বেদনার আনুষ্ঠানিকতা

অনুপ সাহা | সোমবার , ৪ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

‘গত পঞ্চাশ বছর আমরা একসাথে চলেছি। একাধিক সংগঠনে একসাথে কাজ করেছি। জীবন-যাপন করেছি অনেকটা একান্নবর্তী পরিবারেরর মতো। এখন, এই ছয়ষট্টি বছর বয়সে এসে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়েছি- ওদের ছাড়া কি আর এক পা’ও এগুতে পারব?’ কবি ও নাট্যজন শিশির দত্তের এই আবেগঘন অনুভূতিতে হলভর্তি বেদনার্ত দর্শক-শ্রোতা সত্যি সত্যি অশ্রুসজল হয়। শিশির দত্তের বক্তৃতার পর শ্রেয়সী মজুমদার গান ধরেন- রবীন্দ্রসঙ্গীত- ‘বড় বেদনার মতো বেজেছ হে তুমি আমার প্রাণে…’
নিবিষ্ট হয়ে গানটি শুনছিলাম। কিন্তু একেবারে শেষে এসে শ্রেয়সী যখন গেয়ে ওঠে -‘এ জন্মের মতো আর হয়ে গেছে যা হবার, /ভেসে গেছে মন প্রাণ মরণ টানে।’
তখনই নিমজ্জিত বেদনার আবেগ থেকে আচমকা জেগে উঠে কীরকম একটা বাস্তব-বোধ হয়- সত্যিইতো যা হবার তা তো হয়ে গেছে, মরণতো সবকিছুর পরিসমাপ্তি টেনেছে। তাহলে এসব আনুষ্ঠানিকতা কি অর্থহীন!
এর আগে সঙ্গীতগুরু, চট্টগ্রামের প্রাচীন সঙ্গীত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘সঙ্গীত ভবন’-এর অধ্যক্ষা এবং প্রখ্যাত শিল্পী কাবেরী সেনগুপ্তা গেয়েছেন- রবীন্দ্রসঙ্গীত-
‘ওকে কেন কাঁদালি ও যে কেঁদে চলে যায় /ওর হাসিমুখ যে আর দেখা যাবে না।/…আর বুঝি তার সাড়া পাবে না।’
কাবেরী সেনগুপ্তার গায়কী দর্শকদের বেদনা-ভারাক্রান্ত হৃদয়কে আরও আবেগাপ্লুত করে।
এ-সবই হচ্ছিল গত ১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী নাট্য-সংগঠন- অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়-এর ৪৮তম (জন্ম ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রারম্ভিক- ‘স্বজন ও সতীর্থদের শোকার্ত বিদায়-আছে দুঃখ আছে মৃত্যু…’ অনুষ্ঠানে।
শিল্পী খালিদ আহসান (১৯৫৭-২০২১), আবদুস সালাম আদু (১৯৫৯-২০২১), সুব্রত বড়ুয়া রনি (১৯৫৫-২০২১) অরিন্দম-এর এই তিন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব প্রয়াত হয়েছেন- পর পর এ-বছরের মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে। তাঁদের স্মরণে এই আয়োজন। করোনার আতঙ্কের মধ্যেও শিল্পকলা একাডেমির প্রায় হলভর্তি দর্শক।
শিল্পী খালিদ আহসানকে নিয়ে কিছু বলার দায় বর্তেছে কবি ওমর কায়সারের উপর। ওমর কায়সার তাঁর চমৎকার উপস্থাপনায় খালিদ আহসানকে এঁকেছেন অনেকটা এভাবে – ‘কবি খালিদ আহসানের শব্দরা যখন ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, তখন শিল্পী খালিদ আহসান রং-তুলি নিয়ে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ান, শিল্পী খালিদ আহসানের তুলি যখন ক্লান্ত হয়, তখন তিনি সঙ্গীত-রচনা করতে বসেন, সঙ্গীতের শব্দরা যখন থেমে যায়, তখন খালিদ আহসান প্রচ্ছদ আঁকাতে নিমগ্ন হন।’
খালিদ আহসান সম্পর্কে এরকম অসামান্য উক্তি কেবল কবি ওমর কায়সারই করতে পারেন, তাঁর অন্তরের আন্তরিকতার প্রকাশভঙ্গির কারণে।
কিন্তু দর্শকরা চমৎকৃত হয় এটা জেনে যে- সত্তরের দশকের শেষ প্রান্তে ঢাকায় ওমর কায়সারের উপস্থিতিতে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ প্রায় দুই ঘণ্টা ধরনা দিয়ে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে, দুপুরের খাওয়া খাইয়ে তাঁর একটি বইয়ের প্রচ্ছদ করে দিতে সম্মত করান খালিদ আহসানকে। ততদিনে খালিদ আহসান তাঁর সম্পাদনায় লিটল-ম্যাগাজিন ‘চোখ’-এর প্রচ্ছদের জন্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছেন।
খালিদ আহসান বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। সামগ্রিক জীবন-যাপনে একজন পরিপূর্ণ শিল্পী, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও। এক্ষেত্রে খালিদ আহসানকে এই শহরের অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব বলা যায়। খালিদ আহসানের স্ত্রী আইভি হাসান প্রাতিষ্ঠানিক-শিক্ষায় শিক্ষিত চারুশিল্পী। অনুষ্ঠানে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আইভি শিল্পী খালিদ আহসানের নির্লোভ-নিরহঙ্কারী-নিভৃতচারী জীবনের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করে, খালিদ আহসানের কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
খালিদের সাথে আমার টেলিফোনে খুব যোগাযোগ ছিল এমন নয়। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ খালিদের ফোন- ‘অনুপদা আপনি নাকি একটা লেখা লিখেছেন? আইভি পড়েছে, আমি পড়িনি। আমাকে ইনবঙে পাঠান। করোনাকালে- নাই কাজতো খই ভাজ- কত মানুষ যে লেখক (?) হয়ে উঠেছে! আমিও সামান্য একটু আছি সেই তালিকায়।
বিশ সালের অক্টোবরের শেষার্ধ থেকে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ‘ওয়াহিদ ভাই- এক পলক’ শিরোনামে একটি লেখা ১৬ পর্ব লিখে অর্ধেক পরিমাণ শেষ করেছি, বাকিটা এখনও পড়ে আছে।
এটি ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন, নালন্দাসহ আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের প্রধান-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হককে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা। খালিদ সেই লেখাটির কথাই বলছিলো। পাঠিয়েছিলাম তাঁর ইনবঙে। সে পড়েছে জেনেছি। কিন্তু তাঁর মন্তব্য জানা হয়নি। তারপরপরইতো খালিদ অসু্‌স্থ। খালিদ হাসপাতালে। খালিদ নেই।
কবি শিশির দত্ত মূলত দায়িত্বপ্রাপ্ত হন- আবদুস সালাম আদুকে নিয়ে বলবার জন্য। তিনি খালিদ আহসানকে নিয়েও দুএক কথা বলেন। মূলত বলেন, আবদুস সালাম আদুকে নিয়ে। বলেন- ‘আবদুস সালাম আদু চট্টগ্রামের এক পরিচিত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতে আদুর আগমন কি বড়লোকের সন্তানের সৌখিনতা? না, আদু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তার একাগ্র কর্মতৎপরতা দিয়ে প্রমাণ করেছে- বাঙালি সংস্কৃতির পরিমন্ডলটি তার সৌখিনতা নয়; ভালোবাসার অঙ্গন। সাংস্কৃতিক জগতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়া আদুর একটি ‘পারিবারিক-বিপ্লব’। আবদুস সালাম আদুর পিতা জাকির হোসেন কন্ট্রাক্টর নামে চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। তাঁর তত্ত্বাবধানে সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) ভবনটি নির্মিত হয়। আদু অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে দুই বাংলার নাট্য-উৎসবের আয়োজন করে। আদু চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। সঙ্গীত ভবন-এর সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। কোলকাতার নাট্য জগতেও আদুর বিচরণ ছিল নিয়মিত।’ কবি শিশির দত্ত আবদুস সালাম আদুর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বিচরণের বর্ণনা দেন বিস্তারিতভাবে, অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে, তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। আমিও আবদুস সালাম আদুর সাথে পনের বছর বর্ষ বিদায় ও পহেলা বৈশাখের দুইদিনব্যাপী সান্ধ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আদুর বিস্তৃত পদচারণা এবং দক্ষতা চাক্ষুস করেছি।
আমরা সবাইতো নিজেদের দৈনন্দিন সহজ কাজগুলো নিজেরাই সামলাই। কিন্তু যেই কাজটি জটিলতায় পড়ে আটকে গেছে, সেই জটিল কাজটি সামাল দেবে কে! আদু! সেটি কারও ব্যক্তিগত হোক, সামাজিক হোক, কিংবা সাংস্কৃতিক অঙ্গন-সংশ্লিষ্ট হোক। এই ব্যাপারটি শুধু কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; সেটির পরিসরও বেশ বিস্তৃত।
