ঈদ আসে সাম্যের বার্তা নিয়ে

নুসরাত সুলতানা | শনিবার , ২৯ মার্চ, ২০২৫ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

বছর ঘুরে আবারও ফিরে এলো ঈদুল ফিতর, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। খুশির দিন। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা, কোরআন তেলাওয়াত, অধ্যয়ন ও ইবাদতবন্দেগীর মাধ্যমে রোজাদারগণ মহান আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করেন। এরপর সমস্ত ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। রমজানের শুরু থেকেই এই পবিত্র দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে মুসলিম বিশ্ব। এই পৃথিবীতে প্রত্যেক জাতির নিজস্ব বিশেষ বিশেষ কিছু উৎসব রয়েছে। এসব উৎসব ঐসব জাতির পরিচয় বহন করে। কোনো কোনো জাতি নিছক আনন্দ পাওয়ার জন্য উৎসব পালন করে কিংবা জাতির বা গোষ্ঠীর স্বার্থগত বা ঐতিহ্যগত পরিচয় প্রকাশের জন্য উৎসব পালন করে। কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতির অনন্য উৎসব ঈদ‘, পৃথিবীর অন্যান্য জাতির উৎসব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই উৎসব কোনো গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করার জন্য কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে পালন করা হয়না বরং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত হিসাবে পালিত হয়। কারো ব্যক্তিগত উৎসাহে বা চিন্তাভাবনা থেকে এই উৎসব উৎসারিত নয় বরং শুধুমাত্র মহান আল্লাহর নির্দেশ হিসেবেই চলে এসেছে এই উৎসব। এর মূল লক্ষ্য মানুষের আত্মসংশোধন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির পরিমণ্ডল পেরিয়ে ঈদ নিয়ে আসে সামগ্রিক কল্যাণ। জরাজীর্ণ জীবনকে পরিশুদ্ধ করতে শুদ্ধতার প্রতীকরূপে ঈদ আসে নবজীবনের অঙ্গীকার নিয়ে। সকল বৈরিতাশত্রুতাকে পাশকাটিয়ে মিলনের মহোৎসবে ঈদ আসে সব মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে জড়িয়ে নিতে।

দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর মুসলিম উম্মাহর জন্য খুশির সওগাত নিয়ে আসে ‘ঈদ’ঈদুল ফিতর। পশ্চিমাকাশে শাওয়ালের নতুন যে চাঁদ ওঠে, সে চাঁদ থেকে ঝরে পড়ে আনন্দধারা। সেই আনন্দআলোয় ভরে উঠে চারপাশ। মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেণির মানুষ এ উৎসবে মেতে ওঠেন অনাবিল আনন্দে। প্রাণে প্রাণে বয়ে যায় খুশির জোয়ার। উচ্ছ্বাসমুখরতা ও খুশির আবহে পরিপূর্ণতা পায় ঈদের আয়োজন।

ঈদ খুশির, ঈদ আনন্দের, ঈদ ক্ষমার। ঈদ সব ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে বুকে জড়ানোর। ঈদের অনাবিল আনন্দ বয়ে আনে এক অপার্থিব সুখানুভূতি। এই আনন্দ পরকালীন জীবনের জন্য শান্তি ও মুক্তি লাভের এক অনন্য উপায়। তাই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের রমজান শেষে শাওয়ালের নতুন চাঁদ দেখা মাত্রই খুশির জোয়ার বয়ে যায় প্রতিটি রোজাদারের হৃদয়ে। যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পথের ক্লান্তি ভুলে, ক্লেশ অগ্রাহ্য করে সকলেই ছুটে যান আপন নীড়ে, প্রিয়জনদের কাছে। ঈদগাহে সর্বস্তরের মানুষ আসেন ঈদের নামাজ পড়তে। ঈদউলফিতরের একটি ওয়াজিব বা আবশ্যিক আমল হলো ঈদের নামাজ আদায় করা। ঈদ উৎসব শুরু হয় এই নামাজ আদায়ের মাধ্যমে।

ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা গোসল শেষে পবিত্র হয়ে মিষ্টি মুখ করে সুন্দরপরিচ্ছন্ন পোশাক পড়ে ঈদের জামায়াতে শরীক হন। ইসলাম ধর্মের অন্যতম শিক্ষা হলো সাম্য। ঈদ এই শিক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেয়। ঈদের নামাজে মালিকশ্রমিক ধনীগরিব সকলেই নির্বিশেষে এক হয়ে পৌঁছে যান ঈদগাহে। সারিবদ্ধভাবে এক কাতারে দাঁড়িয়ে সেজদারত হন সৃষ্টিকর্তা মহান রবের প্রতি। সাম্য ও সম্প্রীতির কী অসাধারণ এক অপূর্ব দৃশ্য! ঐক্যের অটুট বন্ধন। এখানে কোনো বর্ণ বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য থাকেনা। নামাজ শেষে সবাই একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কোলাকুলি করেন, যা সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করে। পরবর্তীতে সময়সুযোগ করে আত্মীয় পরিজন বন্ধু স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপার তো থাকেই। ঈদের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করা। ঈদ শুধু ব্যক্তিগত খুশির মুহূর্ত নয় বরং এটি সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার এক মহৎ উপলক্ষ। ঈদের ইতিহাস থেকে বোঝা যায় যে, এটি কেবলমাত্র আনন্দের দিন নয় বরং শান্তি ও সাম্যের এক মহিমান্বিত প্রতীক।

ঈদের প্রকৃত অর্থ শুধু দামি ও রঙিন জামা, হরেক রকম মুখরোচক খাবার আর নানা ধরনের খেলাধুলা এবং আনন্দউৎসব নয়; বরং মানুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করে সাম্য স্থাপন করাই ঈদের মূল উদ্দেশ্য। ঈদ হলো মুমিনের শ্রেষ্ঠ উৎসব। ঈদ হলো সাম্য ও সম্প্রীতির নমুনা। নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে ঈদ আসে শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে। অফুরন্ত কল্যাণের সঙ্গে আলিঙ্গন করে ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ভেঙে বন্ধুত্ব ও মিত্রতার হাত বাড়িয়ে মহামিলনের মহোৎসবে মনকে মাতিয়ে তুলতে। ঈদ আসে পরিশোধিত হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করতে। ঈর্ষা, দ্বেষ, অনৈক্যদূরত্ব ও বিভাজনের প্রাচীর ভাঙাতেই আসে ঈদ। ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিকতায় নয়, ইসলাম সাম্যেসম্প্রীতিতেশান্তিতেমানবিকতায় সমুজ্জ্বল। ঈদ এমন একটি উৎসব, যা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে। তাই ইসলামের অন্যতম উৎসব ঈদের প্রকৃত আনন্দ নিহিত রয়েছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমান অংশগ্রহণে। ঈদ মানুষকে ক্ষমা করতে শেখায়। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার জন্য এটি এক বিশেষ সুযোগ। রমজানের সংযম, ত্যাগতিতিক্ষা, বদান্যতা ও মহানুভবতার গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন ঈদুল ফিতরের দিন। তাই ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে সকল বিভেদবৈষম্য, দূরত্ব ভুলে যদি একে অপরকে সৌহার্দসম্প্রীতির বন্ধনে না বাঁধতে পারি, তবে ঈদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে যাবে।

অনেক অমুসলিমরাও ঈদের উৎসবে অংশগ্রহণ করেন, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ায়। বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে ঈদ উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ। আমরা যদি ঈদের প্রকৃত শিক্ষা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে সমাজে বিদ্বেষ, হিংসা ও বৈষম্যের জায়গায় প্রেম, সৌহার্দ্‌য ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। একদিনের জন্য নয়, বরং সারা বছর ঈদের শিক্ষা আমাদের মনে ধারণ করা উচিত। তাহলে সত্যিকার অর্থে ঈদ শান্তি ও সাম্যের প্রতীক হয়ে উঠবে।

ঈদুল ফিতর আত্মশুদ্ধি ও সংযমের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অপূর্ব সুযোগ করে দেয়। ঈদের মূল শিক্ষা হলো, আমরা যেনো ধনীগরিব নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকি, একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও দয়া প্রদর্শন করি এবং পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করি। ঈদের দিন মানুষ একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়, উপহার বিনিময় করে এবং শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়। ঈদ মানুষকে মিলনের শিক্ষা দেয়। আধুনিক বিশ্বে, যেখানে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে, সেখানে ঈদ আবারও আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য দায়বদ্ধ। ঈদের সময় পরিবারপরিজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলিত হওয়া, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা এবং আনন্দ ভাগ করে নেওয়া সমাজে পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। বিত্তশালী মুসলমানরা গরিব আত্মীয়স্বজনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, খোঁজ খবর নেন নিজের পরিবারের পাশাপাশি অন্যদেরও।

বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধবিগ্রহ ও হিংসার কারণে শান্তি হুমকির মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে, ঈদ উদযাপনের মূল শিক্ষাশান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ বিশ্বব্যাপী মানবতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈদের মাধ্যমে আমরা শিখি কিভাবে পরস্পরকে ক্ষমা করতে হয়, কীভাবে দুঃখকষ্ট ভাগ করে নিতে হয় এবং কিভাবে ভালোবাসা ও সহানুভূতির মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করা যায়। যদি ঈদের শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হয়, তাহলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে শান্তি বজায় থাকবে এবং বিশ্ব আরও মানবিক হয়ে উঠবে।

ঈদ উৎসবের মহান শিক্ষা হচ্ছে হৃদয়ের সব কালিমা, অহংকার, হিংসা, লোভ ও লালসাকে নিধন করে অন্ধকার, বিদ্বেষ, বিভেদ, সাম্প্রদায়িকতাসহ অশুভ ও অসুন্দর মানসিকতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। পরিবার ও সমাজকে আলোকিত করার পথ প্রশস্তকরণে ইহ ও পরকালীন মঙ্গল কামনায় নিজের জীবনকে যথার্থ অর্থে পরিচালনা করার মধ্যেই ঈদ উৎসবের সফলতা ও সার্থকতা নিহিত। সাম্যের বার্তার নিরন্তর প্রচার প্রসার এবং জীবনপ্রবাহকে পরিশীলিত করে বিশ্বকে আলোকোজ্জ্বল করার শক্তিই ঈদ উৎসবকে পরিপূর্ণতা দান করে। ঈদুল ফিতর সব ধরনের বৈষম্য দূর করে সম্প্রীতির বার্তা দেয়। এর মাধ্যমে প্রকাশ পায় সর্বজনীনতা। ঈদ আমাদের সামষ্টিক জীবনে মিলন ও শুভবোধের চর্চার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, ঈদ হোক জীবনকে নবায়ন করার আহ্বান। রমজান যে চিত্তশুদ্ধির পথ দেখিয়ে দেয় তা গ্রহণ করে সমস্ত হিংসাবিদ্বেষ ভুলে সাম্য ও সংহতির সমাজ প্রতিষ্ঠাই হোক আমাদের ঈদুল ফিতরের অঙ্গীকার। সকলের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক ঈদের সওগাত। আলিঙ্গনের মাধ্যমে বিস্তৃত হোক পরস্পরের সৌহার্দ ও শান্তি। সাম্যের বার্তা নিয়ে আসা ঈদে ভালোবাসায় ভরে উঠুক পৃথিবী।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বিদ্রোহ চট্টগ্রাম থেকেই
পরবর্তী নিবন্ধসংগীতে ঈদ