কক্সবাজার বান্দরবানে বন্যায় পানিবন্দী লাখো মানুষ

বিভিন্ন এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

আজাদী ডেস্ক | বৃহস্পতিবার , ২৯ জুলাই, ২০২১ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে টানা চারদিনের ভারী বর্ষণজনিত পাহাড়ি ঢলে গতকাল বুধবার কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। বৃষ্টিতে বেড়েছে পাহাড় ধসও। দুই জেলার অধিকাংশ গ্রামই এখন বন্যার পানিতে ভাসছে।
পাহাড়ী ঢলে তলিয়ে গেছে লামার বিস্তীর্ণ অঞ্চল
লামা প্রতিনিধি জানান, টানা বর্ষনের ফলে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় তলিয়ে গেছে লামা পৌর এলাকাসহ উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ১০ হাজার মানুষ। লামা-আলীকদম সড়কের একাধিক স্থান বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আলীকদমের সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। পাহাড় ধ্বসে বিভিন্ন স্থানে কাঁচা ঘরবাড়ি বিধস্ত হওয়ার সাথে বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে বিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বন্যার পানিতে প্লাবিত লোকজন বাড়ি ঘর ছেড়ে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নিয়েছে।
জানা যায়, গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের ফলে পাহাড়ি ঢলে বুধবার দুপুর থেকে মাতামুহুরী নদীর পানি অস্বাভািবকভাবে বেড়ে গেলে লামা পৌর এলাকার মাঝি পাড়া, নয়াপাড়া, বাজার পাড়া, উপজেলা পরিষদের আবাসিক এলাকা, লামা বাজার, নুনারবিল, কলিঙ্গাবিল, লামা মুখ, মধুঝিরি, ছাগলখাইয়া, হরিণঝিরি ও শিলেরতুয়াসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়।
লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মজনুর রহমান জানিয়েছেন, বন্যা কবলিত এবং পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে লোকজনকে নিরাপদে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হচ্ছে। উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ৩৯টি অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। লামা পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেছেন, পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ইতিমধ্যে পৌরএলাকার ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। পানি বর্তমান গতিতে বাড়তে থাকলে রাতের মধ্যে আরে ১ হাজার ঘরবাড়ি বন্যা প্লাবিত হবে।
বান্দরবানে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। বুধবারও বন্যার পানিতে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী, ঘুমধুম, সোনাইছড়ি ইউনিয়নে পাহাড় ধস এবং বন্যার পানিতে সড়ক ধসে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে উপজেলাটি। অপরদিকে আলীকদম-চকরিয়া-লামা সড়কের শীলেরতোয়া’সহ কয়েকটি স্থানে বন্যার পানিতে সড়ক ডুবে যাওয়ায় আলীকদম উপজেলার সাথেও দ্বিতীয়দিনের মত সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এদিকে অব্যাহত ভারী বর্ষণে বান্দরবানে সাঙ্গু, মাতামুহুরী, বাকখালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে লামা উপজেলার রুপসীপাড়া’সহ আশপাশের এলাকা এবং বান্দরবান সদরের পুশ্চিম বালাঘাটা, ইসলামপুর’সহ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কোনাক খালের পানিতে ডুবে গেছে মিয়ানমার সীমান্তের কূণ্যরেখায় আশ্রয় নেয়া ঘুমধুমের তুমব্রু কোনাপাড়া রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্রও। অপরদিকে নদী ও খালের পানির স্রোতে ভেঙ্গে ভেসে গেছে নিম্ন আয়ের মানুষের বহু ঘরবাড়িও। নদী তীরবর্তী লোকজনেরা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে।
বান্দরবান মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহাবুবুল ইসলাম জানান, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বুধবার সকালের পর থেকে আরও বেড়েছে। বুধবার সকাল নয়টা পর্যন্ত গতচব্বিশ ঘন্টায় জেলা সদরে বৃষ্টিপাতের পনিমাণ ছিলো ৪৫ মিলিমিটার। তবে উপজেলাগুলোতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হওয়ায় নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির শঙ্কাও বাড়ছে।
এদিকে বুধবার বান্দরবানে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরী ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন সম্মেলনকক্ষে দূর্যোগ ও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জেলা সভা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। জেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্তা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সভায় অংশ নেয়।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন জরুরি সভা করেছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসন সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। বৃষ্টিতে উপজেলাগুলোতে পাহাড় ধসে সড়ক, ঘরবাড়ি এবং বৃষ্টিতে সড়ক ধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পেয়েছি।
কঙবাজারে পানিবন্দি ৭০ হাজার পরিবার
কঙবাজার প্রতিনিধি জানান, বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া আরো ৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে ঈদগাঁও এলাকা থেকে ৩ যুবকের মৃতদেহ বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ার সাড়ে ৭ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয়। এছাড়া বন্যায় ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির মধ্যে উখিয়া থেকে ৩ জন এবং মহেশখালী থেকে আরো ১ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম গতকাল বুধবার বিকেলে জানান, টানা বর্ষণজনিত পাহাড়ি ঢল ও সামুদ্রিক জোয়ারে কঙবাজার জেলার ৪৪টি ইউনিয়নের ৪২৫টি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়েছে। এসব গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার ৩শটি পরিবার পানিবন্দী রয়েছে।
কঙবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী জানান, কঙবাজার জেলার দুই প্রধান নদী বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীর পানি প্রবাহ সাগরে জোয়ার চলাকালে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ জানান, কঙবাজার জেলার ৭১ ইউনিয়নের ৪৪টিই এখন বন্যা আক্রান্ত। এসব বন্যা কবলিত এলাকার দুর্গত লোকজনকে সরকারি তরফ থেকে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবার পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে বুধবারও সামুদ্রিক জোয়ারের পানি উপকূলীয় এলাকার কয়েক ফুট উচ্চতায় আঘাত হানে। এতে সাগরে বিলীন হয়ে যায় সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টের বালিয়াড়ি ও ঝাঁউবাগান।
কঙবাজার আবহাওয়া দপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুর রহমান জানান, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে গত কয়েকদিন ধরেই কঙবাজারে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। এরফলে বঙ্গোপসাগর প্রচন্ড উত্তাল রয়েছে। সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কঙবাজার উপকূলে যে সমস্ত নৌযান চলাচল করে সেসব নৌযানকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদে থেকে মাছ শিকারের কথা বলা হচ্ছে। কঙবাজারে বৃহস্পতিবারও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
চকরিয়ায় পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত ১৮ ইউনিয়ন
চকরিয়া প্রতিনিধি জানান, কয়েকদিনের টানা প্রবল বর্ষণ ও পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভয়াবহ বন্যায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে কঙবাজারের চকরিয়া। এতে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার লোকালয় বানের পানিতে ভাসছে। এই অবস্থায় অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। টিউবওয়েল ও বসতবাড়ির রান্নার চুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট পড়েছে পরিবারগুলোতে। অনেক স্থানে বাড়ির চালা পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুঁটছে হাজারো মানুষ।
এদিকে মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানির প্রবল তোড়ে কয়েকটি স্থানে ভেঙে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধও। এতে চকরিয়ার উপকূলীয় মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে নতুন করে ঢুকে পড়ছে বানের পানি। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় ভয়াবহ পাহাড় ধসের শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
সরজমিন বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলা সদরের সাথে ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সড়কগুলো কয়েকফুট পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। জরুরি প্রয়োজনে মানুষ নৌকায় চেপে যাতায়াত করছে। মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ওপর টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকায় মানুষের মাঝে আতঙ্কও ছড়াচ্ছে। দুই উপজেলার ফসলী জমিও বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকস্থানে ভেসে গেছে পুকুরের মাছও।
সরেজমিন আরও দেখা গেছে, চকরিয়া উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, লক্ষ্যারচর, ফাঁসিয়াখালী, কৈয়ারবিল, হারবাং, বরইতলী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, চিরিংগা, সাহারবিল, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, বদরখালী ইউনিয়নের গ্রামের পর গ্রাম কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গেছে।
কঙবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রবল বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের কন্যারকুম এলাকায় পাউবোর প্রায় ৩০ ফুট এবং কোনাখালী ইউনিয়নের মরংঘোনা পয়েন্টে এক চেইন মতো ভেঙে গেছে। পানি নেমে যাওয়ার পর দ্রুততম সময়ে বেড়িবাঁধ পুনরায় সংস্কার করা হবে।
নাইক্ষ্যংছড়িতে ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি জানান, টানা বর্ষণে বন্যার পানিতে ২ দিন ধরে বন্দি নাইক্ষ্যংছড়ির ২০ হাজার মানুষ। তারা হয় বন্যায় কবলিত নতুবা পাহাড়ি খাল বা ছড়া-ঝিরিতে আটকে গিয়ে ঘরের বাইরে বেরুতে পারছে না। খাবার সংকটে তারা অতি কষ্টে সময় পার করেছে। উপজেলা প্রকল্প কর্মর্কতা মো. মজনুর রহমান জানান, মঙ্গলবার জরুরিভাবে খাদ্য সামগ্রী পাঠানো হয়েছে তাদের জন্যে। বাকি সহায়তা বুধবার জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ পেলে বৃহস্পতিবার থেকে তা বিতরণ করা হবে। এদিকে পানিবন্দি একাধিক কৃষক বলেছেন, তাদের আসাম ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় ৫ ইউনিয়নের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, উপজেলায় অন্তত ২শ স্থানে ছোট-বড় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড় ভেঙ্গে এ পর্যন্ত ধসে পড়েছে ১০টির অধিক ঘর-বাড়ি। সোনাইছড়ি ও ঘুমধুম ইউনিয়নের প্রধান ও সংযোগ সড়কগুলোর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে মঙ্গলবার বিকেল থেকেই।
উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মো. মজনুর রহমান জানান, ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া জরুরি বরাদ্দ তহবিলের কিছু খাবার উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসন বিতরণ করছে। এছাড়া বন্যায় পানিবন্দিদের মাঝে খাবারও বিতরণ করা হচ্ছে।
উখিয়ায় জোয়ারের পানিতে শতাধিক বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত
উখিয়া প্রতিনিধি জানান, আগের দুইদিনের তুলনায় গতকাল বুধবার উখিয়ায় বৃষ্টি খানিকটা কমলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন খাল ও ছড়া বৃষ্টির পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে খাল বিল একাকার হয়ে পড়েছে। শ্রাবণের অঝোর বর্ষণে পাহাড়ী ও টিলা এলাকায় অন্তত শতাধিক কাঁচা ঘর ভেঙে গেছে। গ্রামীণ সড়ক ও ব্রিজ, কালভার্টগুলো ক্ষতির মুখে পড়েছে।
উখিয়ার জালিয়াপালং ও রত্নাপালং ইউনিয়নের পশ্চিম রত্না-পূর্ব পাইন্যাশিয়া রেজুখালের উপর সংযোগ সেতুটি ঢলের পানির তোড়ে ধসে গেছে। পালংখালী ইউনিয়নের থাইংখালী বাজার থেকে তেলখোলা চাকমাপাড়া সড়কে বটতলী এলাকায় এলজিইডি নির্মিত ব্রিজটিও উপড়ে পড়েছে বলে পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান।
উক্ত ইউনিয়নে একজন নিহত হয়েছে এবং প্রায় অর্ধশত ঘর ভেঙে গেছে বলে তিনি জানান। ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়া, রাহমতেরবিল ও বালুখালীতে নাফনদীর জোয়ার স্থানীয় খালগুলো ঢলের পানিতে কয়েকশ একর চিংড়িঘের তলিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
মহেশেখালীতে পানের বরজ ও আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত
মহেশেখালী প্রতিনিধি জানান, মহেশেখালীতে পাহাড়ি ছড়ার ভাঙ্গনে দুই শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত ও ৩শ একর ফসলি জমিতে বালি উঠে নষ্ট হয়েছে পানের বরজ ও আমনের বীজ তলা। রাস্তা ভেঙ্গে লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে গ্রামের অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ। ভারী বর্ষণে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে শতাধিক পরিবার। অপরদিকে টানা তিনদিনের প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি ছড়ার বাঁধ ভেঙে অন্তত ৩শ একর ফসলি জমিতে বালি উঠে আমন বীজতলা ও পান চাষের জমি নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হোয়ানকের বড় ছড়ার মাঝের ঘোনায়। ওই স্থানে ছড়া ভেঙে ২শ ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। মাটি সরে গিয়ে ভেসে উঠেছে মহেশখালী- আনোয়ারা পর্যন্ত স্থাপিত এলএনজি পাইপ লাইন। অরক্ষিত হয়ে পড়েছে সরকারের মেগা প্রকল্প পেট্রোবাংলার এই এলএনজি পাইপ লাইন। এলাকাবাসী আশঙ্কা করছেন ভাঙ্গন কবলিত এলাকার এই পাইপ লাইনে ঘটতে পারে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
স্থানীয় সংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সহায়তা করা হবে এবং জরুরি ভিত্তিতে রাস্তাঘাট মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
রামুতে ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি
রামু প্রতিনিধি জানান, কঙবাজারের রামুতে কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রায় ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৬ হাজার পরিবার। এছাড়া বন্যার পানি সড়কের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় রামুর ঈদগাঁহ-ঈদগড় সড়ক, রামু-মরিচ্যা সড়কসহ বেশ কয়েকটি সড়কে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ফঁতেখারকুল, রাজারকুল ঈঁদগড়, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের অন্তত বিশটি গ্রামের কয়েক হাজার ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন এখানকার মানুষ।
গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান, এবারের বন্যায় গর্জনীয়া ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রাম পানিবন্দী অবস্থায় আছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। এদিকে পাশ্ববর্তী কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের তিতার পাড়া, দোছড়ি, ডিককুল, জামছড়িসহ কয়েকটি গ্রামে বাঁকখালী নদীর পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সাইদুজ্জামান জানান, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ইতিমধ্যেই বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। খাবারের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। অফিসের চর গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক খালেদ শহীদ জানান, রামু সদরের ফঁতেখারকুল ইউনিয়নে ফজল আম্বিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে রামু-মরিচ্যা সড়কটি পানিতে বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে এই ইউনিয়নের অন্তত পাঁচশো পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রণয় চাকমা জানান, উপজেলায় ১১টি ইউনিয়নের পাঁচ থেতে ছয় হাজার পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা কিছু কিছু ইউনিয়নে ইতিমধ্যে চার টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্য ইউনিয়নেও বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে।
রামু-মরিচ্যা আরাকান সড়কের অফিসের চর মূল সড়ক ভাঙন পরিদর্শনে এসে সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, রামুর বেশিরভাগ গ্রাম বন্যায় প্লাবিত। ক্ষতিগ্রস্তদের রান্না করা খাবার বিতরণের প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, পানিতে রামু-মরিচ্যা সড়কের অফিসের চর অংশে বিধ্বস্ত হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সড়কটি পুনঃ সংস্কারের কাজ চালানো হবে। পাশাপাশি পানি নেমে গেলে অন্যান্য এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কও মেরামত করা হবে।
বিপদ সীমায় শঙ্খনদীর পানি
চন্দনাইশ প্রতিনিধি জানান, টানা কয়েকদিনের বর্ষণে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে শঙ্খনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গতকাল সকাল থেকে নদীর পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পানি উপচে বন্যা হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। এদিকে টানা বৃষ্টির কারণে উপজেলার নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ সবজি ক্ষেত ডুবে গেছে। এছাড়া বন্যা হলে পুকুর, মৎস্য খামার ডুবে মাছ ভেসে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। উপজেলার বরুমতি, গুইল্লাছড়ি, যতখালসহ প্রায় খালে পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপচে পড়ছে।
খবর নিয়ে জানা যায়, উপজলার ২টি পৌরসভা দোহাজারী ও চন্দনাইশ এবং ৮ ইউনিয়ন সাতবাড়িয়া, বৈলতলী, বরমা, বরকল, হাশিমপুর, ধোপাছড়ি, কাঞ্চনাবাদ, জোয়ারার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন এলাকায় বসত বাড়ি নির্মাণ করার কারণে পানি প্রবাহিত হতে না পেরে গ্রামীন রাস্তাঘাটেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় জনদুর্ভোগ বেড়েছে। অনেক এলাকায় রোপা আমনের বীজতলা তলিয়ে গেছে। বরুমতি খাল খননের পর থেকে বিভিন্ন অংশে ভাঙনের কারণে বেশ কয়েকটি বসতঘর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে বলে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে।
এদিকে শঙ্খনদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরে উৎপাদিত কৃষকের অধিকাংশ সবজি ক্ষেত পানির নীচে তলিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। সাতবাড়িয়া যতরমুখ এলাকার মাহাবুবুল আলম রিপু জানান, বৃষ্টি না থামলে তার ২টি পুকুর তলিয়ে মাছ ভেসে যাবে। শঙ্খচরের কৃষক মোজাম্মেল জানান, নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরের নিচের সারিতে চাষকৃত মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, ঝিঙা, চিচিংগা, ঢেঢ়শ, বরবটি ক্ষেত তলিয়ে গেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকঠোর বিধিনিষেধ, তবুও মহাসড়কে যানজট
পরবর্তী নিবন্ধআসামি সাবেক ডিসি এডিসি পৌর মেয়রসহ ৪০