এক সত্যব্রতধারী কর্মবীর সত্যরঞ্জন সিংহ

ড. উদিতি দাশ | শুক্রবার , ৫ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

রাউজান থানার গহিরা গ্রামটি চট্টগ্রামের একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। স্বাধীনতা সংগ্রাম কালের শহীদ প্রখ্যাত সমাজসেবক ও দানবীর অধ্যক্ষ শ্রী নূতন চন্দ্র সিংহের প্রতিষ্ঠিত শ্রীকুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়, কুণ্ডেশ্বরী বালিকা মহাবিদ্যালয়, কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির ও প্রাথমিক বিদ্যালয়কে তৎকালীন প্রধান পরিচালক ছিলেন শ্রী সত্য রঞ্জন সিংহ (১৯৩৫১৯৮৫)। ইতিহাসের পাতা থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাওয়া এক মুক্তিযোদ্ধা, জাতির সূর্য সন্তান, কর্মবীর সত্যরঞ্জন সিংহ দানবীর নূতন চন্দ্র সিংহের মেজ ছেলে। আমার বাবা ও সত্যজেঠু ছিলেন এক অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু। তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান বাসুদেব সিংহ আমার বন্ধু। আমরা চবিয়ান ’২৫। এটুকু ভূমিকার প্রয়োজন নেই কারণ আজ শ্রী সত্যরঞ্জন সিংহের (১৯৩৫১৯৮৫) উনচল্লিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। ছোটোবেলা থেকেই আমার বাবা প্রয়াত অধ্যক্ষ শ্রী গোপাল দাশকে বলতে শুনেছি সত্যজেঠুুর কথা। গোঁয়ার যৌবনের উচ্ছ্বাসে সমাজ বিধানকে উপেক্ষা করে তাঁরা প্রতিদিন একে অপরের হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি শুনতেন। জীবনকে উপেক্ষো করে তাঁরা এক সাথে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা ইতিহাস অনাদৃত হলেও আমাদের হৃদয়ে দেদীপ্যমান। শ্রী সিংহ ছাত্রজীবনেই পিতা অধ্যক্ষ শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের উন্নতির জন্য ছাত্রজীবন ছেড়ে ছিলেন। সত্যজেঠুুর অক্লান্ত শ্রম ও মেধার কারণে কালে কালে উক্ত প্রতিষ্ঠান দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। বলা বাহুল্য শহিদ অধ্যক্ষ নতুন চন্দ্র সিংহ প্রতিষ্ঠিত কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় ও সকল প্রতিষ্ঠান উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে যার একমাত্র কারণ ছিল শ্রী সত্যরঞ্জন সিংহের কর্মদক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার ফলশ্রুতি। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম শহরের থেকে আঠার মাইল দূরে গহিরায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংকল্প শহীদ অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ। এই সংকল্পের বাস্তব রূপদাতা ছিলেন শ্রী সত্যরঞ্জন সিংহের। পর্যায় ক্রমে ছাত্রী নিবাস, মহাবিদ্যালয়, মনোরমা হল ও সবশেষে আয়ুর্বেদিক কলেজ প্রতিষ্ঠা, সব কিছুতেই তাঁর ছিল মুখ্য ভূমিকা। বাবার মুখে শুনেছি শ্রী সত্যরঞ্জন সিংহের অদম্য পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তা না থাকলে শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় সারাদেশব্যাপী জনপ্রিয়তা ও সফলতা লাভ করতো না। মূলত সত্যজেঠুুই ছিলেন কুণ্ডেশ্বরীর সকল প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ। তাঁর আদর্শ ছিলোExample is batter than precapt অর্থাৎ কাজের মাধ্যমেই তিনি দেখিয়েছিলেন তাঁর অনন্য মানসিকতার উন্মুক্ত অঙ্গন। মানবতার সেবায় তিনি ছিলেন একান্ত উদার। তাঁর কর্মপ্রবাহের আলোক দীপ্তি আজো জ্বলছে কুণ্ডেশ্বরী ভবনসহ দেশব্যাপী তাঁদের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান তাঁর প্রসঙ্গে বলেছেন– ‘সত্যসিংহ ছিলেণ বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক কর্মী পুরুষ।’ ‘If you have tears, prepare to shed them now’ বি্যক্তির শ্রেষ্ঠ পরিচয় মানুষের প্রতি প্রীতিতে এবং প্রীতির প্রতি বিশ্বাসে যার প্রীতিবোধ যত বৃহৎ ব্যক্তি হিসেবে তিনি তত মহৎ। বিত্ত ও চিত্তের মনিকাঞ্চন যোগে তিনি জন্মালেও তিনি ছিলেন আজীবন নির্মোহ, নির্লোভ, সদাচারী, সত্যভাষী এক অনন্য মানুষ। দুর্দিনে, দুর্গম পথে, দুঃসাহসিক ব্রতে দুঃস্বজনের তিনি ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। বৃত্তি ও মর্যাদার দিক থেকে অনেকাংশে আলাদা হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বতন্ত্র জীবনযাপন করেননি। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী। যা তিনি অনুভব করতেন অকপটেই তা বলে ফেলতেন। যেখানেই তিনি দেখেছেন মানুষের দুর্দশা জীবনযুদ্ধে মানুষের পরাভব, সেখানে তিনি ছিলেন কমল পর্ণের মতোই সুকোমল। গতানুগতিক জনমণ্ডলীতে তিনি ছিলেন এক মূর্তিমাত্র সিংহ পুরুষ। তিনি সত্যান্বেষী। তাঁর নামের সাথে সাজুখ্য রেখেই যোগ হয়েছিল তাঁর কর্মব্যপ্তি। অসাফল্য তাঁর জীবনে অজ্ঞাত। তাঁর শৌর্য, বীর্য, মহত্ব, উদারতা, নৈতিকতা অনন্তকাল স্বীকার করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা অনেকেই তাঁর সম্পর্কে জানি না। আবার বাবার কথায় আসি। বাবার যৌবন যুগের সখা সত্যজেঠুু। মৃত্যুর চার মাস আগে বাবাকে তিনি একটি সুরম্য হংকং ডারেরি দিয়েছিলেন। নিজ হাতে লিখেছিলেন ডারেরির প্রথম পাতায়-‘Presented to Dear Gopal Das (Principal) by Kabiraj Satya Ranjan Sinha. Sree Kundeswari Aushadhalaya Ltd. P. O. Kundeswari Bhaban. Dist Chittagong.’ সেদিনই বাবা আমাকে ডায়েরি দেখিয়ে লিখেছিল– ‘‘সত্য’ যে কঠিন কঠিনেরে ভালোবাসিলামসে কখনও বঞ্চনা করে না।” গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অন্তিমপর্বের এই রবীন্দ্র কবিতাংশে একটি বিশেষে তাৎপর্যপূর্ণ দিক বাবা ব্যক্তিগত অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। বাবা ‘সত্য’ প্রীতি এতোটাই গভীর ছিলো যে তিনি আবারো সেই সুরম্য ডায়েরি লিখেছিলেন ‘আমৃত্যু দুঃখের তপস্য এ জীবন সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল সকল দেনা শোধ করে দিতে।’ কবিতার এই অংশটুকু বাবার জীবনে এক অনির্বচনীর সত্য। কারণ তিনি সত্যজেঠুকে সত্যিই প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। আজ বাবা সত্যজেঠুু নেই। অথচ রয়েছে বাবা ও সত্যজেঠুর হাতের লেখার ডারেরিটা। প্রাণ নিয়েছি বহুবার। আজীবন বাবা সত্যস্মৃতি বুকে ধারণ করেই ছিলেন। সত্যরঞ্জন সিংহ ছিলেন চেতনা ও কর্মে ক্লান্তহীন, নিরবচ্ছিন্ন ও অতন্দ্র ধৈর্যে সমুজ্জ্বল। মৃত্যুর দুয়ারে পা রেখেও তিনি হতাশ হননি, হয়তো আর বেশি সময় নেই ভেবে প্রতিদিন রাত একটা পর্যন্ত জীবনের হিসেব চুকাবার কাজে রত ছিলেন। জীবনের পার্থিবতাকে তিনি কখনো অবহেলা করেননি। জীবনশিল্পীদের এটাও একটা মোক্ষম লক্ষণ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির তিনি একজন একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ে তাঁর বিপুলসংখ্যক বন্ধুবান্ধব, অনুরাগী, শুভানুধ্যায়ী এ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সকল সম্প্রদায়ের উৎসবেব্যসনে, দুঃখেসুখে তাঁর সম্যক উপস্থিতি রাউজান অঞ্চলের তথা সমগ্র বাংলাদেশের মানুসের স্মৃতিতে আজও অম্লান। জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে তিনি সমস্ত ঐতিহ্য ও আচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এমন শোভন ব্যক্তিত্ব সমাজের অনুকরণীয় আদর্শ বলা যেতে পারে। শ্রী সত্যরঞ্জন সিংহ একজন সংস্কৃতি কর্মী ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি আলাউদ্দিন ললিতকলার সভাপতি ছিলেন। তৎকালীন জাগৃতি নাট্য সম্প্রদায়ের বা সংস্থার তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান কর্মময়। চট্টগ্রামের সাপ্তাহিক সমাজএর পরিচালক সম্পাদক, আয়ুর্বেদ ও ইউনানী বোর্ডের মুখপত্র স্বাস্থ্য সাময়িকীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং আয়ুর্বেদ সংবাদসহ বহু পত্রপত্রিকায় তিনি ছিলেন পৃষ্ঠপোষক। তিনি ঢাকা ক্যাপিটাল লায়ন্স ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশ ডিস্টিলারস্‌ এসোসিয়েশনের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও আয়ুর্বেদ পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সক্রিয় সদস্য। তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে বোর্ড অব ইউনানী এন্ড আয়ুর্বেদিক সিস্টেমের তিনি সক্রিয় সদস্য। পূর্বেই বলেছি, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা লাভের পর তিনি গহিরা ইউনিয়নের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শ্রী সত্যরঞ্জন সিংহের আজ ৫ এপ্রিল মহাপ্রয়াণে চলে যাবার দিন। সময়ের আবর্তনে আমরা একে একে তাঁর সমসাময়িক প্রায় সকলকেই হারিয়ে ফেলেছি। আমিও আমার বন্ধু বাসুদেব সিংহ আজ পিতৃহীন। বন্ধু বাসু খুব ছেটোবেলায় তার পিতাকে হারিয়েছে। আমার দিদিরাও পিতৃহীন। এখন সময় এসেছে পিতৃঋণ শোধ করার যদিও পিতৃঋণ অপরিশোধ্য তবুও শ্রী সত্যরঞ্জন সিংহের মতো মানুষ কালেভদ্রে জন্মায়। অথচ এমন মানুষের যোগ্য মূল্যায়ন হয়নি। তথাকথিত সমাজসেবকদের অন্তরালে তিনি অনাদৃতই রয়ে গেলেন। শ্রী সত্য রঞ্জন সিংহকে তাঁর যোগ্য মূল্যয়ন করে তাঁকে স্মৃতিতে অম্লান রাখা আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব। আজ শুধু জেঠু ও বাবার কথা মনে পড়ছে। জেঠুর মৃত্যুর পরে লেখা বড়ো জেঠু অর্থাৎ শ্রী সত্যরঞ্জন সিংহের বড়ো ভাই চিত্তরঞ্জন সিংহের একটি কবিতা যা সত্যজেঠুুর উদ্দেশ্যে লেখা। নিত্য মৃত্যু ছুঁয়েছিলো তোরে, সেতুই ঢিঙিয়ে গেলি অল্পায়াসে কঠিন মৃত্যুরে। মৃত্যুহীন তোর পরবাস, অনন্তে অমৃত হয়ে অনুক্ষণ ছড়াক সুবাস। আজ মৃত্যু দিবসে শ্রী সত্যরঞ্জন সিংহের প্রতি আমার বিনম্র অতল শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: প্রফেসর, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংসার জীবনে প্রেম ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধআল্লাহর কুরআন মানব মনে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী মহাশক্তি