কতটুকু পূরণ হলো প্রতিশ্রুতি

মেয়রের এক বছর

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

যৌক্তিক হারে গৃহকর নির্ধারণ, জলাবদ্ধতা নিরসন, খাল-নালা ও নর্দমার নাব্যতা ফিরিয়ে আনাসহ ৩৭ দফা উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি (নির্বাচনী ইশতেহার) দিয়ে নগরপিতার দায়িত্ব নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী। আজ মঙ্গলবার সে দায়িত্বগ্রহণের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। দায়িত্বপালনকালীন সময়ে নিজের প্রতিশ্রুতির কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন মেয়র? এ প্রশ্নই এখন নগরবাসীর। অবশ্য নাগরিকগণ নিজেরাই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাচ্ছেন। তারা বলছেন, কোনো প্রতিশ্রুতিই শতভাগ পূরণ হয়নি। তবে কয়েকটি পূরণে চেষ্টা ও উদ্যোগ ছিল মেয়রের। আবার কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণে দৃশ্যমান পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ অনুযায়ী, ২৮ ধরনের কাজ করার সুযোগ আছে মেয়রের। এর মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নালা-নর্দমা পরিষ্কার, সড়ক মেরামত ও সড়কবাতি নিশ্চিত অন্যতম। এসব কর্পোরেশনের প্রধান কাজ বলেও গণ্য। সেবাগুলো নিশ্চিত করেই শহরের অন্যান্য সযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আসে। এসব সেবা পূরণ হলেই মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকেন নগরবাসীও। কারণ প্রতিবছর নগরবাসী যে পৌরকর পরিশোধ করেন তাতে পরিচ্ছন্ন ও আলোকায়ন রেইটও যুক্ত থাকে। তাই মেয়রের এক বছরের মূল্যায়নে এসব সেবা কতটা পেয়েছেন তা সামনে চলে আসে।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন রেজাউল করিম চৌধুরী। ১১ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন ১৫ ফেব্রুয়ারি। পবিত্র ওমরাহ পালনে গত ১০ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরব গমন করেন নগরপিতা। তাই এক বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে তার স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে যাওয়ার ১৫ দিন আগে ২৭ জানুয়ারি দৈনিক আজাদীর কাছে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দাবি করেছেন, নাগরিক সেবা নিশ্চিতে নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। মেয়রের ভাষায়, দায়িত্ব গ্রহণের পর একশ দিনের অগ্রাধিকার পরিকল্পনা নিয়ে সড়ক সংস্কার, নালা-নর্দমা পরিষ্কার ও মশক নিধনে কাজ করেছেন। এতে সাফল্যও ছিল। পাশাপাশি প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রণয়ন করে প্রেরণ করেছেন মন্ত্রণালয়ে। ইতোমধ্যে চসিকের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্পের অনুমোদনও মিলেছে। এটিসহ অপেক্ষমাণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে নগরে। এছাড়া চসিকের প্রধান কাজগুলো নিশ্চিত করে নগরবাসীর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প ও ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা করা হচ্ছে। এজন্য রেলওয়ে ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। চসিককে সমৃদ্ধ করার জন্যও বিভিন্ন উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে। মেমন মাতৃসদন হাসপাতালকে আধুনিকায়নসহ স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আবদুস সবুর লিটন দৈনিক আজাদীকে বলেন, কাউন্সিলরদের সাথে নিয়ে গত এক বছরে নাগরিক সেবা নিশ্চিতে নানা কাজ করেছেন মেয়র মহোদয়। নিয়মিত প্যাচওর্য়াক করে শহরের ভাঙা রাস্তাঘাট সংস্কার করেছেন। মশার উপদ্রব থেকে রক্ষায় কার্যকর ওষুধ ছিটানো হয়েছে। নালা-নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়েছে। শহর আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। হয়তো শতভাগ সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না। তবে মেয়র মহোদয় এবং বর্তমান পর্ষদের কোনো কাউন্সিলরের আন্তরিকতায় একবিন্দুও কমতি ছিল না।
সাফল্য-ব্যর্থতার চিত্র : মানুষের বাসা-বাড়ি থেকে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহে সাবেক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকালে চালু হয় ‘ডোর টু ডোর ময়লা অপসারণ প্রকল্প’। প্রকল্পটি এখনো আছে। তবে প্রকল্পটি মাঝখানে যে গতি হারিয়েছিল এখনো তা ফিরে আসেনি বলে অভিযোগ আছে নগরবাসীর। তারা বলছেন, শ্রমিকরা নিয়মিত আসে না। বিনামূল্যে সেবাটি দেয়ার কথা থাকলেও অনেক এলাকার বাসা-বাড়ি থেকে টাকা নেয় পরিচ্ছন্নকর্মীরা।
মশক নিধন কার্যক্রম নিয়েও আছে অভিযোগ। এক্ষেত্রে দফায় দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে গতি হারায় ওষুধ ছিটানো কার্যক্রম। তবে ১৮ বছর পর চলতি মাসে ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ শাখাকে সক্রিয় করে সংগ্রহ করা হয়েছে ওষুধ।
নানা অভিযোগ থাকলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গৃহীত একাধিক কার্যক্রমে সাফল্য রয়েছে। মেডিকেল বর্জ্য বিশোধনে চট্টগ্রামে প্রথম ‘ইন্সিনারেটর প্লান্ট’ স্থাপন করা হয়। পরিচ্ছন্ন বিভাগকে ছয় জোনে ভাগ করে গতি বাড়ানো হচ্ছে বিভাগটির। এছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে ষোলশহরের নবীনগরে পাইলট প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, গত এক বছরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে কাঠামোগত পরিবর্তন। এতে কাজে গতি বাড়ছে। মশক নিয়ন্ত্রণ শাখাকে সক্রিয় করেছি। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব গেছে।
সড়ক বাতি : গত এক বছরে নতুন করে কোনো সড়কে আলোকায়ন করা হয়নি। তবে এ সময়ে ৭৫ কিলোমিটার সড়কে পূর্বের এনার্জি বাল্বের পরিবর্তে জাইকার অর্থায়নে এলইডি বাতি লাগানো হয়েছে। এছাড়া ২৬০ কোটি টাকায় ভারতীয় ঋণ সহায়তায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ওয়ার্ডে ১০ কিলোমিটার সড়কে এলইডি বাতি লাগানো হবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) ঝুলন কুমার দাশ বলেন, নগরের ৫৩টি মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি লাগানোর ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে।
সড়ক সংস্কার : প্রায় প্রতিদিনই শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্যাচওয়াকের মাধ্যমে ভাঙা সড়ক সংস্কার কাজ চলছে। অর্থাৎ এখনো শহরের বিভিন্ন সড়ক ভাঙাচোরা অবস্থায় আছে। অবশ্য দায়িত্ব নেয়ার পর মেয়র তার ১০০ দিনের অগ্রাধিকার কর্মপরিকল্পনায় এ কাজকে গুরুত্ব দেন। তখন বেশ কিছুদিন গতিও পায়। পরবর্তীতে তা ঝিমিয়ে পড়ে। এছাড়া পিসি রোডসহ বেশ কয়েকটি সড়কের উন্নয়ন কাজে গতি এসেছে। যেগুলোর উন্নয়ন কাজ সাবেক মেয়রের আমলে শুরু হয়েছিল। এ বিষয়ে জানার জন্য মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে মিটিংয়ে আছেন বলে কোনো বক্তব্য দেননি চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম।
গৃহকর : নির্বাচনী ইশতেহার এবং বিভিন্ন সময়ে গৃহকরা না বাড়ানোর ঘোষণা দেন মেয়র। তবে পৌরকর নির্ধারণে এসেসমেন্টর উপর থাকা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেন মেয়র। দুই দফায় মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেন। সর্বশেষ গত মাসে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। এখন সেটা কার্যকর হলে গৃহকরের বোঝা বাড়বে নগরবাসীর উপর।
জলবদ্ধতা : মেয়রের নির্বাচনী ইশতেহারে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছিল জলাবদ্ধতা। যদিও এ বিষয়ে বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বরং সিডিএ’র সঙ্গে পাস্পরিক দোষারোপে পার হয় গত বর্ষা। এরপর গত বছরের শেষের দিকে বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। তবে এ প্রকল্পটি ২০১৪ সালের। অবশ্য জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান সিডিএ’র প্রকল্পের সুফল নিশ্চিতে মেয়র সমন্বয়ের উদ্যোগ নেন। করেন দফায় দফায় সমন্বয় সভাও। সর্বশেষ মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১ টি খাল খনন নিয়ে প্রকল্প গ্রহণেরও সিদ্ধান্ত নেন। তবে এ বিষয়ে প্রাথমিক কোনো অগ্রগতি নাই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে
পরবর্তী নিবন্ধমীনা বাজারকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা