একুশে ফেব্রয়ারি উপলক্ষে প্রথম দেয়ালিকা বের করি মুক্তনীড় খেলাঘর থেকে। তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। সে থেকে একুশের প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়ে যাই। তখন স্কুল–কলেজ দেয়ালিকা প্রকাশ হতো। কলেজে ভর্তি হয়ে থানা ছাত্রলীগের গ্রন্থনা–প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পাই। ক’দিন পর ছাত্রনেতা মোমিন ভাই (আবদুল মোমিন, বোয়ালখালী থানা ছাত্রলীগের সভাপতি) ও বাদশা ভাইয়ের (সিরাজুল হক বাদশা, বোয়ালখালী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক) নির্দেশে একুশে ফেবু্রয়ারিতে প্রকাশিতব্য দেয়ালিকার জন্য লেখা আহবান করি। ছাত্রলীগের দেয়ালিকা ‘আবার আসিব ফিরে’ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীমহলে নন্দিত একটি নাম। এ দেয়ালিকার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবি। হাতে আঁকা ছবি নয়, পেপার কাটিং। বঙ্গবন্ধুর নানান ছবি। এমন ভাবনার প্রধান কারিগর ছিলেন মোমিন ভাই ও বাদশা ভাই। মনে পড়ে, কলেজ মাঠে মোমিন ভাই, বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে লেখা বাছাই করার সময়ে পুলিশের তাড়া খেয়েছিলাম। তখন এরশাদের সামরিক শাসনের কাল। ওই বছরের (১৯৮৩ সাল) একুশে প্রকাশিত কবি মিনার মনসুরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ প্রকাশের তিনমাসের মধ্যে সামরিক সরকার নিষিদ্ধ করে।
শহিদ মিনারের মুসলিম হল প্রাঙ্গণে টেবিল চেয়ার নিয়ে একুশের প্রথম প্রহরে প্রথমবারের মতো বসেছিলাম ১৯৮৬সালে। নিজেদের প্রকাশনা নয়, অগ্রজদের প্রকাশনা নিয়ে বসেছিলাম। আমাদের দলের কান্ডারি ছিলেন লিটন ভাই। আমরা বিক্রি করেছি কবি মিনার মনসুরের কাব্যগ্রন্থ ‘অনন্তের দিনরাত্রি’, ডা. মিল্টন খোন্দকারের ছড়াগ্রন্থ এবং মোজাম্মেল বাবু’র কবিতা গ্রন্থ। এছাড়া ছিল মোজাম্মেল বাবু ও জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘স্পর্শ’। ‘স্পর্শ’ অসাধারণ একটি প্রকাশনা হয়েছিল। নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে নিয়ে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ লেখা ছিল। ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’–এর কিছ ুঅংশ অনুবাদও ছিল। কোনো বিজ্ঞাপন ছিল না।
আমরা অনেকে একুশের প্রথম প্রহরে লিটল ম্যাগাজিন আর নতুন বই নিয়ে শহিদ মিনারের পাদদেশে টেবিল চেয়ার নিয়ে বসতাম। বাংলাদেশের আবৃত্তি বিষয়ক প্রথম প্রকাশনা ‘আবৃত্তি’–এর প্রথম প্রকাশ একুশের প্রথম প্রহরে। খুব উত্তেজনা অনুভব করতাম। একুশের প্রথম প্রহরে এখানে বিক্রি হতে দেখেছি ্ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, শাহিদ আনোয়ারদের কবিতার বই ‘দ্রৌপদীর প্রেমিকেরা ও অন্য একজন’, প্রয়াত প্রলয় দেবের গল্পগ্রন্থ ‘অরুন্তুদ সময় সঙ্গী’, রাশেদ রউফের ‘আকাশের সীমানায় সূর্যের ঠিকানায়’ আমার লেখা কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘আগামীর জন্য ভালোবাসা’, দেবাশীষ ভট্টাচার্য, মহীবুল আজীজ, হোসাইন কবীর, ওমর কায়সারসহ অনেক কবি সাহিত্যিকের বই। তখন এক মলাটে দু’জনের লেখা কবিতার বইও প্রকাশিত হতো। নিজেরা নিজেদের বই বিক্রি করতাম। বেশি সংখ্যক নতুন বই আসত একুশের প্রথম প্রহরে। অগ্রজরা এসব কিনে আমাদের উৎসাহ দিতেন। সরাসরি বাঁধাইখানা থেকে এনে বই–পত্রিকা পাঠকের হাতে তুলে দিতে রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। কেউ কেউ দেখে শুনে বেছে কিনতেন। কেউ আবার সৌজন্য কপি চাইতেন। কয়েকজন আগ্রাসীভাবে সব পত্রিকা, ফোল্ডার, বই কিনতেন। এই আগ্রাসী ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, নাট্যজন শিশির দত্ত, জহিরুল ইসলাম ছুট্টু প্রমুখ। এঁরা আসলে আমরা উৎসাহবোধ করতাম। তাঁরা আমাদের উৎসাহ দিতে হাসিমুখে সব কিনতেন। অধ্যাপক ড. অনুপম সেন একুশের সংকলনে মুদ্রিত দামের চাইতে একটু বেশি টাকা দিয়ে দিতেন।
চট্টগ্রামকে একসময় লিটল ম্যগাজিনের শহর বলা হতো। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রথম লিটল ম্যাগাজিনের নাম ‘সীমান্ত’। এর সম্পাদক ছিলেন কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত এ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন কথাসাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরী। ‘সীমান্ত’–এর পথ ধরে পঞ্চাশ দশকে রুহুল আমিন নিজামী প্রকাশ করেন ‘উদয়ন’, মফিজ উল হকের সম্পাদনায় ‘পরিচিতি’। উনিশ’শ সাতান্ন সালের মে মাসে সুচরিত চৌধুরী ও ওয়ালী আহমদের সম্পাদনায় পুর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদে ‘প্রাচী’র প্রথম সংখ্যা বের হয়। ষাটের দশকের উল্লেখযোগ্য লিটল ম্যাগাজিনগুলো হলো শামসুল আলম সাঈদের ‘তারপর’, শফিউল আলমের ‘পূর্বপত্র’, বেগম মুশতারী শফীর ‘বান্ধবী’, আহমদ রফিক ও আবুল মোমেনের ‘অচিরা’, রশীদ আল ফারুকীর ‘বিবিধ’, মাহবুবুল হকের ‘কলরোল’, চৌধুরী জহুরল হকের ‘সাত–সতেরো’, সেকান্দর হায়াতের ‘ঐতিহ্য’, খায়রুল বশরের ‘নবদিগন্ত’, শফিউল আলমের ‘পূর্বপত্র’, মুহাম্মদ নুরুল হুদার ‘কলতান’, সিকান্দার হায়াতের ‘মেঘনা’। এধারা সত্তর দশকেও অব্যাহত থাকে। জাফর আহমদ হানাফির ‘ চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’, আহমেদ খালেদ কায়সারের ‘অঘ্যর্’, কাজল কান্তি বড়ুয়ার ‘উত্তরমেঘ’, ম আ আওয়ালের ‘পদাতিক’, সুরেশ রঞ্জন বসাকের ‘জন্মদিন’, নাসির উদ্দিন চৌধুরীর ‘প্রতিভাস’, দিলারা আলমের ‘ফুলেল’, নিতাই সেনের অঙ্কুর’, সাথী দাশের ‘কবিতা’, শিশির দত্তের ‘সম্পাদক’, আসাদ মান্নানের ‘দর্পণ’, বিমল গুহের ‘বিন্দুমাত্র’। ১৯৭১ সালে চাকসু’র উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘আগুন’ নামে একটি সংকলন। স্বাধীনতার পর একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় নীর রহমানের ‘অভিষেক’, আতাউল হাকিমের ‘এক নদী রক্ত’, কাজল কান্তি দে’র ‘‘হাজারী লেইন’। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পরে আলোড়র সৃষ্টিকারী লিটল ম্যাগাজিনগুলো হলো মিনার মনসুর, দিলওয়ার চৌধুরী’র ‘এপিটাফ’, শিশির দত্ত’র ‘সম্পাদক’, স্বপন দত্ত প্রমুখদের ‘স্পার্ক জেনারেশন’। নব্বইয়ের দশকে আলোচিত ছোট কাগজ এজাজ ইউসুফী’র ‘লিরিক’. মহীবুল আজীজ’র ‘লিটল ম্যাগাজিন। এছাড়াও প্রকাশিত হয় অরুণ সেনের ‘ঋতপত্র’, অমিত চৌধুরীর ‘মূল্যায়ন’, ওমর কায়সারের ‘মধ্যাহ্ন’, হাফিজ রশীদ খানের ‘পুষ্পকরথ’, কমলেশ দাশগুপ্তের ‘অন্তরীপ’, রাশেদ রউফ’র ‘প্রেরণা’ ও ‘দুরন্ত’, প্রয়াত ফারুক হাসান’র ‘কথন’, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়ার ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’, অরুণ দাশগুপ্ত ও খুরশীদ আনোয়ার’র ‘আপাতত’, সাফায়াত খান’র ‘প্রাচী’, সরোজ কুমার বল সম্পাদিত ‘বোধন’, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী’র ‘বহ্নি’। ‘দুরন্ত’,‘বহ্নি’–এর সঙ্গে আমিও সম্পৃক্ত ছিলাম। ‘বহ্নি’র নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপনদাতা ছিল অলম্পিক পেইন্ট, দারুল ফজল মার্কেটের মধুবন মিষ্টির দোকান। আরও অনেক লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। কমলেশ দাশগুপ্তের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে এসব সংরক্ষিত আছে। তখন লিটল ম্যাগাজিনের লেখক প্রকাশক ছিল সাহিত্যমনস্ক ছাত্রসমাজ। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল কোনো কোনো ছোট কাগজের প্রতি। এসব পত্রিকা শুধু একুশে প্রকাশিত হতো না। বছরের অন্যান্য সময়েও প্রকাশিত হতো। চট্টগ্রামের সব লেখক লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে কম–বেশি যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে এসব লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ডা ছিল। বেশিরভাগ আড্ডা বসত রেস্টুরেন্টকেন্দ্রিক। চৌরঙ্গি রেস্তোরা, বোস ব্রাদাস, সবুজ হোটেলের কথা খুব মনে পড়ছে। ব্যতিক্রমও ছিল। যেমন ফুলকী’র আড্ডা। অরুণদার বাসায় বুধবারের আড্ডা। মুসলিম হল প্রাঙ্গণে শুরু হয় একুশে মেলা। একুশের প্রথম প্রহরে টেবিল বিছিয়ে আমাদের বই–পত্রিকা বিক্রি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। প্রকাশনা প্রাতিষ্ঠানিকার দখলে চলে গেল। আমরাও সে উত্তাপ হারিয়ে ফেলি।
একুশে মেলার উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাংবাদিক নাসির উদ্দিন চৌধুরী, অরূণ বণিক প্রমুখ। অরুণ বণিক চট্টল ইয়ুথ কয়ার নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনা করতেন। চট্টগ্রামে যে কজন নেপথ্য সংগঠক দেখেছি, এ’দুজন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁদের কখনও মঞ্চে উঠতে দেখিনি।
একুশে প্রথম প্রহরে শহিদ মিনারে অনেক সমাগম হয়। নানা বয়সী, নানান পেশার মানুষ আসে। কামরুল হাসান বাদল পরিকল্পনা করলেন এসব মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটা ডকুমেন্টরি করবেন। তখন এতো টিভি চ্যানেল ছিল না। ফেইসবুক, ইউটিউবের নামই শুনিনি। বাদল ভাই প্রতিক্রিয়া নেওয়ার দায়িত্বটা আমাকে দিলেন। তিনি ক্যামরা কাঁধে ভিডিও ধারণ করলেন। তখন তাঁর ভিডিও–এর ব্যবসা ছিল। চট্টগ্রাম নিউমার্কেটে দোকান ছিল। একুশের প্রথম প্রহরে মানুষ নগ্ন পায়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান গাইতে গাইতে ফুল দিচ্ছিল, আমি ক্যামরার সামনে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে ঝাল–মুড়ি–বাদাম বিক্রেতা, ফুল বিক্রেতা, রিকসাওয়ালা— নানান মানুষের সঙ্গে কথা বললাম। একুশের প্রথম প্রহর, একুশের সংকলন, ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২ সাল— এসবের কিছুই জানে না। তাদের জীবনে এর কোনো মূল্যই নেই, সেদিন খুব ভালোভাবে টের পেয়েছিলাম। জননেতা আতাউর রহমান কায়সারেরও তখন একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, এসব মানুষ উৎসবের ভেতরে থেকেও বিচ্ছিন্ন কেন? তারা জানে না কেন এতো মানুষ একুশের প্রথম প্রহরে শহিদ মিনারে এলো। তারা বেচা–বিক্রি নিয়েই ব্যস্ত। বাদল ভাই সম্পাদনা করে সুন্দর একটা ডকুমেন্টরি তৈরি করেছিলেন। ‘ডিডিও ডকুমেন্টরি’টা কোথাও প্রদর্শিত হয়নি। আজকের দিনে হলে ভালো প্রচার পেত। একুশের প্রথম প্রহরে একুশের সংকলন নিয়ে তখন খুব উত্তেজনা অনুভব করতাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার