উন্নয়নের যে পথে চট্টগ্রাম

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

হাজার বছরের প্রাচীন চট্টগ্রাম কালের আবর্তে পরিণত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাণভোমরায়। আভ্যন্তরীণ জাতীয় রাজস্বের ৮০ থেকে ৮২ শতাংশের যোগানদাতা চট্টগ্রাম। এর মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় অন্যতম সহায়ক হয়ে উঠেছে এ বন্দরনগরী। তাই জাতীয় স্বার্থে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় চট্টগ্রামকে বাদ দেয়ার সুযোগ হয় না। বলা যায়, ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানগত কারণে সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় চট্টগ্রামকে আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়। ১৯৭১ থেকে ২০২১। দীর্ঘ এ ৫০ বছরে সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে প্রিয় স্বদেশ। যে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে বাঙালিরা অস্ত্র হাতে হানাদারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা পূরণের পথে। যদিও অর্থনৈতিক এ অগ্রযাত্রা সহজ ছিল না। দেশের সামগ্রিক এ অগ্রযাত্রায় ভূমিকা আছে চট্টগ্রামেরও। বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রার যে অর্জন তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামও।
পাকিস্তানি শোষকরা উন্নয়নে বঞ্চিত করেছিল বাংলাদেশকে। কিন্ত গত ৫০ বছরে উন্নয়নের ছোঁয়ায় দেশের চেহারা ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে। যেহেতু চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন অকল্পনীয় তাই চট্টগ্রামকেও শামিল করতে হয়েছে এ উন্নয়ন যাত্রায়। যোগাযোগ ও অবকাঠামোগতসহ নানা খাতে উন্নয়ন হয়েছে চট্টগ্রামে। এখানে গড়ে উঠেছে বহুসংখ্যক ছোট-বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা। যা দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতিশীল করে জিডিপিতে অবদান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাতের পাশাপাশি বন্দরকে ঘিরেও চট্টগ্রামে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। এতে বেড়েছে নাগরিক জীবনযাত্রার মান। অবশ্য চট্টগ্রামবাসী কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন উন্নয়নের অভিযোগ করে থাকেন।
২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্য পূরণে সরকারের রূপকল্প ২০২১ সহ নানা পরিকল্পনা রয়েছে। আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগ, সরকারের ১০টি অগ্রাধিকার প্রকল্প এবং প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত অসংখ্য প্রকল্প। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে আমার বাড়ি আমার খামার, আশ্রয়ণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কার্যক্রম, নারীর ক্ষমতায়ন কার্যক্রমসমূহ, সবার জন্য বিদ্যুৎ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিশু বিকাশ, বিনিয়োগ বিকাশ ও পরিবেশ সুরক্ষা। যার প্রতিটির সঙ্গেই সম্পৃক্ত চট্টগ্রামও। বিশেষ করে বিনিয়োগ বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মহেশখালীতে দেশের প্রথম ২টি (প্রতিটি ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন) ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন কার্যক্রম ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামে বাস্তবায়িত হচ্ছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে দুই শতাধিক প্রকল্প।
যেমন বিদ্যুৎ প্রকল্প আছে ১৫টি, তেল, গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে ৬টি, পরিবহন খাতে ১৯টি, রেলওয়ের ৫টি, বিমান ও পর্যটন খাতে ৪টি, নৌ-পরিবহন খাতে ৬টি, ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাতে ৪১টি, শিক্ষা খাতে ২৮টি, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাতে ২টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সরকারের ১০টি অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যেও রয়েছে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক প্রকল্প। যেমন চট্টগ্রামের দোহাজারী-রামু হয়ে কঙবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের নিকটবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রমও অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে। এখানে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, বন্দর নির্মাণ, এলএনজি ও এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প রয়েছে ২০টি। মাতারবাড়িতে বন্দর গড়ে উঠলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অন্তত আগামী একশ বছরের চাহিদা মিটবে।
মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় বেজার উদ্যোগে গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরী (ফেনী অর্থনৈতিক অঞ্চল, মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, সীতাকুণ্ড অর্থনৈতিক অঞ্চল)। অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে আনোয়ারা উপজেলায়। এছাড়া কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল। যা চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’র মর্যাদা দেবে। শহরের যান চলাচলে গাতি বাড়াবে চলমান এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে। বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আরো গতি পাবে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। আইসিটি খাতের হাই-টেক পার্ক, আইটি ভিলেজসহ প্রকল্পসহ অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে চট্টগ্রামে। যার বেশ কয়েকটি শেষ হয়েছে। আইসিটি খাতের প্রকল্পগুলোর মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের সহযাত্রী হবে চট্টগ্রামও।
১৯৯৯ সালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারায় যাত্রা শুরু করে কোরিয়ান এঙপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড)। বর্তমানে সেখানে ৩৪টি শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। আরো ৪৫টি কারখানা করার পরিকল্পনা আছে। একইসঙ্গে ১০০ একর জমিতে তথ্যপ্রযুক্তিশিল্প এলাকা, ১৪০ একর জমিতে টেঙটাইল শিল্প এলাকা এবং ৫০ একর জমিতে ওষুধ শিল্প গড়ে তোলা হবে। যা কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত ১০টি প্রতিশ্রুতি এবং ৬০টি নির্দেশনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। প্রতিশ্রুতিগুলোর আলোকে সন্দ্বীপের মুছাপুর ইউনিয়নে ১০ একর জায়গায় শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে একটি প্রকল্প নিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারা দেশে এডিপিভুক্ত ৩৩ টি প্রকল্প চলমান আছে। এর মধ্যে চারটি বাস্তবায়িত হচ্ছে চট্টগ্রামে। যার অন্যতম ৯৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় ‘বিসিক শিল্প নগরী রাউজান’ প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে খাদ্য ও খাদ্যজাত, তৈরি পোশাক, রাবার, লেদার, কেমিক্যাল, প্যাকেজিং, বন ও বনজাত, কৃষি, হালকা প্রকৌশল বিষয়ক ১৪৮ শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে।
রাউজান ছাড়াও ফৌজদারহাট, ষোলশহর, কালুরঘাট, পটিয়া ও মীরসরাইয়ে বিসিক শিল্পনগরী আছে। যেখানে দুই হাজার ৯০৪টি শিল্পকারখানা রয়েছে। কারখানাগুলোতে কাজ করছেন সোয়া লাখের বেশি লোক। উল্লেখ্য সারা দেশে বিদ্যমান ৭৬টি বিসিক শিল্পনগরীর ২৩টির অবস্থান চট্টগ্রাম বিভাগে। ১৯৫৭ সালে বিসিক গড়ে উঠলেও চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে এটির কার্যকর সুফল মিলেছে দেশ স্বাধীনের পর থেকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাসিনা-কোবিন্দ বৈঠকে যোগাযোগে জোর
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে পঞ্চাশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু