলাদা ও স্বতন্ত্র। তাই তাঁর কবিতা অনেকে পড়বেন, অনেক দিন পড়বেন।

 

পরমপ্রীতিভাজনেষু

শিশির,

অত্যন্ত আকষ্মিকভাবে চলে গেলেন, মন খুলে আলাপও করতে পারলাম না। আশা করি ভালোই আছেন।

সোলায়মান সাহেব জানালেন যে শহীদ নাকি ২/১ দিনের মধ্যে সৌদি চ’লে যাচ্ছেন। প্রথমে বিস্ময়ে আমি কাবু হয়ে পড়েছিলাম, পরে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। ‘চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ’ গ্রন্থের লেখক জামাল খান বাইরে থাকেন, তিন বছর ধ’রে পাণ্ডুলিপিটি আমার কাছে আছে, এবার আগষ্টে বইটি বের করবো, রকম কথা তাঁকে দিয়েছি। কতোদূর ছাপা হ’লো, প্রচ্ছদ কতো দূর, সব চিন্তা আমাকে কাবু ক’রে দিয়েছে। আপনি আমাকে এসম্পর্কে একটু জানান। আমি ইউনুছ সাহেবকেও লিখবো, তবে আপনার চিঠি পাওয়ার পরই। কী পরিমাণ টাকা লাগবে, তাও বুঝতে পারছি না।

শহীদের সঙ্গে কথা হয়েছিলো, চট্টগ্রামে গিয়ে বইটি শেষ ক’রে চলে আসার তা শহীদই তে চলে যাচ্ছেন।

এবারে আপনার ঢাকার অভিজ্ঞতা যে ভালো হয়নি, তা অনুমান করি। ভাবুন দেখি, রকম পরিবেশে বছরের পর বছর আমাদেরকে বাস করতে হচ্ছে, চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য একারণেই পাগল হ’য়ে উঠেছিলাম এক সময়। চট্টগ্রামটা অন্তত: আমার আনন্দের মুক্তির শহর হ’য়ে থাক।

কেমন আছেন। কেমন লিখছেন। আপনার রচনার নির্মাণকৌশল বাধা ছন্দের মধ্যে না এলে; আশঙ্কা হয়, পাঠকের প্রয়োজনীয় মনোযোগ লাভ করতে পারবেন না। অথচ এশ্রমটুকু আপনি যে কেন করছেন না, আমি বুঝতেই পারছি না। লেখালেখিকে সিরিয়াসলি নিতে পারার ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে। আহত করলাম না তো?

গতকাল হঠাৎ ক’রে আমার প্রিয় বন্ধু হাঁপানী এসেছিলেন, আজকে নেই। আশঙ্কা আস্কারা পেলে এনার আবির্ভাব অবার ঘটবে।

মাঝেমধ্যে চিঠি দেবেন, খোঁজখবর নেবেন।

আসাদ চৌধুরী

১১ই শ্রাবণ, ১৩৮৯

(চিঠিটি অসম্পাদিত অবস্থায় হুবহু ছাপা হলো)

পূর্ববর্তী নিবন্ধজ্যোতির্ময় নন্দীর দুটি কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধযে ছবি উসকে দিয়েছে তাদের এক হওয়ার গুঞ্জন