একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের চা শিল্প

আজ জাতীয় চা দিবস

আমিনুর রশীদ কাদেরী | শুক্রবার , ৪ জুন, ২০২১ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

আজ ৪ জুন ২০২১। বাংলাদেশ চা শিল্পে এক অবিস্মরণীয় দিন। আজ হতে ৬৪ বছর আগে ৪ জুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি ৪ জুন ১৯৫৭ খ্রিঃ থেকে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ খ্রিঃ পর্যন্ত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন। চা শিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় চা বোর্ড ভবন, শ্রীমঙ্গলে একটি চা গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন, লাইব্রেরী স্থাপন, অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, আবাসন, রেশন প্রদানের সুযোগ সুবিধা চালু করেন। চা শিল্প নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন। তাই চা বাগানের মাটি পরীক্ষা, রোগ বালাই দমন, চা ক্লোনিং করে উন্নত জাতের চা সমপ্রসারণ আবাদ এবং উন্নত বীজ বপনের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে আজ বাংলাদেশে উদযাপন করা হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় চা দিবস।
একবিংশ শতাব্দীতে কেমন হতে পারে বাংলাদেশ চা শিল্প? চা শিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমরা কি সেই স্বপ্নের দেশে পৌঁছাতে পারবো? একবিংশ শতাব্দীর চা শিল্পে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়নের পথ নকশা নিয়ে ভাবতে আজ ভীষণ ইচ্ছা জাগে মনে।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে অষ্টাদশ শতাব্দী আবিষ্কারের যুগঊনবিংশ শতাব্দী শোষণের যুগ এবং বিংশ শতাব্দী বিপ্লবের যুগ (কিন্তু, কি বিশ্লেষণে অভিষিক্ত করা হবে একবিংশ শতাব্দীকে? একবিংশ শতাব্দী কি অজানা অচেনা’ই রয়ে যাবে? বিশ্বের ৬০০ কোটি আদম সন্তান বুকে ধারণ করে একবিংশ শতাব্দীর সোনারতরী আমাদের কোথায়, কোন নিরুদ্দেশে নিয়ে যাচ্ছে?
অক্সফোর্ডের বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ডেবিড মারকোয়ান্ড একবিংশ শতাব্দীকে ‘Joureney to an unknown destination’ হিসেবে অভিহিত করে লিখেছেন, একবিংশ শতাব্দীতে কোন রাষ্ট্রীয় বেড়া থাকবে না। পরিবার, সমাজ, পেশা, শ্রমশক্তি সবকিছুর চেহারা বদলে যাবে। শিক্ষা পদ্ধতি, ব্যবসা বানিজ্যের প্রচলিত পদ্ধতি বিলুপ্ত হবে। আগামী পৃথিবীতে নতুন এক সমাজ সৃষ্টি হয়ে নতুন শতাব্দীর মানুষ একই বিশ্বপল্লীর নাগরিকত্বের সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন। কৌলিন্য ও আভিজাত্য প্রদর্শনের অবকাশ আর থাকবে না। পুরানো এলিট হবে সিংহাসনচ্যুত। অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সবকিছুতে নয়া ব্যক্তি স্বতন্ত্রবাদ অগ্রাধিকার পাবে। নতুন বিশ্বপল্লীর শক্তির উৎস হবে তথ্য প্রযুক্তি। অকল্পনীয় শক্তি ও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে একবিংশ শতাব্দী তথ্য প্রবাহের যুগ হিসাবে আবির্ভাব হবে।
একবিংশ শতাব্দীর তথ্য প্রবাহের যুগে চা-শিল্পের বিপণন ও রপ্তানীতে ইন্টারনেট, ই-কমার্স, ই-বিজনেস, সুযোগ সদ্ব্যবহার করে বাংলাদেশের চা সরাসরি বিদেশে রপ্তানীর সুযোগ হবে। বিশ্বের কোন প্রান্তে কি ধরনের চায়ের চাহিদা আছে তা অবগত হয়ে ভোক্তার দেশের সংরক্ষিত গুদাম হতে তাৎক্ষণিকভাবে পণ্য সরবরাহের অফুরন্ত সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রচলিত Tea Auction System আমূল পরিবর্তন হবে। সঠিক মূল্যে চা বিক্রয়ের সুযোগ পেয়ে উৎপাদক চা শিল্প সম্প্রসারণে আরো উৎসাহিত হবেন। এতে বিনিয়োগ বাড়বে।
উপমহাদেশের প্রয়াত বিজ্ঞানী ড.জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর এক প্রবন্ধে অভিমত প্রকাশ করেছেন, ‘বিগত বিংশ শতাব্দী ছিল পদার্থবিদদের শতাব্দী, একবিংশ শতাব্দী হবে জীব বিজ্ঞানীর শতাব্দী’। ক্লোন প্রযুক্তি, টিস্যু কালচার, জীন প্রযুক্তি, শংকরায়নের মাধ্যমে জীন ও উদ্ভিদ জগতে উন্নত জাত উদ্ভাবনের ফলে উৎপাদনে বিস্ফোরণ হবে। একবিংশ শতাব্দীর জীব প্রযুক্তির সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চা শিল্পে অকল্পনীয় উন্নতি হবে। চায়ের নতুন নতুন প্রকরণ সৃষ্টি হবে । উচ্চফলনশীল চা, খরাসহিষ্ণু চা, গাঢ় লিকারযুক্ত চা, সৌরভময় চা, টিস্যু কালচারে বিভিন্ন প্রজাতির চা আবিষ্কৃত হবে। উদ্ভিদের অতি ক্ষুদ্র কোষ জীবাণুমুক্ত অবস্থায় টেস্ট টিউবে লালন পালন করে ব্যাপকভাবে পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদ জন্মানোর অপর নাম টিস্যু কালচার। ইতোমধ্যে চায়ের ভেজিটেটিব প্রোপাগেসনে উদ্ভাবিত ক্লোন চা এবং বাইক্লোন, পলিক্লোন চা বীজ উৎপাদন শুরু হয়েছে। আগামী শতাব্দীতে টেস্ট টিউবে উৎপাদন, শংকরায়ন, জীন প্রকৌশল সমন্বয়ে উন্নত ট্রানসজেনিক জাতের উচ্চ ফলনশীল চা আবিষ্কার ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাবে। একবিংশ শতাব্দীর তথ্য প্রযুক্তি এবং জীব প্রযুক্তির যাবতীয় সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চা শিল্প এগিয়ে চলবে আপন গতিতে। বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির আশীর্বাদে আগামী শতাব্দীতে মানুষের আর্থ-সামাজিক বিবর্তন আসবে। বর্তমানে প্রচলিত কালো চায়ের পরিবর্তে সবুজ চা, জেসমিন চা, হিমেল চা এবং অর্গানিক চায়ের চাহিদা বেড়ে যাবে। আগামীতে চা-কোলা চা-স্কোয়ার্স, চা-কেক প্রচলন শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। জাপান, আমেরিকায় ইতোমধ্যে চা-কোলার প্রচলন শুরু হয়েছে। বরফ প্রধান অঞ্চলের জনগণের কাছে চা-কেক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এমনিতে বাংলাদেশ হুজুগে চলার দেশ, নতুন কিছু দেখলেই তা করায়ত্ত করতে চায়। আর দেরী নাই, শীতল তৃপ্তিদায়ক চা- কোলা বাংলাদেশের গ্রীষ্মের দুপুর শীতলতায় ভরিয়ে দেবে। রোগ নিরাময়ে চয়ন করা সবুজ কুঁড়ির প্রচলনের কথাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না । চীনে সব্জী হিসাবে চা ব্যবহারের সু-দীর্ঘ পথ অতিক্রান্ত করার পরও এখনো কোন কোন অঞ্চলে চা কুঁড়ি সব্জী হিসাবে পছন্দনীয়। বাংলাদেশের চা- শ্রমিকদের মধ্যে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসাবে চায়ের সবুজ পাতার, ভর্তা ও সালাদ খাওয়ার প্রচলন আছে।
নতুন শতাব্দীতে চায়ের বহুমাত্রিক ব্যবহার শুরু হবে। চা- উপজাত পণ্য (Tea waste) দিয়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ভেজিটেটিব ডায়িং, চিংড়ি চাষে চা বীজের ব্যবহার , ওষুধ ও প্রসাধন শিল্পে চায়ের নতুন নতুন ব্যবহার শুরু হবে। ইতোমধ্যে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, চা ক্যান্সার রোগে রেডিয়েশনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিরাময়ে সক্ষম। চায়ে ট্যানিন থাকায় নিয়মিত চা-পানে শরীরে ভিটমিন সি- ধারণ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বেড়ে যায়, ফলে চুল ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। চায়নীজ সোসাইটি অব-মেডিসিন এর গবেষণায় উল্লেখ আছে, চোখের অসুখ, ডায়াবেটিস, ডায়রিয়া, নিরাময়ে চা সহায়ক। সবুজ চা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিরাময় করে। নিয়মিত চা পানের ফলে শরীরের মেদ বিতাড়িত করে। শ্বাস প্রশ্বাসের জটিলতা নিরাময়, শীতের শ্লেষ্মা, কফ, সর্দি কাঁশিতে চায়ের হাল্কা লিকার উপকারী পথ্য। চীনে প্লেগ ও করোনা উপশমে চা অব্যর্থ ওষুধ হিসাবে বিবেচিত।
নতুন শতাব্দীতে চায়ের এসব ভেষজ গুণাবলীর আরো ব্যাপক গবেষণার সুযোগ হবে। মানব কল্যাণে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে, ঔষধ শিল্পে এবং প্রসাধন শিল্পে চায়ের বহুমাত্রিক ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বগ্রামের (Global Village) দ্বার প্রান্তে উপস্থিত থাকবে সমগ্র বিশ্ব। তথ্য প্রযুক্তি সৃষ্ট বিশাল অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মুখোমুখি বাংলাদেশের সম্ভাবনার দিকটি প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠেছে। এখন এই তথ্য প্রযুক্তির অত্যাধুনিক সুযোগ কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেই হলো। আমরা চাইলেই আমাদের প্রতীক্ষার দিনগুলো কমিয়ে আনতে পারি।
অতএব আর দেরি নয়, এখনই সময়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনো অনাবাদী, পতিত, অতি উঁচু, অনুর্বর ও অম্লময় বিধায় অন্য কোন অর্থকরী ফসলের আবাদ হয় না। পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝরে পড়া উদ্দীপ্ত তারুণ্য। আরো রয়েছে ভূমিহীন পরিশ্রমী আদিবাসী জুম চাষী।
নতুন শতাব্দীতে এসব অদম্য তরুণকে প্রশিক্ষিত করে চা উৎপাদনশীল দেশ ভারত, ইন্দোনেশিয়ার অনুকরণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চা বাগান সৃষ্টি করলে দেশে আসবে আরো একটি সোনালী বিপ্লব। জুমিয়াদের চা চাষে উদ্বুদ্ধকরণের সাহসী পদক্ষেপ সরকার নিতে পারে। একবিংশ শতাব্দীতে দেখা যাবে পাঁচ-দশ-বিশ একরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য চা বাগান সৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর সেরা অর্গানিক চা উৎপাদিত হবে চিম্বুক, কাপ্তাই, সাজেক ভ্যালি, থানচি ও রামগড় উপত্যকায়। সে চা আগাম বিক্রি হয়ে যাবে জাপান, জার্মান. ফ্রান্স ও ব্রিটেনে। এ কোন স্বপ্ন নয়। অতি নিকট ভবিষ্যতেই বাস্তবায়ন সম্ভব। আর স্বপ্ন হলেও ক্ষতি কি? চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো বলেই মর্ত্যের মানুষ নীল আমস্ট্রং এ্যাপেলো নিয়ে চন্দ্র বিজয়ের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। এখন সেই বিজয়ের পথ ধরে একটু এগিয়ে গেলেই তো হলো। উপনিবেশ আমলে শিল্প বিপ্লবের সময়ে শিল্প স্থাপনের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। একবিংশ শতকে তথ্য প্রযুক্তি এবং জীব প্রযুক্তির সুযোগ সদ্ব্যবহার করে বাংলাদেশ অতি দ্রুত মধ্য আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশের পথে এগিয়ে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, চা গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসড়কে আর কতো রক্তস্নান হবে?
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা