একদিনও ইন্টার্নশিপ না করে তিনি ইন্টার্ন সভাপতি

ছাত্রলীগ নেতা তাকির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

রতন বড়ুয়া | শনিবার , ১২ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

একদিনও ইন্টার্নশিপ করেননি, কিন্তু তিনি ইন্টার্নদের সংগঠন ইন্টার্ন ডক্টরস এসোসিয়েশনের (আইডিএ) সভাপতি। অনুপস্থিতির কারণে এরই মধ্যে তার ইন্টার্নশিপও বাতিল হয়েছে। কিন্তু তার প্রতাপ একটুও কমেনি। ছাত্রলীগের নেতা পরিচয়ে ক্যাম্পাস জুড়ে কায়েম করেছেন নিজস্ব ‘রাজত্ব’। এই ছাত্রলীগ নেতার নাম আসেফ বিন তাকি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) এমবিবিএস ৫৯ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

এমবিবিএস সম্পন্ন করে নাম লিখিয়েছিলেন ইন্টার্ন ডাক্তারের তালিকায় (ইন্টার্নশিপে)। নিয়মানুযায়ী কর্র্তৃপক্ষ রোস্টারের মাধ্যমে ওয়ার্ডভিত্তিক দায়িত্বও বণ্টন করে দেয়। এতে তার (তাকির) দায়িত্ব পড়ে গাইনি ওয়ার্ডের ৪নং ইউনিটে। কিন্তু সেখানে একদিনও ইন্টার্নশিপ করেননি তাকি। এমনকি ওয়ার্ডে যোগদানও করেননি বলে তথ্য রয়েছে। চমেক ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও তিন মাস ইন্টার্নশিপ করেছেন দাবি করে আসেফ বিন তাকি আজাদীকে বলেন, ‘আমার ব্যাচের ৬/৭ মাস হয়ে গেছে। আমার কিছুদিন ঘাটতি আছে। তবে একদিনও ইন্টার্নশিপ না করার তথ্য ভুল। যে কয়দিন ইন্টার্নশিপ করেছি, আমি বলেছি। এখানে তো লুকোনোর কিছু নেই। তাছাড়া এমন না যেইন্টার্নশিপ না করে আমি অপরাধ করেছি।’ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সাহেনা আক্তার। তিনি আজাদীকে বলেন, ‘তার (তাকির) যে ইউনিটে দায়িত্ব পড়ে, সে ইউনিটে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। সে যোগদানও করেনি। ইউনিটের চিকিৎসকরা তাকে ডেকে বুঝানোরও চেষ্টা করেছিল। এরপরও সে আসেনি, কাজও করেনি।’

হাসপাতালে তার (তাকির) ইন্টার্নশিপ চলমান নেই বলে নিশ্চিত করেছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান। আইডিএ সূত্রে জানা গেছে, তাদের এই সংগঠনে ৮৫ জনের মতো ইন্টার্ন ডাক্তার রয়েছেন। সংগঠনের নেতৃত্বে সভাপতি হিসেবে আসেফ বিন তাকি এবং সেক্রেটারি (জিএস) হিসেবে আছেন মাহাদী বিন হাশিম। একদিনও ইন্টার্নশিপ না করা একজনের সভাপতি হিসেবে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সংগটনটির জিএস মাহাদী বিন হাশিম গতকাল আজাদীকে বলেন, ‘ইন্টার্নশিপ শুরু হওয়ার আগেই সংগঠনের কমিটি গঠন হয়ে যায়। তাদের ইন্টার্নশিপ নভেম্বরে শুরু হয়। কমিটি হয়েছিল অক্টোবরে। আর ইন্টার্নশিপ করা না করার সাথে সংগঠনের পদের সম্পর্ক নেই। এটার সাথে ওটা মেলানোর বিষয় না।’

এদিকে, এমবিবিএস উত্তীর্ণের পরও মূল ছাত্রাবাসের কক্ষ ছেড়ে না যাওয়া, ছাত্রাবাসের ডাইনিং থেকে চাঁদা আদায়, খাওয়ার বিল পরিশোধ না করা, ডাইনিং ম্যানেজারকে মারধর, ফুটপাতে ডাব বিক্রেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন হকার ও দোকানির কাছ থেকে চাঁদা আদায়, বিভিন্ন ল্যাব থেকে চাঁদা আদায়সহ বিভিন্নজনকে হুমকিধমকির বিস্তর অভিযোগ ছাত্রলীগের এই নেতার বিরুদ্ধে। এমনকি কলেজ কর্তৃপক্ষের বিপক্ষেও নানা ধরনের উস্‌কানিমূলক কথা বলার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে চমেক প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত ২ আগস্ট চকবাজার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছে। ওই দিন মূল ছাত্রাবাসে অবৈধভাবে দখল করে থাকা একটি কক্ষ থেকে মালপত্রসহ তাকিকে বের করে দেয় চমেক প্রশাসন। এরপরই বিভিন্ন উস্‌কানিমূলক কথাবার্তার প্রেক্ষিতে তাকিসহ আরো দুজনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করে চমেক কর্তৃপক্ষ।

