দশ বছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা এস এস সি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণসহ জীবনের বহুমূখী অভিলক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য এস এস সি পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র ছাত্রীরা প্রথম একাডেমিক সনদ অর্জন করে। শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে পাশের হার পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও ২০২২ সালের এস এস সি পরীক্ষায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির যে তথ্য পাওয়া গেছে তা রীতিমত আশঙ্কাজনকতো বটেই, উদ্বেগজনকও। বিশেষ করে কোভিড পিরিয়ডের পরবর্তী এস এস সি পরীক্ষা হওয়ার কারণে নাকি এর পেছনে অন্যকোনো রহস্য লুকায়িত আছে তা শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ভাববার সময় এখনই। তা যদি না হয়, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বড় অংশ শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ছিটকে পড়বে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই-যা জাতির জন্য অশনি সংকেত।
২০২০ সালের পরীক্ষা যথাসময়ে সমাপ্ত হওয়ার পরেই করোনা ভাইরাস সংক্রমনের কারণে ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধাপে ধাপে প্রায় ১৮ মাস একটানা বন্ধ থাকে। ২০২১ সালের এস এস সি পরীক্ষা নির্ধারিত ফেব্রুয়ারী মাসের পরিবর্তে ১৪ নভেম্বর-২০২১ থেকে তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে এ বছরের (২০২২ সাল) এস এস সি পরীক্ষাও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের পরীক্ষায় আইসিটি, বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা এই তিন বিষয়ের পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে না। পরীক্ষার্থীরা এখন ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছে। শিরোনামের আলোচ্য বিষয়ের মূল বক্তব্য অর্থাৎ এবারের (২০২২ সাল) পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২৪ সেপ্টেম্বর-২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিত পদার্থ বিজ্ঞান (তত্ত্বীয়), বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং তিন বিষয়ের পরীক্ষায় ১ হাজার ৮৬৪ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। এবারের এস এস সি পরীক্ষায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করার জন্য ফরম পূরণ করেছে। উক্ত তথ্যের আলোকে আরো জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় ১২৫ কেন্দ্রে ১ লাখ ১ হাজার ৫৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে অংশ নেয় ৯৯ হাজার ৭৬০ জন। অনুপস্থিত ছিল ১ হাজার ২৯৪ জন। কঙবাজারে ২৯টি পরীক্ষা কেন্দ্রে ২২ হাজার ৫২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে অংশ নেয় ২১ হাজার ৭৫৬ জন এবং অনুপস্থিত ছিল ২৯৬ জন। রাঙামাটি জেলায় ২১টি পরীক্ষা কেন্দ্রে ৭ হাজার ৭৩ জনের মধ্যে অংশ নেয় ৭ হাজার ১ জন। অনুপস্থিত ছিল ৭২ জন পরীক্ষার্থী। খাগড়াছড়ি জেলায় ২৩টি পরীক্ষা কেন্দ্রে ৮ হাজার ১১৬ জনের মধ্যে অংশ নেয় ৭ হাজার ৯৮৭ জন এবং অনুপস্থিত ছিল ১২৯ জন পরীক্ষার্থী। এছাড়া বান্দরবান জেলায় ১৫টি পরীক্ষা কেন্দ্রে ৪ হাজার ৫৮৫ জনের মধ্যে অংশ নেয় ৪ হাজার ৫১২ জন। অনুপস্থিত ছিল ৭৩ জন পরীক্ষার্থী। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ২১৩টি পরীক্ষা কেন্দ্রে মোট অনুপস্থিত ছিল ১ হাজার ৮৬৪ জন পরীক্ষার্থী। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১২টি বিষয়ের মধ্যে ১১টি বিষয়ের পরীক্ষায় গড়ে অনুপস্থিত ছিল ১ হাজার ৪২৭ জন। অর্থাৎ, কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের পর ১টি বিষয়ের পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকার অর্থ হল ঐ পরীক্ষার্থী পরবর্তী বিষয়ের পরীক্ষায় আর অংশ নেবে না। ফলশ্রুতিতে নিশ্চিতভাবে এবছর অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীদের তালিকা দীর্ঘ হবে, পাশের হার কমবে।
করোনার পূর্বে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের এস এস সি পরীক্ষায় গড়ে অনুপস্থিত ছিল ৩৮৬ জন। করোনাকালীন ২০২১ সালের এস এস সি পরীক্ষায় গড়ে অনুপস্থিত ছিল ২ হাজার ৪৪২ জন। তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালের এস এস সি পরীক্ষায় অনুপস্থিতি বেড়েছে ৫৩২ শতাংশ এবং ২০২২ সালে প্রায় ২৭০ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে পাঁচগুণ এবং চলতি ২০২২ সালের পরীক্ষায় আড়াইগুণের বেশি অনুপস্থিতি বেড়েছে (দৈনিক পূর্বকোণ, ২৫ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টো ২২ এর রিপোর্ট)। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, দেশের অন্যান্য শিক্ষাবোর্ডেও এবছরের এস এস সি পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী অনুপস্থিত রয়েছে। অনুপস্থিতির পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কী কী কারণে অনুপস্থিতি বেড়েছে তার সঠিক তথ্য পেতে হলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে বৃহত্তর পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এর পরেও এতদ্সংক্রান্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ সংশ্লিষ্টদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল।
১. দেশে করোনার মহামারি অনেকটা কমে আসলেও এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়েছে এবারের এস এস সি পরীক্ষায়। করোনার আগে অনুষ্ঠিত এস এস সি পরীক্ষার সাথে বর্তমান এস এস সি পরীক্ষার তুলনা করলে তা স্পষ্ট দেখা যাবে।
২. ২০২২ সালের এস এস সি পরীক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ ছিল ২০২০-২০২১। অর্থাৎ, ৯ম-১০ম শ্রেণির পড়ালেখার মূল সময়টা তারা করোনার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল।
৩. শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ সারা বছর পড়ালেখা না করে অটোপাশের আশায় ফরম পূরণ করেছে। আনুষ্ঠানিক পরীক্ষায় বসার মত কোনোধরনের প্রস্তুতি ছিল না বিধায় তারা পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেনি।
৪. নির্বাচনী (টেস্ট) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ/পাস করার ব্যাপারে করোনা সংক্রমনের আগের মত সরকারি ঘোষণা/বাধ্যবাধকতা না থাকায় হাজিরা খাতায় নাম থাকা সাপেক্ষে সকলস্থরের ছাত্র-ছাত্রীরা এস এস সি পরীক্ষার ফরম পূরণ করার সুযোগ পেয়েছে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় (২০২৩ সাল) এস এস সি পরীক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ/পাশ করার বিষয়টিও এখনো পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট করেনি। পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিত থাকার অন্যতম একটি কারণ এটি।
৫. করোনার কারণে যেহেতু শিক্ষাকার্যক্রম দীর্ঘ সময় ব্যাহত হয়েছিল, তাই শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে।
৬. করোনাকালীন সময়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য অনেক দরিদ্র পরিবারের ছাত্ররা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। ঐ সকল ছাত্ররাই আবার এস এস সি পরীক্ষার ফরম পূরণ করার সুযোগ পেয়েছে। বাস্তবে তারা পড়ালেখা করে নি বিধায় পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল।
৭. সামাজিক অনগ্রসর চিন্তার কারণে করোনাকালীন সময়ে অনেক ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। তারাই আবার অটো ফরম পূরণ করার সূযোগ পেয়েছে। পরীক্ষার প্রস্তুতি ছিল না বিধায় তারা পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল।
দক্ষতার সাথে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে এখনো আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের ডিজিটাল বা অনলাইন বেইজড শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি যুগোপযোগী একটি পদক্ষেপ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের সর্বত্র সুযোগ না থাকা, ডিভাইস সংগ্রহ করার সামর্থ্য না থাকা, যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঠিক নজরদারির অভাব ইত্যাদি নানা কারণে সবাই ডিজিটাল পদ্ধতির শিক্ষার সে সুযোগ পায়নি বা পাচ্ছে না। শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তি কার্যকর করতে হলে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা আরো গতিশীল করতে হবে। করোনার পর শিক্ষার্থীদের যে ঝরে পড়া শুরু হয়েছে, তা এখনই থামাতে হবে। শিক্ষার্থীদের এই ঝরে পড়ার হার কিভাবে কমানো যায়, আমাদের নীতি নির্ধারকদের সে বিষয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ত করে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে খুব শিঘ্রই।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, উরকিরচর উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম।