একালের গল্প সেকালের ঘটনা

মু. সিকান্দার খান | রবিবার , ৪ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

রেষারেষির একাল-সেকাল
এক সময় চট্টগ্রাম শহরে শুধু দু’টোই সরকারি বিদ্যালয় ছিল- কলেজিয়েট আর মুসলিম হাই স্কুল, পরস্পর থেকে মাত্র মাইল খানেক ব্যবধানে। এদের ভেতরকার খবর পরস্পরের মধ্যে জানাজানি হতে কিছু সময় লাগতনা। বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল আর আন্তঃস্কুল ফুটবল এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বিষয়ের ফলাফল নিয়ে ভেতরে ভেতরে একধরনের প্রতিযোগিতার পরিবেশ পাল্টাপল্টি- উভয় স্কুলে ছাত্রশিক্ষকদেরকেও প্রভাবান্বিত করত। এ দু’টো স্কুল নিয়ে শহরবাসীও যেন দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। কেউ কেউ কলেজিয়েটের সাফল্যে উচ্ছাসে ফেটে পড়ত; অন্যদের একই রকম মুসলিম হাই স্কুলের সাফল্যে প্রকাশ্যে উল্লসিত হতে দেখা যেত। সেবার আন্তঃস্কুলের ফাইনাল জিতে ফুটবলে মুসলিম হাই স্কুল প্রাদেশিক শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি ফিরোজ খান নূন শিল্ড জিতেছিল। পরের বছর ঢাকা বোর্ডের প্রবেশিকা পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল কলেজিয়েট স্কুল। এ ধরনের সাফল্যে এ দু’টি স্কুলের মধ্যে অভিনন্দন বিনিময় করা হত আনুষ্ঠানিকভাবে। উভয়ের নিকট অবস্থানের জন্য সুকীর্তি অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যকার একটি সুস্থ মনোভাব সবার কাছে প্রশংসা পেত। এমন একটি পরিবেশেও একজনের দুর্বলতার বিষয় অন্যের চোখ এড়াত না। সাধারণ শহরবাসীরা যেন এগুলো নিয়েই বেশি সরব থাকত।
এই দু’স্কুলের যেটির প্রধান শিক্ষক চাকরিতে সিনিয়র হতেন তাঁকেই দেয়া হত প্রবেশিকা পরীক্ষার চট্টগ্রাম কেন্দ্র প্রধানের দায়িত্ব। এ দুই সরকারি স্কুলের পরীক্ষার্থীদের নিজ নিজ স্কুলে না বসিয়ে একটিকে অন্যটিতে বসাবার রেওয়াজ চালু ছিল। তাতে সুবিধা-অসুবিধা দুই’ই হত। আমরা ছাত্ররা অসুবিধাটাই বেশি করে দেখতাম। সারাবছর সবকিছুতে প্রতিযোগী হওয়ার কারণে অনেক সময় অহেতুক অভিযোগ করা হতো যে কক্ষ পরিদর্শকবৃন্দ প্রতিযোগী স্কুলের পরীক্ষার্থীদের প্রতি প্রহরায় মাত্রাতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ করেন। শিক্ষক মহোদয় কিছু পক্ষপাতিত্ব না করলেও অনেকে প্রায় বিশ্বাস করতো যে এক স্কুলের শিক্ষক প্রতিদ্বন্দ্বী স্কুলের পরীক্ষার্থীকে লঘু দোষেও শাস্তি দিয়ে দেন। এ বিশ্বাস ছাত্রদের মধ্যেও সংক্রমিত হত। প্রবেশিকা পরীক্ষা আসতে আসতে দুশ্চিন্তার অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে এটিও আমাদের মানসিক শান্তি বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াত। কেউ এমনও বিশ্বাস করতো যে, এক স্কুলের ছাত্র শাস্তিযোগ্য অপরাধের জন্য বহিষ্কৃত হলে অন্য স্কুল থেকে তার পরিবর্তে যেকোনো একটি ছাত্রকে একই শাস্তি দেয়া হতো। তার জন্য অজুহাতের কখনো অভাব হতো না।
পরিস্থিতি যখন এমন সেসময় ভোলা সরকারি বিদ্যালয় থেকে আমাদের স্কুলে বদলি হয়ে এলেন প্রধান শিক্ষক জনাব জি. এম. ফররুখ। তিনি হেডমাস্টার হিসেবে সিনিয়র হওয়ার কারণে কেন্দ্র প্রধানের দায়িত্ব পেলেন। আমাদের স্কুলের পরীক্ষার্থীরা স্বস্তি বোধ করেছিলাম। কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রেও এর সুফল আমরা পাব। নভেম্বরে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে প্রায় মাস তিনেক পাওয়া যেত প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। এ ক’মাস স্কুলের সঙ্গে খুব যোগাযোগ থাকত না। পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশিত হলে আমরা নিজ নিজ স্কুলে গিয়ে সেটা সংগ্রহ করতাম। সময়সূচি যদিও সববছর প্রায় একই রকম হতো তবুও সেটা পাওয়ার আগ পর্যন্ত চিন্তিত থাকতাম, বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে কি রকম অবকাশ দেয়া হচ্ছে তা নিয়ে। এবার সে সূচি জানতে গিয়ে আরও একটা সুখবর পেয়ে গেলাম। আমাদের কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে কলেজিয়েট স্কুলের জায়গায় মিউনিসিপাল হাইস্কুল হয়েছে। বুকের উপর থেকে যেন ভারি একটা পাথর সরে গেল!
পরীক্ষার প্রথম দিনে দেখলাম এইটি কলেজিয়েট স্কুলেরও কেন্দ্র। আমাদের উভয় স্কুল বিভিন্ন কক্ষে একসঙ্গে সিট বরাদ্দ পেয়েছে। অবশ্য, দুই স্কুলের পরীক্ষার্থীদের পরস্পরের দ্বারা আড়াল করা হয়েছে। এতে করে পরস্পরের মধ্যে আলাপ কিংবা দেখাদেখি করার প্রবণতাও প্রতিরোধ করা হলো। আমাদের অবশ্য এমনিতেই পরীক্ষায় এ ধরনের অসদাচরণ ছিল না। প্রথম কদিন দুই বেলা পরীক্ষা ছিল। দুপুর ছুটির সময় দ্বিতীয় বেলার পরীক্ষার বিষয়ের বই বা নোট আরেকবার ঝালাই করে নেয়ার সুযোগ থাকত। তখন নিজ স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে প্রস্তুতি সেরে নিতাম।
সেদিন সকালে ইতিহাস আর বিকালে ভূগোল। দুটোই বেশ দীর্ঘ কোর্স। প্রশ্ন বাছাই করে প্রস্তুতি নিয়েছি দুটোর জন্য। তারপরও এই মধ্যাহ্নকালীন অবকাশে শেষবারের মতো আবার চোখ বুলিয়ে নেয়ার অভ্যাস আমাদের দুই স্কুলে পরীক্ষার্থীর মধ্যে বেশ প্রবল ছিল। ভূগোলের জন্য পরীক্ষায় বসার আগে আমরা কয়েকজন আলোচনা করে পড়তে বসেছি। ভূগোলের প্রশ্নপত্রের দুটো প্রশ্ন সেকালে প্রায় আগে থেকেই আমরা অনুমান করতে পারতাম। সব বছরই একটা মানচিত্র অংকন এবং কোন একটা দেশের ভৌগোলিক বিবরণ- এই প্রশ্ন দু’টি অবশ্য থাকতো। মানচিত্র প্রশ্নে পূর্ব অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের মানচিত্র অঙ্কন করতে দেওয়া হতো। এ দুটি পালাক্রমে এক এক বছর এক একটা আসত। ভৌগোলিক বিবরণের জন্য সাধারণতঃ এশিয়া অথবা আফ্রিকা মহাদেশের কোন একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশের উপর প্রশ্ন সীমাবদ্ধ থাকত। যারা ভূগোলে লেটার মার্ক পাওয়ার আশায় থাকতাম তাদের জন্য এ দুটি প্রশ্ন ভালো নম্বর পাওয়ার প্রধান উপায়।
ইতিহাস ভূগোল এর পরীক্ষার দিন ছিল বৃহস্পতিবার। পরের দিন শুক্রবার সাপ্তাহিক বন্ধ। সুযোগ বুঝে রাতজেগে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রথম বেলার ইতিহাসের পরীক্ষা বেশ ভালো হয়েছে। লেটার মার্ক পেতে পারি। বিকালে ভূগোলের পরীক্ষা। মধ্যাহ্ন অবকাশে আমাদের স্কুলের পরীক্ষার্থীরা নিজ নিজ স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো আলোচনা করে টাটকা করে নিচ্ছি। ভূগোল বিষয়ে কোন দেশের ভৌগোলিক বিবরণ এর উপর প্রশ্নের জন্য বাছাইকৃত দেশগুলো দলের একজন দেশের নাম বলে উঠলে দলের আরেকজন সেটার রাজধানীর নাম, আরেকজন প্রধান বন্দরের নাম, আরো একজন প্রধান প্রধান শহরের নাম বলে যাচ্ছি। এভাবে পৃথিবীর মুসলিম অধ্যুষিত প্রায় সব দেশের বিবরণ আলোচনা শেষ করেছি। ঘণ্টা বাজলে আমাদের প্রস্তুতি শেষ করে সিটে গিয়ে পরীক্ষায় বসেছি।
প্রশ্নপত্র হাতে এলেই দোয়া দরুদ পাঠ করে খুলে দেখি ভৌগলিক বিবরণ লিখতে দিয়েছে তুরস্কের। মাথায় বাজ পড়লো। আমরা এতগুলি দেশ পড়েছি তার মধ্যে তুরস্ক ছিলনা। কারণ, আমাদের ভূগোল বইতে তুরস্ককে এশিয়ায় নয়, ইউরোপ অংশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই বইয়ে এশিয়া মহাদেশ অংশের একেবারে শেষ দিকে দেশ হিসেবে তুরস্কের উল্লেখ রয়েছে। আর ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ দিয়ে লিখেছে “ইউরোপ অংশে দেখ”। আমরা কেউই ইউরোপ অংশ আর খুঁজে দেখিনি। পরীক্ষার জন্য একটা সিওর প্রশ্ন জেনেও উত্তর শেখা হয়নি। এরকম আশা ভঙ্গ হয়ে আমি খুবই নার্ভাস হয়ে পড়লাম। এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পুরো বিষয়ে লেটার পাওয়ার ব্যবস্থা এগিয়ে রাখার সুযোগ ছিল। এখন কি হবে? প্রশ্নপত্রের অন্যান্য প্রশ্নগুলোর উত্তর বেশ তৈরি করা আছে। কিন্তু একটা শিওর প্রশ্ন না পেয়ে সব বানচাল হয়ে গেল।
মনকে নানাভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে প্রকৃতস্থ হওয়ার চেষ্টায় মিনিট পাঁচেক গেল। হঠাৎ মনে পড়লো আমাদের যেমন, কলেজিয়েট স্কুলের দলের সেই দুপুরের প্রস্তুতি সভায়ও ‘তুরস্কের’ নাম শুনিনি। কেন জানিনা, একথা মনে পড়তেই এক ধরনের প্রশান্তি নেমে এল সারা মন-প্রাণ জুড়ে! নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে এক গ্লাস পানি চাইলাম পরিদর্শক মহোদয়ের কাছে। তিনি নিকটে এসে দপ্তরির হাতে আমাকে পানি দিলেন। পানি পান করে বসবো এমন সময় একরকম উৎসাহ দেয়ার ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘তুমি এখনো লেখা শুরু করনি কেন?’
আমার মন তখন সবকিছু ছাপিয়ে কলেজিয়েটের দলের কেউই এ প্রশ্নটি কমন পাচ্ছেনা অনুভূতিটা জোর কাজ করছে। সম্ভাব্য লেটার না পাওয়ার ক্ষতি উভয়ের ক্ষেত্রে একই রকম! নিজের দুঃখ ভুলতে বেশিক্ষণ লাগলো না। সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতস্থ হয়ে উঠলাম! ভৌগোলিক বিবরণ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গোটা গোটা নম্বর পাবো না, কিন্তু অন্য প্রশ্নগুলোর উত্তরে যা নম্বর উঠে তাতো হারাবো না। স্কুলে স্কুলে রেষারেষির প্রভাবে মনে মনে কিশোর বয়সে আমরাও কখন আক্রান্ত হয়েছি বুঝিনি। বড় হয়ে এখন ভাবি জীবনের কোন ক্ষেত্রে এরকম প্রভাব কি এতোটুকুও শিথিল হয়েছে? নাকি, শুধু ক্ষেত্র পরিবর্তিত হয়েছে?
লেখক : শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধএকাত্তরে আলমগীর