কত উজির নাজিরের জীবন গেল, আড্ডা কিন্তু থামেনি

বিশ্বজিৎ চৌধুরী | শুক্রবার , ২১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

নন্দনকাননে চা-মিষ্টির দোকান ‘বোস ব্রাদার্সে’ এক সন্ধ্যায় দুটি টেবিল ঘিরে আড্ডায় মশগুল শহরের এক ঝাঁক তরুণ কবি-লেখক। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সাহিত্য কী, কেন ও কীরকম হওয়া উচিত, দেশের কোন লেখক অহেতুক অতিমূল্যায়িত, আর কার প্রতি প্রচারমাধ্যম বা পাঠক-সমালোচকেরা অবিচার-অবহেলা করেছেন তার চুলচেরা হিসাব-নিকাশ হচ্ছে। তুখোড় আড্ডাবাজদের কথার তুবড়িতে কোথায় গিয়ে ছিটকে পড়ছেন নামি-দামি লেখকেরা তার ইয়ত্তা নেই। এরকম উত্তেজনাকর মুহূর্তে ছাই বর্ণের শ্মশ্রুমন্ডিত, প্রৌঢ়ত্বের দিকে পা-বাড়ানো এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন সেই আড্ডায়। বিনীত কণ্ঠে নিজের পরিচয় দিলেন তিনি, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বিভাগে চাকরি করেন। এরপর হাঁটুর বয়েসী আড্ডারুদের সামনে সলজ্জ কণ্ঠে জানালেন, তিনি একজন কবি, তাঁর ভাষায়, ‘কবিতা লেখার এক-আধটু চেষ্টা করি।’

‘তা ঠিক আছে, আপনার যা খুশি আপনি লেখেন, আমাদের এখানে কেন? আমাদের কী করার আছে?’ অত্যন্ত অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন আড্ডারুদের একজন।
খুব স্বাভাবিক, যেখানে ‘জাতীয়-আন্তর্জাতিক’ মানের সাহিত্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে, সেখানে মাঝবয়েসী একজন ‘নবীন’ কবির আদিখ্যেতা এই তরুণ কবি- লেখকদের ভালো লাগবে কেন! বিশেষত তাঁরা নিজেরাই যখন নিজেদের এক একজনকে সাহিত্যের দিক্‌পাল ভেবে বসে আছেন।

ভদ্রলোক পুত্রসম তরুণদের দুর্বিনীত আচরণে খুব বেশি মনোক্ষুণ্‌্ন হলেন বলে মনে হলো না, আজকালকার ছেলেরা এরকমই হয়ে থাকে, তদুপরি এঁরা আবার লেখক। তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের অনেকের নাম শুনেছি, লেখাও পড়েছি, আপনারা বোস ব্রাদার্সে রোজ আড্ডায় বসেন শুনে একটু দেখা করতে এলাম।’
এ কথায় তরুণদের মন কিছুটা ভিজল, যত যা-ই হোক ‘নাম শুনেছি’ বা

‘লেখা পড়েছি’ কথা দুটোর মধ্যে তাঁদের অহং তৃপ্ত হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল। এরপরই ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি আপনাদের একটু চা-নাশতা খাওয়াতে চাই।’
ব্যস, মুহূর্তে তরুণেরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন, তাঁদের রুক্ষ কঠিন চেহারা গদগদ হয়ে উঠল, তাঁরা ভদ্রলোককে সসম্মানে বসার জায়গা করে দিলেন।
চা-নাশতা এল। সকলের প্রসন্ন চেহারার দিকে তাকিয়ে এবার ভদ্রলোক ঝোলা থেকে একটি কবিতার বই বের করলেন। তাঁর নিজের লেখা কবিতার সংকলন। তরুণেরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। ভদ্রলোক তাঁর বই থেকে স্বকণ্ঠে একটি কবিতা পড়ে শোনানোর অভিপ্রায় প্রকাশ করলেন। ততক্ষণে সিঙ্গারা শেষ হয়েছে, চায়ে চুমুক দেওয়া চলছে। ‘নবীন’ কবিকে নিরস্ত করার কোনো উপায় আর নেই। তিনি একটি কবিতা পড়ে শোনালেন, এতকাল পর সে কবিতা মনে থাকার কথা নয়, তবে ‘উঠিল তপন জাগিল নয়ন, প্রভাত হইল ভোর…’ পংক্তিটি এখনও, কোনো অজ্ঞাত কারণে (হয়তো এটাই কবি জীবনের সার্থকতা!) মনে রয়ে গেছে।

ভদ্রলোক চলে যাওয়ার আগে তাঁর একটি বই উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্যিস তিনি জানেন না, তাঁর কাব্যগ্রন্থের কী রকম সমাদর (!) হয়েছিল তরুণদের হাতে। তরুণ আড্ডারুদের কেউ একজন রসিকতা কিংবা সহানুভূতির ছলে বলেছিলেন, কবিতাগুলো ভালো, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর কোনো এক সময় লেখা হলে ভালো হতো। তাঁরা বইয়ের এক একটি কবিতা নকল আবেগে করুণ কণ্ঠে পাঠ করতে শুরু করলেন এবং কবিতা পাঠ শেষে হাসি-হুল্লোড়ের দমকে পুরো ‘বোস ব্রাদার্স’ কেঁপে উঠছিল। বলাবাহুল্য ম্যানেজারের কাউন্টারে বসে থাকা মালিকপক্ষের ব্যক্তিটি ও রেস্তোরাঁর অন্যান্য গ্রাহকেরা ছিলেন মহাবিরক্ত। কিন্তু এই লম্বাচুলো উঠতি বয়েসী ছেলেগুলোকে ঘাঁটাবে কে? সেদিনের মতো আড্ডা ভাঙার পূর্বমুহূর্তে সবচেয়ে করুণ পরিণতি ঘটেছিল কাব্যগ্রন্থটির। তরুণদের মধ্যে একজন বইটির এক একটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে উপহার হিসেবে এক একজনকে বণ্টন করেছিলেন, এমনকী কয়েকটি পৃষ্ঠা মিষ্টি দোকানের খদ্দেরদের হাতেও দেওয়া হয়েছিল।

এই চিত্রটি আশির দশকের শুরুর দিকের কোনো এক সময়ের। এই পুরো ব্যাপারটিকে খুবই অভব্য, অশিষ্ট আচরণ মনে হতে পারে। কিন্তু আজ এতকাল পরে উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন উহ্য রেখে আমি শুধু সময়ের ছবিটাই তুলে ধরতে চেয়েছি, রুক্ষ বেপরোয়া তারুণ্যের স্মৃতিটা আরেকবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছি।
তখন স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামল চলছে। এই যে তরুণ সাহিত্যকর্মীদের কথা বলছি, তাঁরা তখন নিয়মিত আন্দোলনে-সংগ্রামে, মিছিলে-বিক্ষোভে অংশ নেন, দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করার স্বপ্ন দেখেন, আবার পাশাপাশি কোনো তরুণীর প্রেমে বিভোর নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের। প্রাপ্তি বা প্রত্যাখ্যানের আনন্দ-বেদনায় কলমের কালি (তখনো কম্পিউটারে কবিতা লেখার দিন আসেনি) রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। আবুল হাসানের কবিতায় নিজের ছায়াও দেখতে পায় কেউ কেউ

একহারা শরীর দোহারা জামা
দুহাত যেন দগ্ধ তামা
অভিমানে বাড়ি ফেরো না
সারা দুপুর কোথায় থাকো?
দুপুর ঘুরে কিশোর তুমি বিকেলবেলায়
বাড়ি ফিরলে তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়।
(আবুল হাসান/তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়)
নিজেরাও কখেনা লিখে ফেলেন হৃদয় নিংড়ানো ক’টি পংক্তি

ভালোবাসাহীন শহর গাঁয়ে
ভালোবাসা ছাড়া ঘর কার?
দাও দাও ওকে ভালোবাসা দাও
ভালোবাসা বড় দরকার।
(অজয় দাশগুপ্ত/ছড়া)

কিন্তু ওই যে বললাম, তখন সময়টা ছিল আন্দোলন-সংগ্রামে মুখর, একটা রাগে- ক্ষোভে টগবগ করে ফুটছে তরুণেরা। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, সব ক’টি রাজনৈতিক দল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। লেখকেরাও তখন রাস্তায়। আড্ডার বেশিরভাগ সময় জুড়ে ওই বিষয়েই আলোচনা। বিকেলের দিকে আড্ডায় এসে হয়তো সদ্য লেখা স্বরচিত ছড়া শোনান উত্তম সেন

খুনির আদর সিংহাসনে
গুণির আদর জেলে
করতে গেলে এর প্রতিবাদ
হারায় মা তার ছেলে।

আবার শাহিদ আনোয়ারের কবিতায় সেই সময়টা আসে অন্যরকমভাবে, ছন্দ-অন্তমিল ছাপিয়ে সেখানে অন্য আঙ্গিকে প্রচণ্ড ক্ষোভ ভাষা পায়
বোস ব্রাদার্স রেস্তোরাঁর কাচের এ বহু চেনা পার্টিশন

আমাদের জীবনাংশ
আমি এই ঝাপসা দিয়ে তাকালাম
নাহ, বন্ধুরা কেউ আসছে না।
শুধু কাটা পাহাড়ের গলি থেকে ফিরে আসে, টিংটিং, ফিরে আসে
স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।
… আই হেইট
এই রক্ত পুঁজময়, কালো ফোসকাবৃত
ব্যথায় কঁকিয়ে কাতর এই স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।
রজঃস্রাবের মতো, থুথু ও কফের মতো
কসাই দোকানে দেখা, কাটা মোষের মাথার মতো
ব্যথা-ভারাতুর জোড়া নীলাভ চোখের মতো
এই বাতিল জীবন-
আমরা চাইনি ফেরত পেতে
চাই না ফেরত পেতে।
(আট চল্লিশ ঘণ্টা একটানা হরতালের পর ফিরে পাওয়া স্বাভাবিক জীবন)

আশির দশকে বেশ ক’বছর এক ঝাঁক তরুণ কবি-লেখকদের আড্ডার জায়গা ছিল ‘বোস ব্রাদার্স’। খালিদ আহসান, শাহিদ আনোয়ার, জ্যোতির্ময় নন্দী, অজয় দাশগুপ্ত, ওমর কায়সার, আবু মুসা চৌধুরী, উত্তম সেন, সনজীব বড়ুয়া, আসাদ মান্নান, সেলিনা শেলী, প্রলয় দেব এবং এই নিবন্ধের লেখক ছিলেন এই আড্ডার নিয়মিত শরিক।

এই ‘বোস ব্রাদার্সে’র আড্ডারুরা নানা সময়ে ‘ছড়াকার’, ‘রাইমার্স অ্যালবাম’, ‘দ্রৌপদী’, ‘প্রিয় কবিতার মুখ’ নামের ছড়া-কবিতা ও গদ্যের সংকলন বের করেছেন। বাংলাদেশের প্রথম কিশোর কবিতা সংকলন ‘ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’ প্রকাশিত হয়েছিল এঁদের লেখায়-রেখায়। এ-ছাড়া পাঁচজন কবির কবিতা সংকলন ‘দ্রৌপদীর প্রেমিকেরা’ এবং তারও পর ‘দ্রৌপদীর প্রেমিকেরা ও অন্য একজন’ নামের ছয়জন কবির যৌথ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল এই আড্ডার তরুণদের উদ্যোগেই।

কী আশ্চর্য, খোঁজ নিয়ে দেখি, এই ‘বোস ব্রাদার্সে’ই আরও বহুকাল আগে (পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে) নিয়মিত আড্ডা দিতেন একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী, কথাশিল্পী ও বংশীবাদক সুচরিত চৌধুরী, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফী, সঙ্গীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খান, চিত্রশিল্পী মর্তুজা বশীর, কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, নাজমুল আলম, অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান, মাহবুব হাসান, অনুবাদক ফখরুজ্জামান চৌধুরী, সংস্কৃতি সংগঠক কামাল এ খান, নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক প্রমুখ। কিছু দিন চট্টগ্রামে অবস্থানকালে কবি শহীদ কাদরীও এ-আড্ডায় সামিল হতেন বলে শুনেছি। বয়সে তরুণতরদের মধ্যে কবি ত্রিদিব দস্তিদার, নাট্যকার-নির্দেশক মিলন চৌধুরী ও শান্তনু বিশ্বাসও কখনো হানা দিতেন এই আড্ডায়।

আসলে ‘বোস ব্রাদার্স’ আর সুচরিত চৌধুরীর বাসভবন ‘নিভৃত নিলয়ে’র দূরত্ব ছিল মাত্র কয়েক কদমের। ফলে আড্ডা কখনো সুচরিত চৌধুরীর বাসা থেকে ‘বোস ব্রাদার্সে’ গিয়ে পৌঁছাত, কখনোবা রেস্তোরাঁ ছেড়ে পুরো আড্ডাটাই উঠে আসত বাসায়।

সেই সময়কার সাড়া জাগানো ছোট কাগজ ‘সীমান্ত’ প্রকাশিত হতো মাহবুবুল আলম চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরীর সম্পাদনায় (পরে একটি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর একক সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কিছুকাল)।

কী বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো তাঁদের আড্ডায়? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন পর্যন্ত সময় তো ছিল অগ্নিক্ষরা। আন্দোলনে নানাভাবে অংশ নিয়েছিলেন সারা দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকেরা। ধারণা করি, এই আড্ডায়ও উঠে আসত তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বঞ্চনার কথা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠিত করার ভাবনা ইত্যাদি। তা ছাড়া এসব আড্ডা-আলোচনায় তো নির্দিষ্ট কোনো প্রবাহ থাকে না, কবিতা-নাটক-শিল্প-সাহিত্যের নানা ধারায় তা ছড়িয়ে পড়ত, আবার হয়তো মিলিত হতো এক স্রোতে এসে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রাকৃত
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষার হার শতভাগ করতে কাজ করছে সরকার