অতীতের যে কোনো সরকারের চেয়ে বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি হয়েছে। প্রায় সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে উন্নয়নের অগ্রগতি বহির্বিশ্বের কাছেও প্রশংসিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের দিকে দেশ ধাবিত হয়েছে। উন্নয়নের অব্যাহত অগ্রযাত্রার মূল কারণ দীর্ঘ মেয়াদী সরকার। বার বার একই সরকার ক্ষমতায় আসায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা ও মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। আমাদের মত দেশে নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে আগের সরকারের অনেক ভাল প্রকল্পও বাতিল হয়ে যায়। অনেক চলমান প্রকল্পও বিভিন্ন ধরণের বাধার সম্মুখীন হয়। তাই দেশের যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন তার পেছনে সরকারের দূরদর্শিতা ও ধারাবাহিকতা কাজ করেছে। এজন্য কোনো দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। অস্থিতিশীল পরিবেশে যে কোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। তবে দীর্ঘ মেয়াদী সরকারের সুফল অনেক থাকলেও কুফলও রয়েছে।
মানুষ সব সময় চায় গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক। গণতান্ত্রিক ধারায় সরকার পরিবর্তন হোক। অগণতান্ত্রিক পন্থায় বা অন্য কোনওভাবে কেউ ক্ষমতায় আসুক তা কখনো সাধারণ মানুষ চায় না। একই সরকার বার বার ক্ষমতায় ফিরে আসুক তাও সাধারণ মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। মাঝে মাঝে মানুষ ক্ষমতার পরিবর্তন চায়। পুরাতন সরকারের সব কাজ যে অপছন্দ করে তা নয়। তারপরও মানুষ ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করে। ছোটখাট ভুল ভ্রান্তি দোষ ত্রুটি অনেক সময় বড় করে দেখে। সরকারের উন্নয়ন মূলক কাজগুলো বাদ দিয়ে অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিরোধী পক্ষ থাকা এবং সরকারের সমালোচনা করা স্বাভাবিক ব্যাপার। বিরোধী পক্ষ যখন শক্তিশালী থাকে তখন জনগণের একটি বড় অংশ তাদের সাথে সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে। যা অনেক সময় সরকারকে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন করে দেয়।
অনেকে মনে করে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দাবী আদায় করতে হয়। আন্দোলন সংগ্রামের পথ কোনও সহজ পথ নয়। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। জেল জুলুমসহ নানা ধরনের হয়রানীর শিকার হতে হয়। এমনকি মৃত্যুর মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে যায়। তখন গণতান্ত্রিক সরকারের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন আসে। যা কোনওভাবে কাম্য নয়। একটা গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিরোধী বা যে কোনো পক্ষের দাবী দাওয়া আদায়ের অন্যতম পন্থা আলাপ আলোচনা। আলোচনার মধ্য দিয়ে যে কোনো ন্যায্য দাবী আদায় করা যেতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকারের অন্যতম লক্ষ্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা।
আলোচনার মাধ্যমে যেসব দাবী দাওয়া পূরণ করা যায় তার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না। তবে দাবীসমূহ যৌক্তিক হতে হবে এবং জনগণের সমর্থন থাকতে হবে। জনগণের মতামত গ্রহণ বা যাচাই এত সহজ ব্যাপার নয়। কোনও কোনও জনসভায় অনেক লোকের সমাগম হয়। বিশাল জনসভায় পরিণত হয়। এসব লোক যে একই প্রতীকে ভোট দেয় এমন কথা নয়। ফলে সভা–সমাবেশের জনসমাগম কোনওভাবে জনমত যাচাই করতে পারে না। এজন্য গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় কোনো দাবী দাওয়া বা বড় কোনো সমস্যার সমাধান গণতান্ত্রিক ধারায় অর্থাৎ আলোচনার মাধ্যমে করতে হয়। আন্দোলন সংগ্রাম ও মিটিং মিছিল করলে রাজপথ উত্তপ্ত হয়। মারাত্মক যানজট সৃষ্টি হয়, জনদুর্ভোগ বাড়ায়। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটে। কোথাও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
আইন শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যরা সজাগ থাকলে এসব ঘটনা সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সংঘাত, ভাঙচুর বা অগ্নি সংযোগ ঘটার আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আন্দোলনকারীদের উসকানি বা ইট পাটকেল নিক্ষেপ থামাতে কাঁদানে গ্যাস, জল কামান বা রাবার বুলেট ছোড়া যায়। গুলি চালালে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায়। অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটলে আন্দোলনের গতি বেড়ে যায়, নতুন ইস্যুর সূত্রপাত হয়। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা এবং জানমাল রক্ষা করার দায়িত্ব আইন শৃংখলা বাহিনীর।
তাই অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে কোনও রকম প্ররোচনায় উত্তেজিত না হয়ে দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি দেশের সরকার পরিবর্তন হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সবদলের অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায় সবাই। সরকার সমর্থিত দলগুলোও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বিরোধী দলেরও অন্যতম দাবী সুষ্ঠু নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দল গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। আর বিরোধী দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়। অন্য কোনও সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্ন এসে যায়। যা সরকারি দল কোনওভাবে সমর্থন করতে পারে না। এতে গণতান্ত্রিক ধারা বিঘ্নিত হয়। অনির্বাচিত লোক দ্বারা সরকার গঠন করা ও নির্বাচন পরিচালনা করা গণতন্ত্রের পরিপন্থি। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। নির্বাচন চলাকালীন সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে শুরু করে প্রশাসনসহ সবকিছু নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যায়। সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের কোনও বিকল্প নেই। তাই যেসব দেশের নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী সেসব দেশের নির্বাচন নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠে না। নির্বাচন কমিশনের কাজই হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা। তাই বিরোধী দলের দৃষ্টি সেদিকে দিলে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গড়ে তোলা যায়। নির্বাচন চলাকালীন সময়ে সরকারকে অনেকটা নিস্ক্রিয় রেখে কি করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা যায় সেই জায়গায় আসতে পারলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব।
বড় বড় দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। বিরোধী দল নির্বাচনের বাইরে থেকে গেলে নির্বাচন কমিশন যতই ভাল নির্বাচন করুক নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। দেশের মানুষের বড় একটি অংশের কাছে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। বিভিন্ন দেশের কাছেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। ফলে নির্বাচন পরবর্তীকালে যারাই সরকার গঠন করুক না কেন তারা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের কাছে দেশের যে সুনাম ও ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে তা ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দাতা দেশগুলো এবং যেসব দেশ আমাদের উন্নয়নের অংশীদার তাদের কাছ থেকে আশানুরুপ সাড়া পাওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে। দেশেও একটি বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। বিরোধী পক্ষের নির্বাচন প্রতিহত বা বাধাগ্রস্ত করতে গিয়ে নানা ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটবে। নির্বাচন পরবর্তী সময়েও এরকম অসন্তোষ থেকে যাবে। এতে বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলে সবসময় স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ নাও করতে পারে। এতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। অন্যদিকে মানুষের দুভোর্গও বেড়ে যাবে, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। কেউ চায়না দেশে এরকম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করুক।
অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শাসক দল ও বিরোধী দলকে সমঝোতায় আসতে হবে। গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখে নির্বাচন কমিশনকে কী করে শক্তিশালী করা যায় সেদিকে এগিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি। এ ব্যাপারে শাসক দলের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বিরোধী পক্ষকে সরকার পতনের আন্দোলনে বেশি তৎপর না থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপর জোর দিতে হবে। এজন্য সব পক্ষের সংযত আচরণ ও অযাচিত লাগামহীন বক্তব্য পরিহার করা প্রয়োজন। উভয় পক্ষের দূরত্ব কমানোর জন্য আলাপ আলোচনা বা সংলাপের কোনও বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সরকারকে এবং শাসকদলকে এগিয়ে আসতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আবার দলমত নির্বিশেষে সকলে চায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। তাই আমাদেরও প্রত্যাশা সব ধরনের দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা পরিহার করে সব রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন। যে নির্বাচন দেশে ও বিদেশে সবার কাছে হবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার।