একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির অধিকার আদায়ের যুদ্ধ

মোঃ খোরশেদ আলম | শনিবার , ২৮ মে, ২০২২ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ধর্মযুদ্ধ আর জনযুদ্ধ এক কথা নয়। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা:) এর আমলে ওহুদের যুদ্ধ, বদরের যুদ্ধ খায়বার যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধ সহ বহু ধর্মযুদ্ধের নজির আছে যে যুদ্ধ ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহতালার হুকুমে নবী মোহাম্মদ (সা:) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু বিপথগামী তথাকথিত আলেম- ওলামা মুক্তিযুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুসলমাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে ব্যর্থ চেষ্টায় বিভ্রান্তির ধুম্রজাল বুনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমানরা সেটা প্রত্যাখান করেন। মাত্র ৫% মানুষ এর পক্ষে ছিল। ঐ সময় এদেশের একটি ইসলামপন্থী দল (জামাত ইসলাম) মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বা হিন্দু-মুসলমানদের ধর্মীয় যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক ন্যারেটিভ বা বয়ান রয়েছে ভারত পাকিস্তান তাদের নিজস্ব দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাখ্যা করে। ওই দেশের ঐতিহাসিক গ্রন্থ বা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য পর্যালোচনা করলে তার স্বাদ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বয়ান রয়েছে। ওই বয়ানগুলোর মধ্যে অনেক প্রভাবশালী বয়ানকারীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইসলাম ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করতে সর্বদা সচেষ্ট। এক সময় তারা আমাদের মা বোনদেরকে গনিমতের মাল হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
ইসলাম ধর্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করার ওই বয়ানের বিপরীতে ইসলামপন্থীদের শক্তিশালী কোনো যুক্তি নেই। তথাকথিত রাজনৈতিক ওলামাদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও এদেশের আম-জনতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা আল কোরআন ও আল হাদিসের নানা আয়াতের অপব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাফের ঘোষণা করা সত্ত্বেও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা দলে দলে দেশমাতৃকার স্বাধীনতায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। ফলে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের সঙ্গে রাজনৈতিক ওলামা ও তাদের ইসলাম ধর্মের পক্ষে দেয়া ফতোয়াবাজীর রাজনীতির পরাজয় ঘটে।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, ধার্মিক মুসলিম মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেছেন বলেই বাংলাদেশকে ইসলামী শরিয়া মতো পরিচালিত করা হবে রাজনৈতিক ওলামাদের এমন দাবী যৌক্তিক হলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কারণে যদি কোনও ধার্মিক হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান দাবী করেন যে তাদের ধর্ম মতে বাংলাদেশ পরিচালিত হবে তবে তাদের সেই দাবী কেন যৌক্তিক হবে না? কারণ, ’৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে ইসলাম ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী মুসলিমদের মতো হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারীরা দেশমাতৃকার জন্য জীবনবাজি রেখে লড়েছেন।
আমাদের দেশে ইসলামীপন্থী দলগুলো প্রায়শ বক্তৃতা বিবৃতিতে দাবী করে আসছেন যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত হতে সরকারকে আলেম ওলামাদের পরামর্শ মতো দেশ পরিচালনা করতে হবে। ইসলামের রীতি মেনে দেশ চলবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের অনেক আলেম ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলিম মুক্তিযুদ্ধের জন্য লড়েছেন প্রাণ উৎসর্গ করেছেন এমন ইতিহাস তুলে ধরে তারা ইসলাম শরিয়ত মতে দেশ পরিচালনা করাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দাবী করছেন।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের থিসিস বলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের দাবী মতো বাংলাদেশ যেমন তাদের ধর্মীয় আইন দ্বারা পরিচালিত হবে না বা হওয়াটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না। তেমনি রাজনৈতিক ওলামাদের দাবী মতো বাংলাদেশ ইসলামী শরিয়া মতো পরিচালিত হওয়ার দাবিও যৌক্তিক নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পন্থিও নয়।
রাজনৈতিক ওলামাদের দাবি মতে সেদিনের মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। আরবদেশগুলো ইসলামী বিপরীতদের মতে আল কোরআন ও আল হাদিসের বা শরিয়া আইন বাস্তবায়নের জন্য লড়েননি। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ কোনও ইসলামী বিপ্লব ছিল না বা ধর্ম যুদ্ধ ছিল না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির অধিকার আদায়ের যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই যুদ্ধে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিলেন। শুধু ইসলাম ধর্মের নয়। অন্য কোনও ধর্মের সঙ্গেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কোনও বিরোধ ছিল না। অথবা অন্য কোনো ধর্মীয় মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। বরং সকল ধর্মীয় মতকে উদারভাবে গ্রহণ করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করে মানুষের অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে ইসলাম ধর্মের অনুসারী ধার্মিক মুক্তিযোদ্ধারা দেশ গঠনের জন্য ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদেশের মাটিতে বিরল সম্মান
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে