ঈদ আসলে তিনটা বা সাড়ে তিনটা। বড় লোকদের একটা ঈদ, মধ্যবিত্তদের একটা ঈদ, আর গরীবদের একটা ঈদ। মধ্যবিত্তদের আধখানা আবার বড় লোকদের কাতারে উঠতে পারে বা গরীব লোকদের পর্যায়ে নামতে পারে। সে জন্য মধ্যবিত্তদের ঈদ দেড়খানা। আমার বাবা সম্ভবত নিচের দিকের মধ্যবিত্ত ছিলেন। তাঁর সন্তানাদিও ছিল ডজনের ওপর। তো তিনি ঈদের বাজার—এখন যেটাকে ঈদ শপিং না বললে মানুষ বুঝতে পারবে না—করতে যেতেন মাত্র একদিন। বিখ্যাত চলচ্চিত্র “সাউন্ড অব সাইলেন্স”–এ যেমন বাবা–মা পরিবারের সকল শিশু সন্তানকে নিয়ে শপিংএ গেলে ওদেরকে পরষ্পরের কোমরে রশি বেঁধে জেলের কয়েদীদের মতো নিয়ে যেতেন, যাতে ওরা হারিয়ে না যায়, আমার বাবাও তেমনি আমাদেরকে, অর্থাৎ প্রায় একই বয়সের আমরা পাঁচ ভাইবোনকে রশি দিয়ে বেঁধে না হলেও একই সঙ্গে জুড়ে তখনকার, অর্থাৎ ষাটের দশকে চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনবহুল রেওয়াজুদ্দিন বাজারে নিয়ে যেতেন। একটা দোকানেই তিনি যেতেন ফি বছর, নোবেল ক্লথ স্টোর। দোকানটি এখনও আছে কিনা জানি না। আমরা পাঁচ ভাইবোন পাশাপাশি দাঁড়াতাম, আর দোকানী আমাদের সাইজ দেখে আন্দাজ করতেন কার জন্য কতটুকু কাপড় লাগবে। তারপর বাবা কয়েকটি কাপড়ের নমুনা দেখাতে বলতেন। দোকানী কাপড়ের লং ক্লথের বান্ডিল একটার পর একটা খুলতেন, আর বাবা কোন একটা কাপড় পছন্দ করে বলতেন, ঐটা দিন। তো একই লং ক্লথ থেকে আমাদের পাঁচজনের জন্য একই কাপড় কেনার পর একটা সওদাগরী দোকান থেকে ঈদের সেমাই সহ অন্যান্য দ্রব্যাদি কিনে ঁেহটেই চলে আসতেন ঐ দেড় মাইলের রাস্তাটি। আমরাও বাবার সঙ্গে কিচিরমিচির করতে করতে সোল্লাসে বাসায় ফিরতাম। দর্জির বেলায় বাবার আর ভূমিকা থাকতো না। আমার মায়ের এক দূর সম্পর্কের চাচার আমাদের কাজীর দেউড়ির ২ নং গলির ঠিক মাথায় একটা দর্জির দোকান ছিল। আমরা ডাকতাম মতিন নানা। মতিন নানাই পাঁচ ভাইবোনের জন্য ফ্রক আর শার্ট বানিয়ে দিতেন। ঈদের দিন নামাজ থেকে আমরা দুই ছোট ভাই বাবার সঙ্গে মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করার পর বেড়াতে বের হতাম তিন বোনের সঙ্গে। সবার গায়ে একই প্রিন্টের নতুন কাপড়। আমার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু আরেকটু মাথা তোলা হলে সমালোচনাকারী আত্মীয়–স্বজনের মন্তব্যে বুঝতে পারতাম, ফুটবল দলের মতো একই রঙের ঈদের জামা পরার মধ্যে একটা হাসির খোরাক আছে।
আমরা আরেকটু মাথা তোলা হলে বাবা তাঁর এই গণতান্ত্রিক সজ্জাকরণ ধরে রাখতে পারেন নি, তিনি আর আমাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন না। আমরা নিজেরা নিজেরা মিলে তখন বাজার করতে শিখে গেছি। এই যে বাবার গণতান্ত্রিক সজ্জাকরণের কথা বললাম না, এটা ঈদের আধ্যাত্মিক পর্যায়ে নিয়ে গেলে ঐ গণতন্ত্রের কথাই আসে। ঈদের দিন ধনী–দরীদ্রের ভেদাভেদ নেই, ঈদের দিনে শত্রুতা মুছে নিয়ে মিত্রতা স্থাপন করতে হয়। এবং পাড়ার মধ্যে ঐ বালক বয়সে এর ওর সঙ্গে ঝগড়া–বিবাদ লেগেই থাকতো, পরস্পরের কনিষ্ঠ আঙ্গুল ছুঁয়ে দিতাম আড়ি, আর ঈদের দিন পরস্পরের বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁয়ে বলতাম ভাব। এই ‘আড়ি’ থেকে ‘ভাব’–এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষের সঙ্গের সম্পর্কের দূরত্ব ঘুচিয়ে নিয়ে আসতে পারাটাই আমাদের কাছে মনে হতো ঈদের চেতনার মূল উৎস। ঝগড়াটে বন্ধুটার সঙ্গে ভাব হয়ে গেলে এক ধরনের অনির্বচনীয় আনন্দ পেতাম। এর অনেক অনেক দশক পরে আমি যখন কানাডার একটি বরফমাখা শহরে উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য বাস করছি, তখন ঐ শহরেই থাকে এক বাঙালী ছাত্রের সঙ্গে আমার ভীষণ ঝগড়া লেগে যায়, ফলে একই বিভাগের ছাত্র হয়েও আমাদের মধ্যে মাতামাতি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ঈদতো কানাডাতেও আসে, আমাদের শহরেও আসলো। আমরা বাঙালী, পাকিস্তানী, ভারতীয় এবং অন্য আরও কয়েকটি দেশের মুসলমান ছাত্ররা মিলে শহর থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে কাছের আরেকটি শহরের মসজিদে ঈদের জামাত পড়তে যাই। কিন্তু ছেলেটির সঙ্গে আমার ভাব হলো না। এটার অর্থ ঈদের মূল চেতনা, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, এটা শিশুদের মধ্যে যেভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, বড়দের মধ্যে যায় না। এ জন্যই তলস্তয় তাঁর বিখ্যাত একটি গল্প লিখেছিলেন ছোটদের মনের এই সহজতা নিয়ে যে গল্পটির ইংরেজি অনুবাদে শিরোনাম হলো, চিলড্রেন মে বি ওয়াইজার দ্যান দেয়ার এলডার্স।
রন্ধনশিল্প খুব সৃজনশীল একটি কর্ম। আমার মায়ের কাছে ছিল এটি একটি মহাকর্ম। তিনি চান–রাতের দিন এক পলকও ঘুমাতেন না। আমার স্কুলগামী তিনবোনের সহযোগিতায় তিনি সেমাই, চুটকি, গুড়াপিঠা, আর মুরগীর টুকরার ভাজি তৈরি করতেন সারা রাত ধরে। সাথে আরও তৈরি করতেন বোম্বাইয়ে সেমাই, মোরব্বা আর সুজির হালুয়া। এই গুড়াপিঠা বাংলাদেশের সব অঞ্চলে হয়তো আছে, কিন্তু ভিন্ন নামে। আমার মা আর বোনেরা মিলে গুড়া পিঠার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এমনভাবে সম্পন্ন করতে পারতেন যে আমি অবাক চোখে চেয়ে থাকতাম। প্রথমে ময়দার খামিরা (চট্টগ্রামে ভাষায় ‘কাই’) বানাতেন চৌকি পীড়ির ওপর। তারপর আরেক বোন আর একটি চৌকি পীড়ির ওপর ঐ কাই থেকে ছোট ছোট মন্ড বানাতেন, আর দ্বিতীয় বোনটি আরেকটি চৌকি পীড়ির ওপর মন্ডগুলো থেকে কচুলতির মতো বা লম্বা ক্রিমির মতো লতির সৃষ্টি করতো। কিন্তু ওস্তাদের মাইর যেমন শেষ রাতে, তেমনি আমার মায়ের দায়িত্ব থাকতো ঐ লতিগুলোকে হাতের কোন একটা দক্ষতায় ছোট ছোট চুটকির মতো সাইজ করে ডালায় ভরা। চুটকির সাইজ থাকে ছোট, কিন্তু গুড়া পিঠার চুটকির সাইজ খানিকটা মোটা, ছারপোকা রক্ত খেলে যেমন স্ফীত হয় সেরকম। তারপর ডালায় প্রচুর পরিমাণে গুড়া পিঠা সঞ্চিত হলে মা এবারে যেতেন মাটির চুলার কাছে। ততক্ষণে ফজরের আজানের প্রায় সময় হয়ে আসছে। আগুনের চুলায় সেঁদে দেওয়া লাকড়ি হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল, মায়ের দীপ্র ফর্সা মুখ আগুনের আঁচে লাল, তারপরও তিনি বড় একটা ডেকচিতে গুড়া পিঠা রাঁধতে বসলেন, সেখানে ডেকচির ভিতরে ফেললেন নারিকেল কুড়ানি দিয়ে কোড়া নারিকেলের তরজা, বাদামের গোটা, কিসমিস আর মোরব্বা। একসময় সেটা তৈরি হয়ে গেল, এদিকে আমরা নামাজে যাচ্ছি বাবার পিছে পিছে, আর মা গেলেন শুতে। জানেন, তাঁর ছোট ছোট মেয়েগুলি মেহমানদারী করতে পিছিয়ে থাকবে না।
এর অনেক অনেক দশক পরে আমার নিজেরই সংসারে ছেলেরা বিয়ে–শাদী করেছে, আমার স্ত্রী ছেলের বৌদের শাশুড়ির ভূমিকায়, আর আমার তিন বৌমা ঈদের আয়োজনের প্রস্তুতিতে মশগুল। আগোরা থেকে যাবতীয় ঈদ সরঞ্জামাদি কেনা হয়েছে। বাসায় মায়ের ঘুগনির জায়গায় এসেছে ব্লেন্ডার, আলু কাটার জন্য কাটার, আনারস কুড়ানোর জন্য আরেকটা ডিভাইস, নারিকেল হয়ে রইলো আউট অব সিলেবাস, কারণ সেমাই থাকলেও মেনুতে গুড়াপিঠা নেই। চানরাতের দিন বৌমারা আর তাদের শাশুড়ি মা মিলে ঈদের সমস্ত আয়োজন রাত দশটা এগারোটার মধ্যে শেষ করলেন। বারটার আগেই তাদের শাশুড়ি মা আমার পাশে শুয়ে মুহূর্তেই ঘুমের জগতে চলে গেলেন। আমি তাঁর নাক ডাকার মৃদু থেকে ভারী শব্দ শুনছি, অথচ রান্নাঘর একেবারে সাইলেন্ট, আর আমার ঘুম আসছিলো না, মনে হচ্ছিলো, কিছু একটা যেন মিস করছি।
এর আরও কয়েক দশক পরে ছেলে, বৌমা, নাতি–নাতনি কেউ দেশে নেই। আমরা বৃদ্ধ–বৃদ্ধা চান–রাতের দিন একটানা মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার ক্লান্তিবশত নিতান্ত দুর্বল হয়ে শুতে যাই। তখন বৃদ্ধার কাছে আমি জিজ্ঞেস করি, অমুক আত্মীয়কে যাকাতের টাকা দেয়া হয়েছে কিনা, অমুক আত্মীয়া যে সম্প্রতি স্বামী হারিয়েছে, এবং নিজের ধরা পড়েছে ক্যান্সার, তাকে কিছু দেওয়া হয়েছে কিনা, আর তখন মোবাইলের মেসেঞ্জারে খুট করে একটা শব্দ হলো। খুলে দেখলাম, সম্প্রতি ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র মারা যায়, আর সে ছিল বিবাহিত এবং একটি ছোট্ট শিশুপুত্রের জনক। ছাত্রটির পক্ষ হয়ে বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ একটি দানছত্র খোলেন ওয়াটসএ্যাপ গ্রুপে, সে গ্রুপের মারফতে তাঁরা একটা ফান্ড তুলে ঐ নিহত ছাত্রের পরিবারকে দেবে। এই মহৎ উদ্যোগে আমিও শামিল হই। সেজন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঐ মেসেজটা টুং করে আওয়াজ দিয়েছে। আমার হঠাৎ সারা মন পরম তৃপ্তিতে ভরে গেল।
মনে হলো, স্মৃতিতে আমার বাবা–মা’কে দেখলাম। এবারের ঈদ সবার জন্য নির্মল আনন্দ বয়ে আনুক।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