মহান স্রষ্টা নির্দেশিত আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের অভিনব অপরিহার্য ইবাদত পবিত্র রমজান শেষে সর্বজনীন ঈদ উৎসব নিরন্তর আনন্দের চিত্তোৎকর্ষ উপহার। এই ঈদকে ঘিরে সামগ্রিক অর্থে সকল পণ্য–সামগ্রী, পোশাক–পরিচ্ছদ, আধুনিক ও ঐতিহ্যিক সাজসজ্জা, বিনোদন, নবতর মনোহারি আঙ্গিকে সাজানোর অন্তঃকরণ প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চলে সারা বছরব্যাপী।
সজীব প্রতিক্ষায় প্রহর গুনে সকল ব্যবসায়ী, ধনী–গরিব, ক্রেতা–বিক্রেতা, বেতার–টিভি–চলচিত্রসহ বিভিন্ন জমকালো অনুষ্ঠান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও সম্প্রচার কেন্দ্র। নামায, ইফতার, সেহেরী, পবিত্র কোরআন পাঠ, যাকাত–ফিতরা প্রদান, নতুন কাপড় কেনা ও পরিধান করা, উপহার বিতরণ ও বিনিময় ইত্যাদি সম্পন্ন করে মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টিতে নিজেকে বিলীন করার মাধ্যমে প্রায় সপ্তাহব্যাপী উদ্যাপনে ঈদুল ফিতরের মহৎ উদ্দেশ্য জাগরিত থাকে।
সম্প্রীতি–সৌহার্দ–বন্ধুত্বের চিত্ত–বৈজয়িক উপযোজনে সার্থক হয়ে ওঠে ঈদের এ আনন্দ উৎসব। বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রধান অনুষঙ্গ নানা মাত্রিকতায় সমাজ বিবর্তনের সাম্প্রতিককালে এই উৎসব শুধু ধার্মিকতায় নয়, ধর্ম–দল–মত নির্বিশেষে এক অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বিকশিত। মূলত মাহে রমজানের শাশ্বত শিক্ষা ও অনুশীলন ন্যায়পরায়নতা, নৈতিকতা, ত্যাগ–সংযম ইত্যাদি বিশ্বজনীনতা ও মানবিকতার নান্দনিক বৈভাষিক রূপকল্প।
পবিত্র কোরআনে রমযানকে আরবীতে সাওম বা সিয়াম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রোযা ইসলাম ধর্মের তৃতীয় রোকন। শান্তির বারতা নিয়ে যে ইসলামের আবির্ভাব, তার মূখ্য উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম মহান সষ্ট্রার সন্তুষ্টি অর্জনে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ। সার্বিক দিক থেকে যে বিবেচনায় রোযার মহাত্ম অতি গৌরবান্বিত তাহল নিজেকে পরিশুদ্ধ করার উত্তম পন্থা সমূহের অনুশীলন।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘হে ঈমানদারগণ! পূর্ববর্তী উম্মতের ন্যায় তোমাদের উপরও রোযা ফরয করা হয়েছে, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (বাকারা–১৮৩) মূলত: সুবেহ সাদিক হতে সূর্য ডুবা পর্যন্ত রোযার নিয়ত করে সকল প্রকার খাদ্য–পানীয় গ্রহণ ও যৌনকাজ কর্ম ইত্যাদি হতে বিরত থাকাকে শরীয়তের পরিভাষায় রোযা বলে। হযরত (সাঃ) এর অমিয়বাণী অনুসারে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে ‘রমযান মাস উপস্থিত হলে বেহেশতের দরজাগুলো খোলা এবং দোযখের দরজাসমুহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তান শিকল পরিহিত অবস্থায় থাকে’।
বস্তুতপক্ষে মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, অন্যকে কষ্ট দেওয়া, বা যে কোন ধর্মের মানবকল্যাণ বিরোধী কর্মকান্ড থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং অন্যকেও সুপরামর্শ দিয়ে মঙ্গলের পথে নিয়ে আসার মধ্যেই রোযার সার্থকতা।
অপর এক হাদীসে বর্ণিত আছে ‘হুজুর (সাঃ) বলেন, রোযাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশক অপেক্ষা অধিক প্রিয়। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে একটি রোযা রাখবে তিনি তাকে দোযখের অগ্নি থেকে সত্তর বছরের রাস্তা দূরে রাখবে’ (বোখারী শরীফ)।
এই রোযার মাসেই পবিত্র শবে কদর এবং মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন নাযিল হয়েছে। সর্বোপরি কঠিন পরিচর্যার মাধ্যমে ৩০ পবিত্র রোযা পালনের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে যে মহোৎসবের নামাকরণ তা হচ্ছে ঈদ–উল–ফিতর। পরিপূর্ণভাবে নিজেকে পবিত্র রেখে ঈদ উৎসবকে ধারণ করে ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় ও বন্ধুত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে সৌহার্দ সম্প্রীতি এবং সকল মানবের জন্য মঙ্গল কামনায় নিবেদিত এই ঈদ শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সকল ধর্ম–জাতিগোষ্ঠীর জন্য এক মহামিলন ও আনন্দ আদান–প্রদানের সুমহান ক্ষেত্র।
এটি অসাধারণ এক বিশ্বজনীন মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক কল্যাণবোধ যা মানুষের সভ্য ও সংহতির সমাজ প্রতিষ্ঠায় অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। এজন্যই এটি একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য সংস্কৃতির উল্ল্যেখযোগ্য উপাদান হিসেবে সর্বত্রই বিবেচিত।
আমাদের অনেকেরই জানা, ‘ধর্ম’ শব্দটি ‘ধৃ’ ধাতু থেকে নেয়া এবং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ধারণ করা। নিজের ও অপরের জীবন সমৃদ্ধিতে নিবেদিত সকল কর্মেরই যোগফল হচ্ছে ধর্ম। মূলত: ধর্ম কোন আপেক্ষিক বিষয় নয়। স্বাভাবিক, সাবলিল ও সহজ–সরল সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ইহ এবং পরকালীন শান্তি নিশ্চিতকল্পে মানবিক ও সংযত কর্মভিত্তিক একটি সুসংহত বলয় তৈরিই ধর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য।
সমাজসভ্যতার ক্রম বিকাশের ধারায় ধর্মের রূপান্তর এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার আচার–অনুষ্ঠান, রীতি–নীতি, বিধি–নিষেধ, নিয়ম–কানুন ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি জানি। আদিম, দাস, সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতে ধর্মের যে প্রকৃতি–পরিধির বিস্তার, পরিবর্তন–পরিমার্জন ও বিভিন্ন ধারা–উপধারায় প্রসার লাভ করেছে এটিই সামাজিক বাস্তবতা।
ইউনেস্কো জরিপ এবং অন্যান্য সূত্রমতে বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রধান ধর্মের সংখ্যা ১৯টি। এদের শাখা–প্রশাখা ও বিভক্ত সম্প্রদায়ের সংখ্যা প্রায় ২৭০টি। আমরা জানি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সকলই পবিত্র ইসলামকে একটি বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে ধারণ করে এবং প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (স🙂 মহান আল্লাহতায়ালা প্রেরিত শেষ নবী এবং তিনি ‘ওহি’ প্রাপ্ত। ‘মুহম্মদ’ শব্দের অর্থ প্রশংসিত আর ‘ইসলাম’ শব্দটির উৎপত্তি ‘আসলামা’ থেকে যার অর্থ শান্তি এবং ‘মুসলমান’ শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণকারী অর্থাৎ পরিপূর্ণভাবে মহান আল্লাহতালার নিকট সকল কিছুতেই আত্মসমর্পণকারীই হচ্ছেন সত্যিকারের মুসলমান।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শব্দের ‘কোর’ অর্থ পড়া আর ‘আন’ অর্থ সর্বক্ষণ অতএব এর আভিধানিক অর্থ দাড়ায় ‘সর্বক্ষণ পাঠ কর’। আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস অর্থাৎ ঈমাম, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত এই পাঁচটি পবিত্র ইসলামের মূলভিত্তি। এর মধ্যেই নামাজ রোযা যাকাতকে ঘিরে যে মাসটি সবচেয়ে সমাদৃত সে মাসকেই পরিপূর্ণভাবে মর্যদাসীন করার লক্ষেই এর শেষে পবিত্র ঈদ বা সর্বোচ্চ উৎসবের দিন ধার্য করা হয়।
এই রমযান মাসের তাৎপর্য ইসলামের ইতিহাসে বিশাল। এই মাসেই প্রিয়নবীর নেতৃত্বে সংঘটিত হয় মহান বদর যুদ্ধ। মাত্র ৩১৩ জন সাহাবীদের নিয়ে প্রায় এক হাজার শত্রু মোকাবেলা করে মহান আল্লাহর অপার কৃপায় ঈমানী শক্তিবলে জয়লাভ করে মুসলমানগণ। এই যুদ্ধে জয়ী হতে না পারলে আদৌ পবিত্র ইসলাম ধর্ম সুদৃঢ় হয়ে আজকের পর্যায়ে আসতে পারত কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এই পবিত্র রমযান মাসেই পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন নাজেল হয়েছে। এ রকম বহু ঘটনা আছে যা এই মাসকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।পবিত্র রমযান মাসের শেষে যে ঈদ–উল–ফিতর বা ঈদ উৎসব তার পটভূমি উপলব্ধি করতে হলে পবিত্র রমযানের দর্শন তথা সংযম, ত্যাগ, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ, আচার–আচরণ, নামাজ–দোয়া, অন্যের কষ্টে ব্যথিত হওয়া, গরীব–দুঃখীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদির আলোকে উপলব্ধি করতে হবে। ইফতার–সেহেরী, তারাবির নামাজ, যাকাত প্রদান, ধনী–দরিদ্রের ব্যবধান ঘুছিয়ে এক আল্লাহতালার সৃষ্ট মানব হিসেবে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, অন্যের ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা ইত্যাদি পরিহার করে পরিপূর্ণ মানবিক ও অসাম্প্রদায়িকতায় দীক্ষিত হয়ে একটি মননশীল ও সুন্দর মানসিকতায় ঋদ্ধ হওয়া পবিত্র রমজানের শিক্ষা। এই মাসে যাকাত ও ঈদের দিন ফিতরা দেওয়ার রেওয়াজ একটি বৈষম্যহীনতার অসাধারণ উদাহরণ।
পবিত্র রমজান শেষে বর্ণিল ঈদ উৎযাপন ধর্ম–বর্ণ, জাত–পাত, ধনী–গরীব নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান মর্যাদায় সমাসীন করার মধ্যেই প্রকৃত মানব ধর্মের জাগতিক–পারলৌকিক দর্শন উদ্ভাসিত। বাঙালির ঈদ উৎসব বা সকলকে নিয়ে আনন্দের ভাগাভাগিতে মেতে ওঠা, নাচ, গান, নাটক, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, আনন্দ ভ্রমণ ইত্যাদির সমন্বয়ে এটিকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় কাঠামোতে না রেখে ধর্ম নিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উপস্থাপিত হলেই এর মর্যাদা এবং তাৎপর্য অনেক বেশি মহিমান্বিত হবে – সেটিই স্বাভাবিক। ধারাবাহিকতায় এভাবেই মানব সমাজের নানামুখী বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত ধর্মীয় দর্শন অনুষ্ঠানিক অনুশাসন ও অনুশীলনের আবরণে প্রয়োগিক পন্থায় অবারিত। সামাজিক সম্পর্কের গঠন ও অভিজ্ঞতাকে সমাজের বিভিন্ন সমৃদ্ধ স্তরে আরোপ প্রক্রিয়ায় সম্প্রীতির বৈশ্বিক রূপায়নে অনুভবনীয় মহিমায় অধিকতর প্রসারিত হবে – এ প্রত্যাশায় বিশ্বের সকল মানব সন্তানের প্রতি পবিত্র ঈদ শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।