সঙ্গীত এবং বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে পাঠও চলছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু-ভাবনা নিয়ে নানা রচনা থেকে পাঠ করছিলেন, অরিন্দমের তিন সু-অভিনেত্রী – সিরাজাম মুনিরা স্বর্ণা, কঙ্কন দাশ এবং সাবিরা সুলতানা বীণা।

সুব্রত বড়ুয়া রনিকে নিয়ে বলেছেন সাংবাদিক আবুল মোমেন।
‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’ শিরোনামের লেখাটি সুব্রত বড়ুয়া রনির নিজের বয়ান, শ্রুতিলিখন করেছেন শাহরিয়ার আদনান শান্তনু। লেখাটি ২০১১ সালে আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে; সেটিরও উল্লেখ আছে। লেখাটিতে নিজের বয়ানে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ১৯৭২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত সুব্রত বড়ুয়া রনির বিভিন্ন কার্যক্রমের বিস্তৃত বর্ণনা আছে। ১৯৭২ সালে ‘প্রান্তিক শিল্পী গোষ্ঠী’, ‘প্রান্তিক(লিটল ম্যাগ)’, ‘সুরেলা’ হয়ে ‘সোলস্‌’, ১৯৭৬ সাল থেকে অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়, ১৯৭৭ সালে ‘সৈকতচারী’, ১৯৭৮ সালে ডিসি হিলের প্রথম পয়লা বৈশাখ উদযাপন, ২০০০ সাল থেকে ‘বাংলা বর্ষ বিদায় ও বরণ সম্মিলন পরিষদ’ থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞার পূর্ব পর্যন্ত একাদিক্রমে ষোল বছর বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণ অনুষ্ঠান, চারুশিল্পীদের ‘চট্টগ্রাম চারুশিল্পী সম্মিলন পরিষদ’, ফ্যাশন ডিজাইনারদের ‘ডিজাইনার্স ফোরাম’, ‘চট্টগ্রাম মিউজিক ব্যান্ড এসোসিয়েশন’ -এর সভাপতিত্ব, নিজের ডিজাইনিং হাউজ ‘ডিজাইনার্স ডেন’ – এতগুলো সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে, সুব্রত বড়ুয়া রনি।
‘সৈকতচারী’ থেকে শুরু হয়ে শেষ দিন পর্যন্ত একসাথে কাজ করতে গিয়ে বন্ধু সুব্রত বড়ুয়া রনির সাংগঠনিক দক্ষতা তো আমি চাক্ষুস করেছি।
সুব্রত বড়ুয়া রনির স্ত্রী মিতা বড়ুয়া অনুভূতি জানাতে মঞ্চে উঠে স্বাভাবিকভাবেই খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে প্রায় কিছুই প্রকাশ করতে পারছে না। কারণ এই শিল্পকলা একাডেমিইতো তার সদ্য-প্রয়াত স্বামীর কর্মযজ্ঞের প্রিয় অঙ্গন।
না বলতে বলতে রণি সম্পর্কে মোক্ষম কথাটি সেই বলল- ‘আজ এই অনুষ্ঠানটি যদি রনির তত্ত্বাবধানে হতো, তাহলে এর প্রতিটি ইঞ্চি থাকত রনির কঠোর নিয়ন্ত্রণে।’
রণি সত্যিই ভীষণ খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছিল। সামান্য পরিমাণ ত্রুটিও রনির চোখ গলতে পারতো না।
(২)
অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছেন – কবি আবসার হাবীব এবং শ্যামলী মজুমদার।
খালিদ আহসান, আবদুস সালাম আদু, সুব্রত বড়ুয়া রনি – তিনজনই কবি আবসার হাবীবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবসার হাবীবের ‘তিন বন্ধু’ শিরোনামের কবিতাটি বন্ধু হারানোর তীব্র অনুভূতির প্রকাশ। কবিতার কয়েকটি লাইন এরকম-

তিনবন্ধু হেঁটে হেঁটে চলে গেল/আমরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম/চোখ ঝাপসা হয়ে আসে/কোথাও আলো দেখি না।/…ওরা তিনজন আমাদের বিশাল আকাশে/মেঘ হয়ে পাখি হয়ে আমৃত্যু/উড়ে উড়ে জানান দেবে/আমরা আছি /আমরা থাকবো তোমাদের সাথে…
শ্যামলী মজুমদারও তাঁর কবিতাটি লিখেছেন তিন বন্ধুর মৃত্যুর পর-
কাঁচঘরে রয়েছে তোমার পুতুল-/শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর/মাঝেমধ্যে বরফ জমাট, শীত ভয়াবহ/উষ্ণতার জন্য কাড়াকাড়ি/নিজেদের কাপড় ভাগাভাগির/ভয়ে পিনপতন নীরবতা, /তোমাকে দেখতে যাবো-/ভেবে আজ উল্লসিত নদী,/জল নেই সমুদ্রে, বান নেই../তীব্র হাওয়া শন্‌ শন্‌/ওঁৎ পেতে আছে-/মানুষ ধরবে আজ সে!/কাঁচঘরে বন্দী সমুদ্রতীর/ক্ষণজীবী উল্কা বালির বুকে/মৃতপ্রায় মৃত্যু নিমজ্জিত ছুটির ঘুমে/বিদীর্ণ জীবন আর তার বিচ্ছুরিত আলোকণা/চোখে এসে লাগে বড়ো-/ভাতঘুমে এসব গল্প শুরু হলো,/সবেমাত্র হাওয়া শন্‌ শন্‌/ভেসে যেতে ইচ্ছে হয় খুব-/কাঁচঘরে কাঁকড়ার কড়কড় শব্দ/তীব্র বাজ পড়লো দূরে কোথায় ও/ভাতঘুম ডাকে আয়/বিপন্ন মৃত্যু ডাকে আয়/বরফ জমাট কাঁচঘর/সেও ডাকে আয় আয় …/চলো তবে, ঝরে যাওয়ার আগে/মেঘেদের কানে কানে রেখে যাই/কিছু ক্ষত্রিয় কথা আর নক্ষত্রের উত্তাপ/তীব্র বাজ পড়েছে কোথাও আবার।
শ্যামলী মজুমদারের কণ্ঠে কবিতার চমৎকার পাঠ শুনলাম। অনেকদিন এরকম পাঠ শোনা হয় না।
অরিন্দমের সভাপতি আকবর রেজা সকলকে ধন্যবাদ জানাতে মঞ্চে এলেন। তাঁর কাছে জানা গেল, আবদুস সালাম আদু দু’টি নাটক লিখে তাঁকে পাঠ করতে দিয়েছিলেন। তিনি পাঠও করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো আর মঞ্চস্থ করা হয়নি।
স্মরণ অনুষ্ঠানের সভাপতি কমল সেনগুপ্ত বলছিলেন- ‘এঁরা সবাই ছিল আমার চার-পাঁচ বছরের ছোট, অনুজ-প্রতীম বন্ধু। কিন্তু তাঁরাই ছিল আমার সামাজিক-শক্তির উৎস।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রফেসর অনুপম সেন বলেন – ড. আনিসুজ্জামান আমার সরাসরি শিক্ষক না হলেও তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে শিক্ষকতাও করেছি। এবার করোনাকালে তাঁকে হারিয়েছি। হারিয়েছি কামাল লোহানি, আবুল হাসনাত, শামসুজ্জামান খান, অরুণ দাশগুপ্তসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে। এ-বছর মে মাসে স্ত্রী-বিয়োগের কথা বলতে গিয়ে অনেকটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ড.অনুপম সেন-এর স্ত্রী বার বছরের অধিক কাল অর্ধ-অচেতন অবস্থায় চিকিৎসাধীন থেকে এ-বছরের মে মাসে পরলোক গমন করেন।
তিনি মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন বয়সের ভিন্ন ভিন্ন মৃত্যুভাবনার উদ্ধৃতি দেন। বলেন- একদম তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু নিয়ে লিখলেন- ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান..’। ড. সেন বলেন- মানুষের যত বয়োঃপ্রাপ্তি হয়; ততই মানুষের মৃত্যুভাবনা বদলাতে থাকে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন বয়সের মৃত্যুভাবনার রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিতে থাকেন। বলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৪৬ বৎসর বয়সে ১৯০৭ সালে বিহারে তাঁর ছোট ছেলে শমীন্দ্র ১৩ বছর বয়সে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ছোট ছেলের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ মনে ভীষণ আঘাত পান। ছেলের মৃত্যুর পর ট্রেনে কোলকাতা ফিরবার পথে বাইরে জ্যোৎস্নালোকিত সন্ধ্যা অবলোকন করে রবীন্দ্রনাথ লিখেন- ‘আজি জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…’। রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন- এত সুন্দর জ্যোৎস্না অথচ আমার ছেলেটি হারিয়ে গেল। সে তো আর ফিরে আসবে না…। ড. অনুপম সেন মৃত্যুভাবনা নিয়ে মিল্টনের ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ থেকেও বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়েছেন। শুনছিলাম আর ভাবছিলাম- এই একাশি বছর বয়সেও কী অসাধারণ স্মৃতি-শক্তি তাঁর। বিশ্ব জ্ঞান-ভাণ্ডার যেন তাঁর মাথায় ধারণ করা আছে!
দীর্ঘদিন পঞ্চগীতিকবির গানসহ বিভিন্ন আঙ্গিকের বাংলা গান গেয়ে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ভরাট কণ্ঠের শিল্পী মোস্তফা কামালের যে উদ্বোধনী-সঙ্গীত দিয়ে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান, সেই কথাগুলোই হৃদয়ে ওঁদের হয়ে বাজে সময়ে-অসময়ে।
‘এই কথাটি মনে রেখ
তোমাদের এই হাসি খেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়
মনে রেখ…’

পূর্ববর্তী নিবন্ধএলোমেলো
পরবর্তী নিবন্ধ২০টি পূজামণ্ডপে কাউন্সিলর মুন্নীর অর্থ সহায়তা প্রদান