গত শতকের ষাটের দশকে বাংলা কথাসাহিত্যের বাঁক বদলের রূপকারদের একজন হাসান আজিজুল হক আর নেই। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগে গতকাল সোমবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা বিহাসে নিজের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে…রাজেউন)। একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত এই গদ্যশিল্পীর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ পুরস্কারও ছিল তার মুকুটে। ১৯৫৮ সালে শামসুননাহারকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। হাসান আজিজুল হকের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন- রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে তিন দশক অধ্যাপনার পর ২০০৪ সালে তিনি অবসরে গিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। গত কিছু দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন হাসান আজিজুল হক। বাথরুমে পড়ে কোমরে ব্যথা পাওয়ার পর বছরের মাঝামাঝি থেকে শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি।
হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা সেই গ্রামেই করেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিলেন ১৯৫৬ সালে খুলনার বিএল কলেজ থেকে। তখন ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনও সইতে হয়েছিল তাকে। এক পর্যায়ে খুলনা থেকে এসে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ১৯৫৮ সালে এই কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৬০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে পদচারণা রাজশাহী কলেজে পড়ার সময়, ভাঁজপত্র ‘চারপাতা’য় প্রকাশিত এক রম্য রচনার মাধ্যমে। রাজশাহীর আম ছিল সেই রচনার উপজীব্য।
‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’র মতো গ্রন্থের গল্পগুলো বোদ্ধা পাঠকের মনযোগ কেড়ে নেয়। এছাড়াও হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, আমরা অপেক্ষা করছি, রোদে যাবো, রাঢ়বঙ্গের গল্প। বাংলা ছোট গল্পের ‘রাজপুত্র’ খ্যাতি পাওয়ার পর উপন্যাসে হাতে দেন হাসান আজিজুল হক। তার লেখা উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে বৃত্তায়ন, আগুনপাখি, সাবিত্রী উপাখ্যান। প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- চালচিত্রের খুঁটিনাটি, একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা, কথাসাহিত্যের কথকতা, অপ্রকাশের ভার, অতলের আধি, সক্রেটিস, কথা লেখা কথা, লোকযাত্রা অআধুনিকতা সংস্কৃতি। চন্দর কোথায়’র মতো ভাষান্তরিত নাটকের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য লালঘোড়া আমি, ফুটবল থেকে সাবধানের মতো গল্পও এসেছে তার লেখনীতে। হাসান আজিজুল হক ১৯৬৭ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। এরপর লেখক শিবির পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পান তিনি। ১৯৯৯ সালে তাকে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে সরকার। ২০১৯ সালে পান দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার।










