মাতৃভাষা বাংলাকে আশ্রয় করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর আত্মজাগরণের সূচনাবিন্দু বলতে হয় একুশের চেতনা। অবাঙালি উর্দুভাষী নেতৃত্বের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ধারাবাহিকতায় উনিশশো বায়ান্নের বিশে ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত সে-চেতনাতেই স্পন্দিত। তাইতো পরদিন (একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বেই ভঙ্গ করা হয় একশ চুয়াল্লিশ ধারা। আর আমরা পাই ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। সেদিনেই অর্থাৎ ঐ উনিশশো বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি রাতেই একুশের সাহিত্যের সূচনা ঘটে চট্টগ্রামে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে। এ গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের সত্তর বছর পরও একুশের বিস্তৃত পটভূমি সম্পর্কে কোনো একাডেমিক কাজ কিংবা একক কোনো মৌলিক গবেষণা কর্ম যখন আমাদের সামনে নেই, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে ইলু ইলিয়াস কর্তৃক সম্পাদিত হয় ‘একুশের পটভূমি ও সাহিত্য-রূপ’ শীর্ষক পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভ। একুশের সাহিত্যের সাথে একুশের গবেষণায়ও চট্টগ্রামের অগ্রগামী অবদান আমাদের অহংকার বৈকি।
বর্তমান বিশ্বে বেশিরভাগ গবেষক যেখানে বাজারমুখী-জোয়ারমুখী, সেখানে স্রোতের বিপরীত দিকে যাত্রী সামান্য অবশিষ্ট আছেন বটে। বর্তমান গ্রন্থকার ড. ইলু ইলিয়াস এমনই ব্যক্তিত্ব। সরকারি হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধানের গবেষণাগ্রন্থটির প্রকাশকও চট্টগ্রামের আবির প্রকাশনী। একুশের চেতনার স্বরূপ এবং একুশের সাহিত্যের শৈলী সন্ধান করতে চাইলে বইটি পড়া আবশ্যক। বইটির ‘অবতরণিকা’য় লেখক যথার্থই বলেন, ‘অমর একুশের রক্ত-উজ্জ্বল দ্রোহী চেতনার অভিঘাতেই উৎসারিত ও বিকশিত হয় বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা, সংঘটিত হয় স্বাধিকার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ, অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র-বাংলাদেশ।’ অথচ একুশের আলোচনা থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাদ দিতে বাংলাদেশের কতিপয় গ্রন্থকার ভাষা-আন্দোলনকে ‘মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ প্রমাণে মরিয়া । গবেষক তাই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন : ‘ভাষা আন্দোলন কি অরাজনৈতিক? … বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন রাজনৈতিক পণ্ডিত এই কথা ভাবলেন কী করে?’ (পৃ.১২)। অন্যদিকে একুশের পটভূমি অনুসন্ধানে অধিকাংশ আলোচকই যেখানে ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ পর্যন্ত পৌঁছান, সেখানে ইলু ইলিয়াস তুলে আনেন: ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে হান্টার কমিশন তথা এডুকেশন কমিশন-এ বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা সম্পর্কে আবদুল লতিফের ভাষ্য থেকে শুরু করে ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ (১৯৪৩) ও ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ (১৯৪৪) এর তথা আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখের ‘পুঁথিসাহিত্যের’ বুনিয়াদে পূর্ব পাকিস্তানের মোসলমানী বাংলা ভাষা প্রণয়নের প্রয়াস। গবেষক প্রমাণ করে দেন এদের বিপরীতে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, সৈয়দ মুজতবা আলী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ পণ্ডিতগণের যুক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধের পাঠকগণ কীভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ার আনেন। তাইতো গবেষকের বিবেচনায়: ‘অমর একুশে উৎসবিহীন কোনো অসংলগ্ন, আকস্মিক ঘটনা নয়-এর পটভূমিকায় নানা মাত্রায় সংগোপনে ও সুপ্রত্যক্ষরূপে নিয়ত সক্রিয় থাকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষা বিতর্কসহ সংলগ্ন সকল ঘটনাপ্রবাহ’ (পৃ. ১৫)। সেকারণেই তিনি শতাধিক পৃষ্ঠাব্যাপ্ত প্রথম অধ্যায়-এ একুশের পটভূমি বিশ্লেষণকে সুবিন্যস্ত করেছেন এভাবে:
ক. বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বিতর্ক: উৎসগত ইতিহাস ও বিতর্কের বিস্তার
খ. বাঙালি মুসলমানের জাতীয় ভাষা বিতর্ক
গ. ভারতের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ: উর্দু-হিন্দির সংঘাত ও বাংলার দাবি
ঘ. লাহোর প্রস্তাবোত্তর পরিস্থিতি: প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ
ঙ. পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা-রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রসঙ্গে অবাঙালি সরকারের সংগোপন ষড়যন্ত্র ও পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন জনগণের সোচ্চারদাবি এবং আন্দোলনের আয়োজন
চ. পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব: শাসক শ্রেণির প্রত্যাখ্যান ও পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতার প্রত্যক্ষ আন্দোলন
ছ. বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের সরকারি উদ্যোগ: ছাত্র-যুবসমাজ ও শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিরোধী ভূমিকা ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নবপর্যায়
জ. পাক- প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণা-একুশের প্রস্তুতি ও প্রত্যয়
ঝ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ছাত্রসভা, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও রক্তস্নানে উদ্ভাসিত অমর একুশ।
দ্বিতীয় অধ্যায়-এ পঁচাশি পৃষ্ঠাব্যাপী বিশ্লেষিত হয়েছে স্বাধীনতা পূর্বকালে রচিত ও প্রকাশিত একুশের সাহিত্যরূপ এবং তৃতীয় অধ্যায়-এ স্বাধীনতা উত্তরকালে (২০০২ পর্যন্ত) রচিত ও প্রকাশিত একুশের সাহিত্যরূপ । তবে সাহিত্যরূপ আলোচনায় লেখক গল্প, উপন্যাস, নাটক ও কবিতা নিয়ে আলোচনা করলেও যাত্রাপালা, গান, ছড়া ও প্রবন্ধসাহিত্য নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে গেছেন। এবিষয়ে আরও একাধিক গবেষণা হতে পারে। ত্রিশ পৃষ্ঠা ব্যাপ্ত পরিশিষ্ট-তে সংযুক্ত হয়েছে ভবিষ্যৎ গবেষকগণের আগ্রহের উপাদান: ‘একুশের সাহিত্য : একটি পরিসংখ্যানগত প্রাথমিক জরিপ’(১৯৫২-২০০২) পঞ্চাশ বছর ধরে রচিত একুশের সাহিত্যের প্রত্যক্ষ প্রমাণ তুলে ধরে গবেষক দেখান: একুশের কবিতা লেখক কবির সংখ্যা মাত্র ১৩৪ জন আর তাঁদের লেখা একুশের কবিতা মাত্র ২৪৯ টি। গবেষক মনে করেন যে, ঐ সময় পরিধিতে বড়জোর আরও পঞ্চাশটি কবিতা পাওয়া গেলে এর সংখ্যা তিনশত হতে পারে তবে কোনো মতেই সংখ্যাতীত বা হিসাবের বাইরে নয়; যেমনটি বলেছেন বিশ্বজিৎ ঘোষ তাঁর ‘অমর একুশের পঞ্চাশ বছর: বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের প্রতিফলন’ শীর্ষক প্রবন্ধে। এমনি আরও অনেক প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতগণের প্রচলিত মন্তব্যের অসারতা পাঠকের সামনে উন্মোচিত হবে গ্রন্থটি পাঠের মাধ্যমে। গ্রন্থটির সাথে গ্রন্থপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট সংযুক্ত থাকায় গবেষকগণের কাছে এটি একটি আকর গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করবে। আবার লেখকের ভাষার সাবলীলতা গুণে সাধারণ উৎসুক পাঠকের কাছেও বইটি আকর্ষণীয় মনে হবে। সুন্দর প্রচ্ছদ আর মজবুত বাঁধাইয়ের বইটি সাধারণ বাঙালির সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করবে এবং এর পাঠককে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
[একুশের পটভূমি ও সাহিত্যরূপ : ইলু ইলিয়াস। প্রকাশক : আবির প্রকাশন, চট্টগ্রাম। প্রচ্ছদ : টিপলু বড়ুয়া। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৩৬৮ পৃষ্ঠা, মূল্য ৫০০ টাকা।]
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা, সিইউএফ কলেজ