একজন শান্তনু বিশ্বাস তার পার্থিব-অপার্থিব

কামরুল হাসান বাদল | সোমবার , ১২ জুলাই, ২০২১ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

অধিকাংশ সময়ে তিনি শনিবারে আসতেন। আসার আগে একবার ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিতেন। বেলা এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটায় আসতেন। আড্ডা চলতো দুপুর দুটা অব্দি।
নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা হতো। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য এমনকি ধর্মও বাদ যেত না। কোনোদিন বিশ্বজিৎ চৌধুরীও যোগ দিতেন যেদিন কোনো কারণে শনিবার তার অফিস না থাকতো। বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রায় প্রতি শুক্রবারেই আসতেন। তিনিও মাঝেমধ্যে শুক্রবারে আসতেন।

এই শহরে প্রাণখুলে সবার সঙ্গে কথা বলা যায় না। আড্ডা মানুষকে সজীব করে, সৃজনশীল করে, ঋদ্ধ করে কিন্তু বৈরি সময় আমাদের প্রাণোচ্ছল আড্ডাগুলো কেড়ে নিয়েছে। তাই প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার ও শনিবারের আড্ডার জন্য অপেক্ষা ছিল আমার অনেকটা চাতকের মতো। এই একটি কারণে ছুটির দিনটি আমার কাছে খুব আনন্দময় ছিল। ছুটির দিন ও শনিবারের সকালবেলায় তাই কোথাও যেতাম না আমি।

কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলতেই তিনি হাসিমুখে গান গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকে যেতেন। খাওয়া-দাওয়া ছিল খুব সীমিত। ঘন ঘন রং চা খেতেন। কদাচিৎ দুপুরের খাবার খেতে সন্মত হতেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মাঝেমধ্যে চমকে উঠতাম কারণ তিনি এমনভাবে তাকাতেন যেন আমার অন্তর্লোক দেখতে পাচ্ছেন। আমি ভীত হয়ে পড়তাম, মনে হতো বানিয়ে কিছু বললে তিনি ধরে ফেলবেন।
এই শহরে একজন প্রকৃত আধুনিক মানুষ ছিলেন তিনি। শুধু কথায় নয় কর্মেও ছিলেন উদার,অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক। তিনি ছিলেন স্বনির্মিত, স্বনির্ধারিত একজন সফল ও সাার্থক মানুষ।

তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল নবনাট্যধারা আন্দোলন বা গ্রুপ থিয়েটারের নিরলস কর্মী ও সংগঠক। নাটক লিখেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অভিনয়ও করেছেন। যখন নাটক করেছেন তখন নাটককে গীতিময় করেছেন আবার যখন গান করেছেন তখন সঙ্গীতকে নাটকীয় করে তুলেছেন। ফলে যখন নাটক করছেন তখন অনেকে বলতেন তিনি গানের লোক আবার যখন গান করেছেন তখন বলতেন তিনি নাটকের লোক। আসলে নাটক, সঙ্গীত, লেখালিখি সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক অনাবিষ্কৃত কবি। এই কবিসত্তাই তাকে দিয়ে শিল্পের নানাদিকে পরিভ্রমণ করিয়েছে, ফলন ফলিয়েছে কিন্তু অন্তর্গত কবিসত্তাটিকে আবিষ্কার করার, ছুঁয়ে দেখার ফুরসত দেয়নি, সুযোগও দেয়নি। আসলে তিনি নিজেই কি নিজের ভেতরের কবিসত্তাকে অনুভব করতে পেরেছিলেন? নাকি স্পষ্ট করতে না পারার এক যন্ত্রণা ও অস্থিরতাবোধ নিয়ে মাত্র সাড়ে ছয় দশকের ছোট জীবনখানি কাটিয়ে দিলেন? আমার কেবলই মনে হয় গান-নাটক যাই করুন না কেন আসলে তিনি নিরন্তর একটি কবিতাই লিখতে চেয়েছেন।

এতক্ষণ যাঁর কথা লিখলাম তিনি শান্তনু বিশ্বাস। নাটকের শান্তনু বিশ্বাস, গানের শান্তনু বিশ্বাস, সংগঠক শান্তনু বিশ্বাস। তাঁর বিষয়ে লিখতে গিয়ে এই যে ‘ছিলেন’ ক্রিয়াপদটি ব্যবহার করছি তা দেখে আমি নিজেও ভারাক্রান্ত হচ্ছি দুঃখ-শোকে। কারণ শান্তনু বিশ্বাসকে নিয়ে লিখতে গিয়ে এত তাড়াতাড়ি ‘ছিলেন’ শব্দটি ব্যবহার করতে হবে ভাবিনি। কিন্তু মানুষ যেমনভাবে জীবন তো সবসময় সেভাবে চলে না। চলে না বলেই একটি বর্ষণক্লান্ত সন্ধ্যায় তিনি অপার গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছেন। আমাদের বুঝে উঠবার আগে, ধাতস্ত হওয়ার আগে। ফলে ১২ জুলাই ২০১৯ সালের পর আমাদের এমন করেই লিখতে হচ্ছে ‘ছিলেন’।
মৃত্যু জীবনের পরে এক পরমসত্য তারপরও অনেক মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কঠিন। শান্তনু বিশ্বাস সবকিছুতে থিতু হয়ে যখন পুনরায় গভীর আগ্রহ নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন তখন মৃত্যু নামের অসীম রহস্যটি এসে সব এলোমেলো করে দিলো। তাতে কতজন ভেসে গেল, ভেঙে গেল তার হদিস অনেকের অজানা।

অন্য অনেকের মতো তিনি স্রোতের টানে নাটক বা সঙ্গীতের জগতে আসেননি। জেনেশুনে, প্রস্তুতি নিয়েই এ-পথে নেমেছিলেন। ফলে শুধু নাট্যচর্চা করেই ক্ষান্ত হননি, নাট্যআন্দোলনকে বেগবান করতে, নাট্যকর্মীদের শিক্ষিত করতে, দেশ-বিদেশের নাটকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রসেনিয়াম নামে ছোটকাগজও বের করেছিলেন। থিয়েটারের পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রসেনিয়ামই ছিল নাটককেন্দ্রিক একটি সমৃদ্ধ ছোটকাগজ। তাঁর সম্পাদনায় প্রসেনিয়ামের প্রথম সংখ্যা বের হয় মার্চ, ১৯৮৩ সালে। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা-পরবর্তী দশ বছরে চট্টগ্রামের নাট্যকর্ম কোনো ধারা সৃষ্টি করতে পারলো কিনা, দর্শক সৃষ্টিতে তা কতটুকু সহায়ক হলো, সামাজিক অন্যায়মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে তা কতখানি কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করলো, বিষয় ও আঙ্গিক বৈচিত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাফল্যের ভাগ কতটুকু- তারই অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করার সময় হয়েছে বলে মনে হয়। এই কার্যসিদ্ধিতে প্রসেনিয়াম কতটুকু ফলদায়ক হবে বলা কঠিন, তবে নিরন্তর চেষ্টার প্রতিশ্রুতি রইলো।’
বাংলাদেশে সচরাচর যা ঘটে অর্থাৎ ভালো ও মহৎ কাজগুলো মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ে, প্রসেনিয়ামের বেলায়ও তা ঘটল। ষষ্ঠ সংখ্যা বের হওয়ার পর প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল। দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর ৭ম সংখ্যা (তাঁর সম্পাদনায় শেষ সংখ্যা) বের হলো। এই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘প্রসেনিয়াম বের হবে কিনা অনিশ্চিত ছিল। দীর্ঘ ৩০ বছর পর এই সংখ্যাটি বের হলো। খুব ভালো লাগা হলো সেই আগের চরিত্রে। একইরকম চেহারায় ভালো কিছু লেখা ও নাটক নিয়ে। থিয়েটারের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেশ থেকে দূরে, বিদেশে অনেকে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করছে। বাংলা নাটক এখন বিশ্বময়। এই খবর কিংবা নির্যাসটুকু এই সংখ্যার আলোচনা ও লেখা থেকে পাওয়া যাবে।’
এপার ও ওপার বাংলার প্রথিতযশা লেখক ও চিন্তকরা প্রসেনিয়ামে নিয়মিত লিখেছেন। এ ছাড়া নাট্যবিষয়ে মুল্যবান প্রবন্ধের অনুবাদ কাগজটিকে ঋদ্ধ করেছিল। নতুন নাটক ছাড়াও অনুবাদ নাটক ছাপা হয়েছে প্রচুর। লেখা, লেখার মান এবং সম্পাদনার গুণে প্রসেনিয়ামের একেকটি সংখ্যা হয়ে উঠতো নাট্যকর্মীদের কাছে সংগ্রহ করার মতো মূল্যবান।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, শান্তনু বিশ্বাস মূলত একজন কবি। তাই গানের মানুষ শান্তনু যখন গান লিখছেন তখন তা হয়ে উঠছে কবিতা।
‘কাঁঠালচাঁপার গন্ধে বিভোর বাতাস
মাথার ওপর ছোট্ট একটি আকাশ
মাঠের কোণে উদাস বিজন ঘাস
চাঁদের আলোয় চন্দ্রমল্লিকা
সবই আমি যত্ন করে রাখি
তোমায় দেব আবার দেখা হলে।’
(গান; আবার দেখা হলে)
কিংবা
‘নও কাছে নও দূরে
কেউ কি বেঁধেছে সুর
ভুল করে
চোখ বুঁজে নাও খুঁজে
ভোরের বাগান ডুবে যাওয়া গান
আঘ্রাণে কোন নারীর টানে
যেও না যেও না আছে প্রবঞ্চনা।’
(গান; প্রবঞ্চনা)
সময়সচেতন শিল্পী, নাট্যজন, গীতিকার শান্তনু বিশ্বাস সময়কে প্রত্যক্ষ করেছেন গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। রাজনীতিসচেতন এই শিল্পী একটি সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। সরাসরি রাজনীতি করেননি বটে কিন্তু ভাবনা ও চিন্তায় খুব সুক্ষ্মভাবে রাজনীতিকে নিজের মধ্যে প্রশ্রয় দিয়েছেন। পোস্টম্যান তাঁর বিখ্যাত গান। এই গানের মধ্য দিয়ে পোস্টম্যানের মতো আমাদের কাছে তাঁর বার্তাটিই যেন পৌঁছে দিচ্ছেন,
‘কবিতায় গুণদা শহীদ কাদরী
যাবো আমি কোনোদিন কবিতার বাড়ি
নিলুফার ফিরোজা কলিম শরাফী
গান শুনে গান বুনে কাছাকাছি থাকি
আড্ডা জমে না যদি বিশু না আসে
গল্প কবিতা সে খুব ভালোবাসে
গল্প উপন্যাসে ঘর আমার ঠাসা
ইলিয়াস মার্কোয়েজ মারিও হোসা
ত্রিদিব ছিল তাই টেনেছিল ঢাকা
সে নেই শহর তাই ফ্যাকাশে ও ফাঁকা
মুজিবর মুজিবুর হলা ভেঙে আসে
দ্যাখো, দেশ আজ ভরে গেছে দীর্ঘশ্বাসে…।’
অথবা
‘এত দেরি করে, এলে আবার এই শহরে
একাত্তরের পরে যে কটা দিন তুমি ছিলে
এই বৃষ্টি রোদ জলে
তোমার কি মনে আছে মনে পড়ে কেমন ছিলে
এই শহরে।’
গান নিয়ে নিজের ভাবনার কথা লিখেছেন শান্তনু তাঁর ‘গানের কবিতা খোলাপিঠ’ বইতে, ‘গান আমার ভাবনার, আমার চেতনার প্রতিচ্ছবি। আমার ভিতর-বাহিরকে অর্থাৎ আমাকে চেনার ছোট্ট একটি জানালা খুলে দেয় আমার গান। নির্মাণ ও সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় আমার গানের হয়ে ওঠা। সুর ও ধ্বনির ও ছন্দের কি সীমারেখা আছে। সীমাহীন বলে আমাদের গান ওদের আর ওদেরটা খুব সহজেই হয়ে ওঠে আমাদের।’
শান্তনু বিশ্বাস নাটকের দল গড়েছেন, নাটক লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, অভিনয় করেছেন, নাটক বিষয়ক পত্রিকা করেছেন। তিনি গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে একটি গ্রুপ অব কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। সামান্য থেকে কোম্পানির অন্যতম শীর্ষপদে পৌঁছেছিলেন।
এই ছোট্ট জীবনে তিনি বহুকিছু করেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরও কিছু পাওয়ার ছিল, শান্তনুরও দেওয়ার ছিল। কিন্তু পরিণত হতে না হতেই সাঙ্গ হলো দেওয়া-নেওয়া।
এখনো প্রতি সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার আসে। আমার শ্রবণেন্দ্রীয় উৎকর্ণ হয়ে থাকে একটি কলিংবেলের শব্দের জন্য তারপর গুনগুনিয়ে ঘরে আসা এক প্রিয় বন্ধুর জন্যে।
বেলটি বাজে, প্রিয় মানুষটি আসে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতির শহরে, শ্রুতিতে-স্মৃতিতে
পরবর্তী নিবন্ধচান্দগাঁওয়ে করোনা টিকার নিবন্ধন বুথ উদ্বোধন