একাত্তরের কথা

আখতারুল ইসলাম | বুধবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ

রতন ক্লাস থ্রিতে। স্কুল থেকে এসে মাকে বলে, মা, মুক্তিযুদ্ধ কী? কী কঠিন কথা। আমার বলতেও অনেক কষ্ট হয়। আজ স্কুলে সেলিম স্যার বলল ১৯৭১ সালে নাকি মুক্তিযুদ্ধ হয়। মা রতনকে থামিয়ে দিয়ে বলে, মুক্তিযুদ্ধ! এখন কত সাল জানিস? আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর পূর্বে আমাদের এ দেশ পাকিস্তানের অংশ ছিল। তখন পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল। বর্তমান পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তান, আর পূর্ব পাকিস্তন ছিল আমাদের এই বাংলাদেশ।
একই দেশের দু’টি অংশ মানে দু ভাগ, আমাদের এই বাংলাদেশের শাসন পরিচালনা করত পাকিস্তানি শাসকেরা। তুমি এখন টিভিতে খবর শোন না, যেমন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা দেশ পরিচালনা করে। তোমার আব্বু ও আমি যেমন আমাদের সংসার দেখাশোনা করি তেমন। কিন্তু ওরা শাসন করলেও ওরা আমাদের প্রাপ্য অধিকারগুলো দিত না। যেমন ধর চাল, ডালসহ বিভিন্ন পণ্য আমাদের দেশে উৎপাদিত হলেও ওরা নিয়ে যেত। ব্যবসা, বাণিজ্য চাকরি সব ক্ষেত্রে ওদের মানুষ। অথচ আমরা ছিলাম জনসংখ্যায় ওদের চেয়ে বেশি। শতকরা হিসেবে আমরা ৫৬ জন ওরা ৪৪ জন। ওরা আমাদের চেয়ে কম হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন বৈষম্য করে হিংসা করত ওদের সাথে আমাদের সব কিছু ভিন্ন ছিল ভাষা, খাবার, পোশাক, সংস্কৃতি?
মা সংস্কৃতি কী?
সংস্কৃতি হলো ভাষা, পোশাক, গান, বাজনা, জীবনধারা সব কিছু সম্মিলিত অংশ।
তুমি শুনলে অবাক হবে সেই ১৯৫২ সালে পাকিস্তানিরা বলছে, আমাদের বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের ভাষা হিসেবে মেনে নেবে না। কিন্তু আমার জন্মের পর যে ভাষায় সব কিছু করি তা আমাদের দেশের ভাষা হবে না, উর্দু হবে নাকি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
জানো বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আছে না, যেখানে অনেক ছাত্র মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল করে। তখন ছাত্রসহ অনেক মানুষকে পাকিস্তানিরা গুলিতে মেরে ফেলে। সেই দিন ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি, যারা মারা যায়। তাদের মধ্যে ছিল সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত আরো অনেকে। সেই থেকে আমরা এই দিনকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করি। এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
রতন মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনছে। রতনের মা বলছে রতন, এখন আর বলব না। আর একদিন বলব। রতন বলছে না, না এখন বল। আজ স্কুল বন্ধ। আমি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনব।
না, না, রতন, কাল তোমার নানুভাই আসবে। তোমার নানু ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা তুমি তার কাছ থেকে সব শুনবে। দাও মা নানু ভাইকে ফোন দাও।
যে কথা সেই ফোন, হ্যালো , নানুভাই তুমি তাড়াতাড়ি এস।
কেন নানুভাই? শোন তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমি তোমার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনব। বুঝেছ। হারুন সাহেব কোন কথা না বলে, বলল, আচ্ছা নানুভাই। রতনের মর্নিং স্কুল। ১১.৩০ এ রতন বাসায় ফেরে। এরপর শুধু অপেক্ষা। অন্যদিন ১২ টার পর তার কাছে ঘুমের পরি এসে হাজির হয়। আজ ঘুম নেই, আজ তার চোখে ঘুম নেই। কী যে এক অদম্য আগ্রহ, কখন সে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনবে। পরদিন ঠিক দুপুরের একটু পরে ২টার দিকে হারুন সাহেব মেয়ের বাসায় এসে হাজির।
নানুভাই আসলে কী উচ্ছ্বাস রতনের? বলে, নানুভাই । তুমি হাত মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। তারপর গল্প। হারুন সাহেব মেয়ে শাহনাজকে বলে কীরে মা, তুই তো বলতে পারতি ওর মাথায় মুক্তিযুদ্ধের কথা চাপল কী করে। আর বল না বাবা, রতনের মা বলে, স্কুলে নাকি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছে। সেই থেকে বাড়ি এসে আমার কান ঝালাপালা শুরু করে। বাধ্য হয়ে আমি শহীদ দিবস পর্যন্ত বলে আর না পারতে তোমাকে খবর দিই। তুমি এমনিতে কম আস। তাই ওর গল্প শোনাও হবে-আমাদের সাথে দু’টা দিন থাকলেও।
খাওয়া দাওয়া শেষে রতন মাকে নিয়ে বসে নানুর গল্প শুনত্ে‌
নানু, তুমি যুদ্ধে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ, নানু ভাই ্‌
কেন?
আবার রতনের প্রশ্ন । শোন ভাষা আন্দোলনের পর (নানুকে থামিয়ে দিয়ে) নানুভাই আন্দোলন কী? আন্দোলন হল, নিজের অধিকার বা কোনো অন্যায় হলে অনেক মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ ও দাবি আদায় করাই হলো আন্দোলন।
আচ্ছা ঠিক আছে, এবার বল, রতন নানুকে বলে।
যখন পাকিস্তনিরা আমাদের ন্যায্য দাবি মেনে নিচ্ছে না। তখন বিভিন্ন সময়ে আমরা আন্দোলন করি। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান ঘটে এবং বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি দেয় ওদেরকে। ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয় তাতে আমরা আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও ওরা আমাদের ক্ষমতা দেয় নি। ওদের সাথে মিটিং আলোচনা কথা বলেছি, ওরা তাতেও রাজি নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশের সকল মানুষের মনে স্বাধীনতার বীজ বুনে দেয়। ধীরে ধীরে তা বিশাল আকার ধারণ করে। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সর্বকালের বিশাল এক জনসভায় বলেন, যার যা আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ! তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
আচ্ছা নানু? রতনের আবার প্রশ্ন? মুক্তি, স্বাধীনতা এগুলো কী? শোন নানুভাই, বল দেখি পাখিরা কোথায় থাকে? কেন নানুভাই গাছপালা বন বাদাড়ে।
শোন, ওখানে ওরা ইচ্ছা মতো সব করতে পারে। হ্যাঁ পারে। আচ্ছা খাঁচায় পাখি পোষা দেখেছ,
হ্যাঁ, পাখি কী ওখানে থাকতে পছন্দ করে? না, সে কি চায় না উড়তে ঘুরতে। ওই পাখি যে ওড়তে ঘুরতে চায় তা হল ওর মুক্তি বা স্বাধীনতা। ঠিক তেমনিও আমরা পাকিস্তানিদের খাঁচায় বন্দি ছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের টানে, দেশের মানুষের মুক্তির কথা বিবেচনা করে পাকিস্তনিদের বিতাড়িত করতে, ওদের শাসন শোষণ থেকে দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধে গিয়েছিলাম।
হারুন সাহেব বলল, দেখ নানুভাই আমার বাম হাতে কাঁধের পাশে গুলি লেগেছিল, রতন ক্ষত স্থানের কালো দাগ দেখে চমকে ওঠে। দাদু এটা কীভাবে হল? তখন নভেম্বর মাস উত্তাল যুদ্ধ। বাংলাদেশের অনেক জেলা শত্রু মুক্ত হয়েছে। আমি আর একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে যারা ছিল শহীদ মাসুদ উদ্দিন, শহীদ আমজাদ আলী, এখনো জীবিত আছে সিরাজ উদ্দিন, মাসুদ উদ্দিন দু’ভাই, হাবিলদার সুজন সেদিন আমরা মহানন্দা নদীর তীরে যুদ্ধ করছি। আমার বন্দুকটা তাক করতে একটু দেরি হওয়াতে গুলি এসে পড়ে আমার কাঁধে।
হাফিজ, মহিউদ্দিন ওরা আমাকে ধরে নিয়ে সেবা করে। ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হই। একদিন তো আমি জানে মারা যেতাম। আমাদের বাড়িতে একজন রাজাকার ছিল?
রতনের আবার প্রশ্ন, রাজাকার কী?
হারুন সাহেব বলল, হ্যাঁ বলছি। যারা বাংলাদেশের মানুষ হয়েও বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, যারা পাকিস্তানিদের বন্ধু হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পৌঁছে দিত, পাকিস্তানিদের হাতে, নারীদের নির্যাতন করতে সুযোগ করে দিত। পাকিস্তানিদের পথঘাট চিনিয়ে দিত, পাকিস্তানিদের দোসর।
আচ্ছা নানু তুমি বললে যে জানে বেঁচে এসেছ কী ভাবে?
ছুফুর আলী ছিল আমাদের পূর্ব বাড়ির মানুষ। সে পাকিস্তানিদের বন্ধু ছিল। আমি একদিন বাড়িতে এলে সে টের পেয়ে যায়। সে পাকিস্তানিদের খবর পাঠায়। সাথে সাথে মিলিটারি বাড়িতে এসে হাজির। আমি কী করি, আঁচ করতে পেরে পিছনের কচুরিপানা ওয়ালা পুকুরে পানির মধ্যে শুধু চোখ নাক খোলা রেখে, মুখ বন্ধ করে ডুবেছিলাম ৬ ঘন্টা। ভাগ্য ভালো যে তোমার নানি ছিল অন্য বাড়িতে ঘরে আর কেউ ছিল না। শেষে ওরা কাউকে না পেয়ে আমাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় যা আমার চোখের সামনে দেখা।
আচ্ছা নানুভাই তোমার ভয় করেনি কেন?
মুক্তিযোদ্ধাদের দেশকে ভালোবাসা ছাড়া কোনো ভয় ছিল না।
সেজন্য মনে হয় আমাদের স্যার বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্ত্বান বলেছে।
হ্যাঁ নানু ভাই, তোমার স্যারেরা ঠিকই বলেছে।
রতন মাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, মা। হ্যাঁ, জানো মা তুমি কতো ভাগ্যবান তুমি একজন শ্রেষ্ঠ মানুষের সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
হ্যাঁ খোকা আমি আমার বাবাকে নিয়ে গর্ব করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা
পরবর্তী নিবন্ধমিশে আছে ওরা