‘রান অফ’ ভোটে বিজয় নিশ্চিত করে সমর্থকদের হয়ত মধুর সুরে ধন্যবাদ দিচ্ছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান; তবে বিষয়টা যখন ভোটের লড়াই, সেখানে তার বাজনা একেবারে নিখুঁত। বিবিসি লিখেছে, এরদোয়ান তুরস্কের ভোটারদের মন যতটা ভালোভাবে পড়তে পারেন, ততটা কোনো জরিপকারী কিংবা বিশ্লেষক পারেন না। যারা বলছিলেন এরদোয়ান তার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হারবেন, তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী এবারও কাজে লাগেনি।
ভোটের হারে এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিরিচতারোলু মাত্র চার শতাংশ পয়েন্ট পিছিয়ে ছিলেন। তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসতে যাওয়া এরদোয়ান সেটা নিশ্চয় মনে রাখবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গত রোববারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রানঅফ ভোটের সরকারি ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এরদোয়ান ৫২ দশমিক ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিরিচতারোলুকে পরাজিত করেছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, কিরিচতারোলু ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। খবর বিডিনিউজের।
ইসলামপন্থি নেতা এরদোয়ানের সঙ্গে তার অনুসারীদের বন্ধন ২০ বছরের। এই অনুসারীদের অনেকেই তার মত ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল। পরিস্থিতি যেমনই হোক, তারা এরদোয়ানকে সমর্থন দিয়ে গেছেন, এমনকি চরম মূল্যস্ফীতির মধ্যেও। আর সেই সমর্থনই তাকে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। রান–অফ ভোটের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার রাস্তাগুলো তুর্কি পতাকায় ছেয়ে যায়। গাড়ির হর্ন বাজিয়ে বিজয় উল্লাস করেন এরদোয়ানের সমর্থকেরা। অনেকেই জড়ো হন বিশেষভাবে নির্মিত হাজার কক্ষের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে।
এরদোয়ানের ঘোর সমর্থক ৫০ বছর বয়সী হাতিস ডুরান মুখ ভরা হাসি নিয়ে বলছিলেন, আমরা ধন্য যে আমাদের প্রেসিডেন্ট আবার আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এর চেয়ে সুখের অনুভূতি আর নেই। বিশ্ব শুনুক, তিনিই সেই নেতা, যিনি সমগ্র বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন এবং বিশ্বকে একটি শিক্ষা দিয়েছেন।
বিবিসি লিখেছে, এটাই হল এরদোয়ানের প্রতি ভক্তদের আকর্ষণের মূল জায়গা; তাদের দৃষ্টিতে তিনি একজন শক্তিশালী নেতা, এ কালের তুর্কি সুলতান, যিনি কখনও মাথা নত করেন না। ফলে এ নির্বাচনের মূল বার্তা হল, তুরস্কের ভোটাররা একজন চমৎকার মানুষের চেয়ে একজন কঠিন মানুষকেই তাদের নেতা হিসেবে দেখতে পছন্দ করে।
নির্বাচনে জয় পেয়ে এরদোয়ান আরও সাহসী হয়ে উঠছেন। দেশটির বিরোধী দল পরাজয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। আর এরদোয়ানের বিজয় ক্রেমলিনও উদযাপন করছে। বিবিসি লিখেছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই ফলাফলই চেয়েছিলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এই তুর্কি নেতাকে অভিনন্দন জানানো প্রথম ব্যক্তিদের একজন পুতিন। এরদোয়ানের জয়ের জন্য যা যা দরকার পুতিন তা করেছেন। যেমন রাশিয়ার তেলের মূল্য হিসেবে ধরা ৬০ কোটি ডলার পরিশোধের বিষয়টি স্থগিত করেছেন তিনি।
বিবিসি লিখেছে, এরদোয়ান ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিলেন অনেক বেশি সুবিধা নিয়ে। অভিজ্ঞতা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগে তিনি এগিয়ে ছিলেন, ৯০ শতাংশ সংবাদমাধ্যমও তার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বিজয় উদযাপন বক্তৃতায় এরদোয়ান বলেন, জয়ী হয়েছে কেবল তুরস্ক। অবশ্য বিরোধী দল বা এলজিবিটিকিউ অধিকারকর্মীদের ওপর আক্রমণ করে তিনি কখনও হারেননি। এখন ওই দুই পক্ষই তার নিশানায় পড়তে পারে। আসছে বছরগুলোতে মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার দশা আরও করুণ হতে পারে। ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা তুরস্কে খুব একটা নেই। আর এই তুর্কি নেতাও বিরোধীদের আক্রমণের ক্ষেত্রে সংযমী হিসেবে পরিচিত নন।
বিবিসি লিখেছে, যারা ক্ষমতার পট পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, (প্রায় ৪৮% ভোটার) তারা হতাশ হবেন, সম্ভবত ভয়ও পাবেন। অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এই ‘সেকুলার’ প্রজাতন্ত্রের জনজীবনে স্বাধীনতার চেয়ে ধর্মই বেশি থাকবে। আগামী অক্টোবরে এ রাষ্ট্র শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন করবে।
তুরস্ক এখন ভগ্ন অর্থনীতির একটি বিভক্ত দেশ। সমালোচকরা বলছেন, ওই দুই সমস্যার কোনোটার সমাধানই প্রেসিডেন্টের হাতে নেই। তুরস্কের প্রতিবেশী এবং নেটো মিত্ররা তাহলে এই ভোটের ফল থেকে কী সিদ্ধান্ত নেবে? বিবিসি লিখেছে, প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উল্টে দিতে আনন্দই পান এরদোয়ান, সেটা জেনে তারা সতর্ক পর্যবেক্ষণ করবে।