চমেক সূত্রে জানা যায়, এমবিবিএস উত্তীর্ণের পর একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর এক বছরের ইন্টার্নশিপ শুরু হয়। আর ইন্টার্নশিপ শুরু হলে মূল হোস্টেল (প্রধান ছাত্রাবাস) থেকে ইন্টার্ন হোস্টেলে স্থানান্তর হওয়ার নিয়ম রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে তাকিদের (৫৯তম) ব্যাচের ইন্টার্নশিপ শুরু হয়। নিয়মানুযায়ী ইন্টার্নশিপ শুরুর পর গত নভেম্বর থেকে তার ইন্টার্ন হোস্টেলে (মিজান হোস্টেল হিসেবে পরিচিত) চলে যাওয়ার কথা। কলেজ কর্তৃপক্ষের দফায় দফায় নোটিশ এবং তাগাদার পরও তিনি প্রধান ছাত্রাবাস ছাড়েননি। ৮ মাস ধরে প্রধান ছাত্রাবাসের ২য় তলার ১২ (বি) কক্ষটি অবৈধভাবে দখল করে থাকছিলেন তাকি। অবশেষে গত ২ আগস্ট তাকে বের করে কক্ষটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। একই সাথে তিন তলার দুটি কক্ষও (১৭এ এবং ২১সি) সিলগালা করে দেয়া হয়। এ দুটি কক্ষ দখল করে অবৈধভাবে থাকছিলেন কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বহিস্কৃত দুই শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১৭ () কক্ষটি দখল করে ছিলেন রিয়াজুল ইসলাম জয়। আর ২১ (সি) কক্ষটি দখলে রেখেছিলেন অভিজিৎ দাশ। তারা দুজনই এমবিবিএস ৫৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আর আসেফ বিন তাকি সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী।

এই দুই নেতার বদৌলতে ছাত্রলীগের দুটি পক্ষের পাশাপাশি চমেক হাসপাতালে ইন্টার্ন ডাক্তারদের সংগঠনও এখন দুটি। এর মাঝে আগে থেকে বিদ্যমান আইডিএ (ইন্টার্ন ডক্টরস এসোসিয়েশন)’র নেতাকর্মীরা সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। আর সম্প্রতি গড়ে তোলা ইচিপ (ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ) নামে সংগঠনটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীদের। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা দফায় দফায় সংঘর্ষ মারামারিতে লিপ্ত হলেও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রমে তারা এক। এমনকি গতবার ইন্টার্নশিপে দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রেও রাজনীতির প্রভাব বিস্তার করে পছন্দ মাফিক ওয়ার্ড বেছে নিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জোর প্রচেষ্টা চালায় বলে জানা গেছে। যা হাসপাতালের ইতিহাসে এর আগে ঘটেনি। এক্ষেত্রে দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা এক হয়ে এমন প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায় বলে জানা যায়। যদিও কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত সেটি হতে দেয়নি।

২ আগস্ট প্রধান ছাত্রাবাস থেকে তাকে বের করে দেয়ার পর তাকির সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ওই দিন ইন্টার্নশিপসহ ও হোস্টেলের কক্ষ না ছাড়ার বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। তবে অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল তার মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকি ফোন রিসিভ করেননি। তিনি বর্তমানে ইন্টার্ন হোস্টেলে রয়েছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। ইন্টার্নশিপ বা কোনো কাজে নিয়োজিত না থাকলেও চমেক ক্যাম্পাসে থাকছেন ছাত্রলীগের এই নেতা।

উল্লেখ্য, কক্ষ সিলগালা করার পর বহিস্কৃত ও অবৈধ কাউকে পরবর্তীতে ছাত্রাবাসে দেখা গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠিও দেয় চমেক কর্তৃপক্ষ। ২ আগস্ট বিকেলে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয় বলে নিশ্চিত করেন চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর সাহেনা আক্তার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বোর্ডে পেছাল এইচএসসির প্রথম চারটি পরীক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধচ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যিনি ছিলেন দৃঢ়