কবিগুরু আসলে এক ‘অবসেশন’ ভয়ঙ্কর মোহ! চুম্বকও! বাংলা সাহিত্যের সব শাখাসহ সঙ্গীতকেও এমন এক অবস্থানে তুলে এনেছেন- যা এখনও কেউ ‘ওভারটেক’ করতে পারেননি। পারবেন কিনা সন্দেহ প্রচুর। তাঁকে বিশ্বকবি বা সাহিত্য-সঙ্গীতের সীমানায় আটকে রাখা একদম বোকামো। তিনি আসলে ক্ষণজন্মা সর্বজ্ঞ মহানসাধক। বাংলার বিশাল সৌভাগ্য, সাধকটিকে স্রষ্টা বাংলাভাষার সেবায় লাগিয়েছেন। পশ্চিমা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে বাংলাকে সংযুক্ত করার হাইওয়ে তৈরি করে গেছেন তিনি। নিজের লেখা বাংলা গানকে পশ্চিমা জনপ্রিয় সুরের সাথে মিশিয়ে সুর সংযোজন করে অদ্ভুত ভাললাগার দ্যোতনা এনে দিয়েছেন। যত শুনবেন তত আবিষ্ট হবেন, ভাল লাগার ঘোর মিশে যাবে রক্তের কোষে-কোষে। কী এক যাদু!
এ-কলামে কখনো সাহিত্যচর্চা হয়নি আমার, হবেওনা। আসলে মন খারাপ বা এলোমেলো হলেই এখনো ভরসা কবিগুরু। গান-সাহিত্য সবকিছু নিয়েই। অন্য কারো বই বা গানে কোনভাবেই স্বস্তি মেলে না। এখন মজে আছি তাঁর ‘গল্প গুচ্ছ’ নিয়ে। যত পড়ি, তত নতুনভাবে আবিষ্কৃত হন তিনি। নিজেও গল্প-টল্প লিখি, কিন্তু কত আর্বাচিন ও নবীশ ভাবতে গেলেই লজ্জা পাই। সামান্য উদাহরণ-“আমি তামাকটা পর্যন্ত খাই নে। আমার এক অভ্রভেদী নেশা আছে, তারই আওতায় অন্য সকল নেশা একেবারে শিকড় পর্যন্ত শুকিয়ে মরে গেছে। সে আমার বই পড়ার নেশা। আমার জীবনের মন্ত্রটা ছিল এই-
‘যাবজ্জীবেৎ নাই বা জীবেৎ-ঋণং কৃত্বা বহিং পঠেৎ’। আমি ফেল করা ছেলে বলে আমার এক মস্ত সুবিধে এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়ার বিদ্যার তোলা জলে আমার স্নান নয়- স্রোতের জলে অবগাহনই আমার অভ্যাস।”
না, উদ্ধৃতি আর নয়। বড় বড় দেশি-বিদেশি ডিগ্রি বা ডক্টরেটধারীরা বিরক্ত হতে পারেন। উদ্ধৃতিটি ‘পয়লা নম্বর’ গল্পের শুরু এবং তৃতীয় অনুচ্ছেদের। তোলা জলে স্নান করা বিদ্যা বা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বুঝতে এইটুকুনই যথেষ্ট।
‘ভয়ঙ্করের ভাপ-কাঁধেই’ শিরোনামের গত লেখাটি পড়ে কেউ কেউ আতঙ্কিত হয়েছেন। জানানও দিয়েছেন। কিন্তু আমিতো ‘হুইশেল ব্লোয়ার’ মাত্র। বিদেশি গবেষণাতথ্য পরিবেশন করেছি। ফলোআপ তো কিছুই হয়নি। দেশ কাঁপানো অনুসন্ধানী আইটেম হওয়ার রসদ তো ছিলই। মিডিয়া বা সংশ্লিষ্ট পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো চুপ থাকলে কার কী করার আছে? আসলে মৃত্যু যতক্ষণ না আমাদের কব্জা করছে, ততক্ষণ মৃত্যুর কথা আমরা ভুলেও মনে রাখি না। শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার আগে ভোগবাদী কোন মানুষ মৃত্যুকে পাত্তাই দেয় না। এটা মাফিয়া কর্পোরেট ও ভোগবাদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। দেশ, মানুষ বাঁচুক বা মরুক আমার কী? ‘আমিই বাঁচবো-ভোগ করবো, ব্যাস!’ শুনতে যত নিষ্ঠুর হোক, এটাই আমাদের নীতি ও আদর্শ, বাকি সব ফেনা। ধর্ম-কর্ম, নীতিকথা সবই। দান-অনুদানের বিশাল মিডিয়া প্রদর্শনীও। না হলে কেন এমন হবে! ‘সব ভালকে আমরা কথা ও বচনের সীমানায় আটকে রেখেছি, কর্ম বা চর্চায় একদম না। যার যত প্রভাব, ক্ষমতা, ধন, প্রতিপত্তি তার ব্যাক্তিস্বার্থের সীমানা তত মজবুত। কিন্তু সন্তুষ্টি নেই, ধন সম্পদের পাহাড় আরো উঁচু করতে ভারী ব্যস্ত তিনি। এই ‘মহৎ কাজে’ নীতি- নৈতিকতা পাত্তাই পায় না! ফলে অন্যায়, অবিচার, অনিয়মের ক্লেদ শুধুই ভারী হচ্ছে। ত্যাগ বলতে আমরা বুঝি, শরীরের বর্জ্য ত্যাগ। এটাও ঠিক, বর্জ্য ত্যাগও মাঝে মাঝে বড্ড ক্লেশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন ক্ষমতাধর হাড়ে-হাড়ে বোঝেন, বাজে ত্যাগটাও বড়ই যন্ত্রণার। শুধু ভয়াল পলিথিন রাক্ষস না, ভেজাল খাদ্য পণ্যেও ডুবে আছে দেশ। অবিশ্বাস্য হলেও নিষ্ঠুর সত্য, সবচেয়ে বেশি ভেজাল হচ্ছে, দামি শিশুখাদ্য ও চেইন ফুড সেন্টার বা ফুডকোর্টে। কারণ ব্রান্ড পণ্যগুলোর মালিকেরা প্রচন্ড প্রভাবশালী। প্রশাসন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটি অংশ, তাদের খুঁটিতে বাঁধা থাকে। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এমন দুষ্ট নজির অবিশ্বাস্য। কিন্তু আমরা নির্বিকার! খাচ্ছি-দাচ্ছি, বেড়াচ্ছি, মজা করছি। আসলে ‘না-তি, খা-তি বেলা যায়’– এই ফাঁকে ঘাড় মটকাতে ধীরে-ধীরে এগুচ্ছে অমোঘ নিয়তি…