জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করা বাংলাদেশ টানা চার ম্যাচে হেরে একটি জয়ের হাপিত্যেশ করছিল। আগের চার ম্যাচে ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হারের পর খুবই আশায় ছিল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয়ের। কিন্তু কে জানতো বিশ্বকাপের সবচেয়ে দুর্বল ও নবীন এই নেদারল্যান্ডসের কাছেই পেতে হবে বিশ্বকাপের সবচাইতে বড় লজ্জাটা।
এবারের বিশ্বকাপে চলছে ব্যাটারদের রাজত্ব। গতকাল ধর্মশালায় অনুষ্ঠিত ম্যাচটিতে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের ম্যাচে হয়েছে সাড়ে সাতশর উপরে রান। কিন্তু ইডেন গার্ডেনের প্রথম ম্যাচে সে রানবন্যা হয়নি। বলা যায় বাংলাদেশের বোলাররা হতে দেননি। বল হাতে তাসকিন, শরীফুল, মোস্তাফিজ, মেহেদীরা দারুন সফল ছিলেন। নেদারল্যান্ডসকে বড় স্কোর গড়তে দেননি। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটাররা আবারো বন্দী হয়ে রইল সেই ব্যর্থতার বলয়ে। বের হতে পারল না হতাশার বৃত্ত থেকে। কাগজে, কলমে, অভিজ্ঞতা আর শক্তি সামর্থ্যে এবারের বিশ্বকাপের ছোট দল নেদারল্যান্ডস। যদিও তারা এবারের বিশ্বকাপে বড় অঘটন ঘটিয়ে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে। তারপরও এই নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে অন্তত একটা জয় আশা করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু জয়ের প্রত্যাশায় জল ঢেলে দিয়ে ডাচরা বাংলাদেশকে উপহার দিল পরাজয়ের লজ্জা। বিশ্বকাপে তো বটেই ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ এবং নেদারল্যান্ডস দুইবার মুখোমুখি হয়েছে। যেখানে জয় পরাজয় দুই দলেরই সমানে সমান। গতকাল এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু সে সুযোগকে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলার মত লজ্জার কালো মালা গলায় পরল সাকিবরা। বোলরাদের সাফল্যকে ম্লান করে দিয়ে ব্যাটাররা দেশকে ডুবিয়েছেন লজ্জায়। লিটন, তানজিদ তামিম, শান্ত, সাকিব, মুশফিকদের মত ব্যাটাররা এলেন আর গেলেন। যাদের কাজ ব্যাট করা না সেই মেহেদী হাসান মিরাজ, শেখ মেহেদীরা শত রানের নিচে অল আউট হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। তারকা খ্যাতি আর তারকা দ্যুতিতে ভাস্বর সাকিব–লিটনদের ব্যর্থতায় বিশ্বকাপে টানা পঞ্চম পরাজয় বরণ করতে হলো। নেদার্যান্ডসের কাছে গতকালের হারটা ৮৭ রানের। এখন একটি মাত্র জয়কে সম্বল করেই দেশে ফেরার শংকা জেগেছে বাংলাদেশ শিবিরে। কারণ পরের তিন ম্যাচে যে পাকিস্তান, শ্রীলংকা আর অস্ট্রেলিয়াকে মোকাবেলা করতে হবে টাইগারদের। যে টাইগার এখন নখ–দন্তহীন সার্কাসের টাইগারে পরিণত হয়েছে। যাদের গলা দিয়ে এখন আর হুংকার নয়, মিউ মিউ ডাক বের হয়।
টসে জিতে ব্যাট করতে নামা নেদারল্যান্ডসকে প্রথম ধাক্কাটা দেন তাসকিন আহমেদ ইনিংসের দ্বিতীয় এবং নিজের প্রথম ওভারেই। সাকিব আল হাসানের ক্যাচে পরিণত করে তাসকিন ফেরান বিক্রমজিত সিংকে। দলের এবং বিক্রমজিতের রান কেবল ৩। পরের ওভারে শরীফুলের আঘাত। এবার তার শিকার আরেক ওপেনার ম্যাক্স। চার রানে দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া নেদারল্যান্ডসকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন বারেসি এবং একারম্যান। ৬৯ রানের জুটি গড়েন দুজন। মোস্তাফিজের বলে সাকিবের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন ৪১ বলে ৪১ রান করা বারেসি। পরের ওভারে একারম্যানকে ফিরিয়ে নিজের প্রথম উইকেট তুলে নেন সাকিব। ৩৩ বলে ১৫ রান করা একারম্যানের ক্যাচ নিয়েছেন মোস্তাফিজ। এরপর ভাস ডি লিডকে নিয়ে আরেক দফা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা স্কট এডওয়ার্ডসের। ৪৪ রান যোগ করেছিলেন দুজন। তাসকিন আহমেদ এদেরকে আর বেশিদুর এগুতে দেননি। তিনি ফিরিয়েছেন ভাস ডি লিডকে। ১০৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে আবার যখন চাপে নেদারল্যান্ড তখন আবার প্রতিরোধের দেওয়াল হয়ে দাঁড়ান এডওয়ার্ডস। এবার তার সঙ্গী সিবরান্ড এনজেরব্রিচট। বাংলাদেশের উপর ঝেঁকে বসা এই জুটি যোগ করেন ৭৮ রান। নিজের হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া এডওয়ার্ডসকে ফিরিয়ে এজুটি ভাঙেন মোস্তাফিজ। পয়েন্টে ক্যাচ নেন মিরাজ। ৮৯ বলে ৬৮ রান করেন এডওয়ার্ডস। পরের ওভারে সিবরান্ডকে ফেরান মিরাজ। তার ব্যাট থেকে আসে ৩৫ রান। সারিজ আহমেদকে রান আউট করে ফেরান মাহমুদউল্লাহ। তখনো দুইশ রান পুরন করা নিয়ে শংকায় ছিল নেদারল্যান্ডস। শেষ পর্যন্ত দুইশ রান পার করে নেদারল্যান্ডস। শেষ দিকে ভ্যান ভিকের ১৬ বলে ২৩ রানের সুবাধে ২২৯ রানে থামে নেদারল্যান্ডস। শেষ বলেই অল আউট হয় ডাচরা। বাংলাদেশেল পক্ষে ২টি করে উইকেট নিয়েছেন চার বোলার। তারা হলেন শরীফুল, তাসকিন, মোস্তাফিজ এবং মেহেদী হাসান।
২৩০ রানের লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য তাড়া করতে নেমেই কিনা শুরু থেকেই দিশেহারা বাংলাদেশ। দলের খাতায় ১৯ রান যোগ হতেই ৩ রান করে অযথা রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন লিটন দাশ। পরের ওভারে ফিরেন আরেক ওপেনার তানজিদ হাসান তামিমও। তিনি লাফিয়ে উঠা বলে ব্যাট ছুইয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন ভ্যান ভিকের বলে। ১৫ রান করেন এই ওপেনার। নাজমুল হোসেন শান্ত এসে বেশ ভাল একটি শট দিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনিও ফিরলেন বাজে এক শটে। দুই অংকের ঘরে যেতে পারেননি শান্ত। এরপর উইকেটে অধিনায়ক সাকিব। তার কাঁধে বিশাল দায়িত্ব। তার উপর নিজের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে মুম্বাই ম্যাচ শেষে ঢাকায় গিয়ে গুরু নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কোকো কিছুই কাজে আসল না। যথারীতি ব্যর্থতার চোরাবালিতে হারিয়েই গেলেন সাকিব। হাসল না তার ব্যাট এমন প্রতিপক্ষের বিপক্ষেও। অপ্রয়োজনীয় কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলেন ১৪ বলে ৫ রান করে। পরের ওভারেই ধৈর্যহারা হয়ে গেলেন একপ্রান্ত আগলে রেখে দলকে টেনে নিয়ে যাওয়া মেহেদী হাসান মিরাজ। ৪০ বলে ৩৫ রান করে ফিরেন তিনি। ৬৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে মারাত্মক চাপে তখন বাংলাদেশ। আর সে চাপকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে এলেন মুশফিকুর রহিম। আয়েশি এক শট খেলতে গিয়ে বোল্ড হন দলের সবচাইতে অভিজ্ঞ এই ব্যাটার। ৭০ রানে ৬ উইকেট নেই বাংলাদেশের। রাগব বোয়ালরা যেখানে জল খেয়ে এসেছে শেখ মাহেদী হাসানের আর কিইবা করার থাকে। তারপরও মাহমুদউল্লাহর সাথে ৩৮ রানের জুটি গড়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করেছিলেন এই তরুণ। কিন্তু শেষটা হলো তার রান আউটে। ফিরলেন ১৭ রান করে। এক ওভার পর মাহমুদউল্লাহ ফিরে এলে বাংলাদেশের পরাজয় একেবারেই নিশ্চিত হয়ে যায়। আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করা মাহমুদউল্লাহ এ ম্যাচেও করেছেন ২০ রান। কিন্তু লজ্জা নিবারণ হয়নি তাতে। মোস্তাফিজ দুটি চার আর একটি ছক্কা মেরে হারের ব্যবধান কিছুটা কমানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাকে বোল্ড করে ফেরান অ্যাকারম্যান। ৩৫ বলে ২০ রান করেন মোস্তাফিজ। তাসকিনকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে ১৪২ রানে থামিয়ে দেন ভ্যান মেকেরিন।
এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তো বটেই যেকোনো দলের সর্বনিম্ন দলীয় স্কোর এই ১৪২। নেদার্যান্ডসের পল ভ্যান ম্যাকেরিন একাই ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে ধসিয়ে দিয়ে হয়েছেন ম্যাচসেরা।