অতিমারীর সময়টাতে বিশ্বজুড়ে চলে অসংখ্য অঘটনের ঘটন। দুর্বিনীত করোনা ভাইরাসের পাশাপাশি মানুষ আক্রান্ত হয় নানাবিধ সমস্যায়। করোনার ভয়াবহতা সাথে যোগ হয় এর সাথে সম্পর্কিত অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় যাতে পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন। কর্মহীন হয়ে পড়ে বহু মানুষ। বিশ্বব্যাপী মুহুর্তে বেড়ে যায় বেকারের সংখ্যা।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম হয়নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এর সবচেয়ে কঠিন প্রভাব পড়ে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জীবনে। দিন আনে দিন খায় এমন মানুষেরা পড়ে সবচেয়ে বড় বিপদে। তারা নিজেদের খাবার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়। অনাহারে কাটে বহু মানুষের জীবন। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই সময়ে এগিয়ে আসেন, তারা মানবতার চরম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন। অদ্ভুত এই সময়ে পরিচয় মেলে প্রকৃত মানুষের। তাদেরই একজন রিনা আক্তার, সমাজের চোখে অচ্ছুত এক মানুষ, একজন যৌনকর্মী।
দরিদ্র শ্রমজীবী শ্রেণি যারা করোনাকালীন সময়ে সবচেয়ে বিপদে পড়েছিল তাদেরই একটি দল যৌনকর্মীরা। অতিমারীর প্রভাব পড়ে তাদের জীবনেও। কর্মহীন জীবনে তারা ক্ষুধার্ত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। এমন সময়ে এগিয়ে আসেন মহৎ হৃদয়ের অধিকারী রিনা আক্তার, দায়িত্ব নেন সপ্তাহে চারশ মানুষের খাবার ব্যবস্থার। রিনা আক্তার আর তাঁর টিম ঢাকায় প্রতি সপ্তাহে প্রায় চারশ যৌনকর্মীকে খাবার সরবরাহ করেন। এসব যৌনকর্মী মহামারীর কারণে চরম দারিদ্র অবস্থায় পড়েছিল। রিনা আক্তার তাঁর এই মানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে এবছর বিবিসি একশ নারীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন।
২০১৩ সাল থেকে বিবিসি বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার জন্য প্রতি বছর একশত নারীর তালিকা প্রকাশ করেন। এবছর এই তালিকায় ফিনল্যান্ডের কোয়ালিশন সরকার যার প্রতিটি সদস্য নারী তার প্রধান স্যান্না ম্যারিন এবং অঙফোর্ড বিশ্ববিদ্যালযয়ের করোনা ভাইরাস টিকা গবেষণা দলের প্রধান সারাহ গিলবার্টের সাথে বাংলাদেশের রিনা আক্তার এবং রিমা সুলতানা রিমু এই তালিকাভুক্ত হন। পাকিস্তানী অভিনেত্রী মাহিরা খান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দারিদ্র বিমোচন বিষয়ক বিশেষ সহকারী সানিয়া নিশতার, ভারতের নাগরিকত্ব আইনবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৮২ বছর বয়সী বিলকিস বানুসহ আরও অনেক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব এ তালিকাতে ঠাঁই পেয়েছেন।
এ বছর বিবিসি যেসব নারী পরিবর্তন আনতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং করোনাকালীন সময়েও নানা বাধাবিপত্তি এড়িয়ে নিজের কাজ করে গেছেন তাদেরকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। রিনা আক্তার করোনার বাধার সাথে সাথে বিভিন্ন সামাজিক বাধাকে অতিক্রম করে সাহসের সাথে এক মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই সমাজে যৌনকর্মীদের এমনিতেই মুখোমুখি হতে হয় নানা সমস্যায়।
রিনা আক্তার বলেন, ‘লোকজন আমাদের পেশাকে ছোটো করে দেখে কিন্তু আমরা এটি করি খাবার কেনার জন্য। আমি চেষ্টা করছি যাতে এই পেশার কেউ না খেয়ে থাকে এবং তাদের বাচ্চাদের যেন এ কাজ করতে না হয়।’
আট বছর বয়সে রিনা আক্তারকে তাঁর এক আত্মীয় নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করে দেয়। সেই থেকে রিনা আক্তারের বাস এই যৌনপল্লী। তিনি এই পেশায় নিযুক্ত নারীদের করুণ কাহিনী জানেন, দেখেছেন কাছ থেকে তাই তিনি তাদের জীবন মান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি চান কেউ যেন এই পেশায় না আসে।
বিবিসি শতনারী তালিকার নারীদের কাজ এবং জীবন নিয়ে তৈরি করে তথ্যচিত্র, ফিচার, সাক্ষাৎকার এবং এর মাধ্যমে নারীকে বিভিন্ন কাজ এবং গল্পের কেন্দ্রে নিয়ে আসাই এর উদ্দেশ্য। কঠিন সামাজিক অবস্থায় বেড়ে উঠা, শিক্ষার আলো বঞ্চিত রিনা আক্তারের সাহসী এবং মানবিক কাজ তাই উঠে এসেছে বিশ্বের দরবারে।