এক বাবার গল্প

অভীক ওসমান | শুক্রবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব সাহিত্যে মাকে নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’, স্প্যানিশ ‘লা মাদ্রে’ পার্ল এস বার্কের ‘মাদার’। বাংলাদেশের শওকত ওসমানের ‘জননী’ আবু ইসহাকের ‘জয়গুন’, (‘সুর্য দীঘল বাড়ী’), এমনকী আনিসুল হকের ‘মা’ শততম সংস্করণ হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘আমার পিতার মুখ’ মৌলি আজাদের ‘হুমায়ূন আজাদ, আমার বাবা’। সিমিন হোসেন রুমির ‘পিতা ও নেতা তাজউদ্দীন’ এসব খ্যাত। চট্টগ্রাম চেম্বার সচিবালয়ে আমার টেবিলে সাদমান সাইকা সেফা’র ‘Artistic View of Europe’ বইটা দেখেছিলাম, পড়েছিলাম। তিনি নতুন প্রজন্মের লেখক এবং উইমেন এন্টারপ্রেইনার। প্রকাশিত হল তাঁর ‘একজন অসাধারণ বাবা’ গ্রন্থ (সেপ্টেম্বর ২০২১)

গল্পটা শুরু হয়েছে ওয়ান ফাইন মর্নিং সুভা নামের ক্লাস থ্রির একজন শিশুর কালো বেল্টের ঘড়ি ও সানগ্লাস পাওয়ার স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবে এক বাবার কাছ থেকে উপহার পাওয়া নিয়ে। সাথে বাবাকে ভালোবাসার আবেগী সংবেদনশীলতা নিয়ে। সুভা ঘড়ি, সা্‌নগ্লাস নিয়ে স্কুলে গেলো, বন্ধুদের দেখাল, এমনকি শাওয়ার নেয়ার সময় পর্যন্ত খোলেনি। এখানে লেখক শিশুতোষ রূপকথার পারঙ্গমতায় লিখেছেন। এরপর ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে বলেছেন, তাঁর বাবার অতীতের সংগ্রামী জীবনের কথা।

এর মধ্যে সেফা তার পরিবার, বাবার সৌদি আরব না গিয়ে মামার (জাওয়াদ সাহেবের) দোকানে চাকরি করা, নিরন্তর পরিশ্রম, সততা, কমিটমেন্ট নিয়ে কাজ করার ফলে একটা স্থিতাবস্থায় আসলে ১৯৮৩ সালে সুভার দাদা বাবার দেয়া টাকা নিয়ে কুরবানী দেবার জন্য ট্রেনে যাত্রা করেন। সেখানে খুশিতে, উচ্ছ্বাসে হাসতে হাসতে দাদা হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেলেন। লেখক জানাচ্ছেন ‘জাওয়াদ সাহেবের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেলো।’ তিনি মামা মামীর স্নেহ, ভাইবোন, ভাগিনা ভাস্তিদের নিয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করলেন। পার্টনার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন, বিশ্বস্ততা অর্জন করেছেন। (পৃ: ২৭) মূলতঃ জিপিএইচ ইস্পাতের গ্রুপ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম যাকে দেশের বিজনেসম্যানরা ‘ম্যান অব কমিটমেন্ট’ অভিধা দেন। তিনিই সুভার বাবা জাওয়াদ হিসেবে এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছেন।

বাস্তবে গল্পের মতো, কখনো কবিতার মতো করে জাহাঙ্গীর সাহেব জনসমক্ষে বলেন, ‘আমি বৃটিশ সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিক পুত্র। নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময় তখন সিআই শিট আমদানি হতো, তার বান্ডেলের কভারটা আমি কিনতাম। এইভাবে এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকার পুঁজি হলো।’ জাওয়াদ সাহেবের মিশন ভিশন হলো ‘কোনো একটি কাজের প্রতি সঠিকভাবে লেগে থাকা যতক্ষণ না পর্যন্ত কাজটা সফলতার মুখ দেখে’। ১৯৮৭ সালে এই সেলফমেইড মানুষ নিজে ব্যবসা করেন। আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি দিয়ে ইস্পাত শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। ‘অভ্যন্তরীণ বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে আপডেটেড থাকেন। বাহুল্য হলেও সত্য এক সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন, ‘. ইউনুসের পর তাঁর বক্তৃতা শুনতে ভালো লাগে’। আনন্দ, বিষাদের দ্যোতনায় তাঁর জীবন। ১৯৮৮ সালে তাঁর মেন্টর মামা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান।

এরপর ন্যারেটিভলি লেখক তার বাবার সাথে তার বেড়ে ওঠার গল্পগুলো বলে গেছেন। ১৯৯০ সালে তাঁর জন্ম, ভাইয়ের জন্ম ১৯৯৫ সালে। বাবা মা’র সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ট করা। তার জন্মদিন পালন, বিয়ে। সেই সঙ্গীতময়তা ‘বাবা তুমি বেঁচে থাকার কারণ’ বা ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিত্যাহি, পরমংতপ’। আয়াত নামে সুভার সন্তানের জন্ম। মায়া, মমতা, উচ্ছ্বাস, আনন্দ। ভাইদেরকে টিম মেম্বার হিসেবে নিয়ে ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড হিসেবে জাওয়াদ সাহেবের পথ চলা ইত্যাদি সাবলীলভাবে বলে গেছেন। এর জন্য সব বয়সের পাঠকের জন্য বইটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। জাওয়াদ সাহেবের ক্যাপ্টেন্সি। যা নিয়ে একটি জাতীয় পত্রিকা লিখেছিল ‘ইস্পাত দৃঢ় ছয় ভাই’।

গ্রন্থটির ক্লাইমেক্সে গিয়ে অতিমারীকাল চলে আসে। জাওয়াদ সাহেব করোনায় আক্রান্ত হন। যার ফলে করোনাকালীন সাহিত্য হিসেবে ‘একজন অসাধারণ বাবা’ গ্রন্থটি স্থান করে নেবে। সবশেষে এই গ্রন্থের জাওয়াদ সাহেবের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি। ‘চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৫ টি আইসিইউ বেড দান করবেন এবং নিজের পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় খুলবেনঃ কয়েক জন এমবিবিএস ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করবেন। নিজের ব্যবসায়িক ফান্ড থেকে অর্থায়ন করে এই কাজটি তিনি জরুরী ভিত্তিতে সুসম্পন্ন করবেন। তিনি ভাবলেন, আমি এলাকার শিক্ষিত যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছি, আমি জীবনে কোনো কাজে কখনো ব্যর্থ হইনি। ইনশাআল্লাহ এবারও হবো না। তাঁর এত ধনসম্পদ টাকাপয়সা গাড়িবাড়ি সবই তো থেকে যাবে। শুধু তাকেই চলে যেতে হবে খালি হাত, পা নিয়ে’।

প্রকাশক মোস্তফা আশরাফুল ইসলাম আলভি যদি তার প্রাককথনে ‘আত্মজার সংবেদনশীলতা’ উল্লেখ না করতেন। যদি গ্রন্থটা পিক্টোরিয়াল না হতো, তাহলে এ্যাবস্ট্রেক্ট একটা গ্রন্থ হতো। পাঠক দুটো স্বাদই গ্রহণ করতে পারবেন। উপসংহারে বলি ধর্মাচারী, কর্মযোদ্ধা পূর্ণাঙ্গ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের গল্পের শেষ এই গ্রন্থে হয়নি। তরুণবেলার একটা পলিটিক্যাল বই, ‘যে গল্পের শেষ নেই’ (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়) পড়েছিলাম। ভবিষ্যতে লেখক বা আর কেউ হয়তো নিরন্তর সংগ্রামশীল, গুড মোটিভেটর, বাগ্মি, তৃণমূল থেকে উঠে আসা এন্টারপ্রেইনারের গল্প লিখবেন। বইটির কভার করেছেন দি এ্যাড’র দীপক দত্ত। এর বহুল পাঠ কামনা করছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশীর্ষ নেতার মৃত্যুর ঘোষণা, নতুন নেতার নাম জানাল আইএস
পরবর্তী নিবন্ধনিয়ন্ত্রণহীন কাভার্ডভ্যান খাবার টেবিলেই পিষে মারলো ৫ জনকে