পবিত্র কুরআনে মহানবী (দ.) সম্পর্কে উম্মতের প্রতি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ‘আল্লাহ্্ এবং তাঁর ফেরেশ্তারা নবীর প্রতি ‘সল্লু’ পেশ করেন, হে বিশ্বাসীগণ তোমরাও নবীর প্রতি যথাযথভাবে সালাত ও তাসলিম পেশ কর’– (সূরা আহযাব: ৫৬)। সূরা আহযাবের ৫৩ থেকে ৫৭নং আয়াতে মহানবী (দ.) এর অবস্থান, মর্যাদা এবং তাঁর প্রতি সম্মান ও আদব প্রদর্শন বিষয়ে বিশ্বাসীদেরকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া সূরা আল ইমরানের ৮১–৮২নং আয়াতে মহানবী (দ.) সম্পর্কে পূর্ববর্তী নবীদের অঙ্গীকার গ্রহণের বিষয়টি উল্লেখ আছে। একই সঙ্গে পবিত্র কুরআনের অনেক সূরাতে আল্লাহ্্ এবং রাসূলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের নির্দেশনা সম্পর্কিত আয়াত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সূরা নিসা, সূরা আরাফ, সূরা সাবা, সূরা মুহাম্মদ এবং ঘটনা হিসেবে বায়াতুর রিজওয়ানের শপথ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পৃথিবীর প্রথম মানব এবং নবী হলেন হযরত আদম (আ.)। বেহেশ্তে আল্লাহ্্র আরশের নিকটবর্তী অবস্থান থেকে পৃথিবীতে আগমনের পর বিচ্ছেদজনিত বিরহ–বেদনা হতে মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহ্র নিকট হযরত আদম (আ.) ফরিয়াদ পেশের ওয়াসীলা হিসেবে ‘মুহাম্মদ’ নাম উল্লেখ করেন। এ পবিত্র নামের বরকতে আল্লাহ্ ‘ওহী’ প্রেরণের মাধ্যমে আদমের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে তাঁকে ‘নবী’ ঘোষণা দেন। এ ছাড়া অনেক মশহুর পয়গম্বর মহানবী (দ.) এর উম্মত হবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন।
মহানবী (দ.) হলেন পরম বরকতময় ‘ইনসান–ই কামিল’। তাঁর পবিত্র বিলাদত (জন্ম) মক্কায়, মদীনায় হিযরত এবং বেসাল শরিফ একই দিন ও তারিখে ১২ই রবিউল আওয়াল, সোমবার সম্পন্ন হয়। তিনি ‘হায়াতুন্নবী’ হিসেবে সম্বোধিত। এখন তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে। কিন্তু পবিত্র কুরআন, হাদীস শরিফ, তাঁর প্রবর্তিত পার্থিব জীবন ব্যবস্থা এবং সুমধুর আযান ও সালাতে তিনি সর্বাবস্থায় মানব হৃদয়ে সিংহাসন নিয়ে অবস্থানরত আছেন। এ কারণে তাঁকে আল্লাহ্ প্রদত্ত ‘মর্যাদা’ এবং ‘সম্মান’ এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে ‘ঈদ’ উদ্যাপন করা উম্মতের কর্তব্য এবং দায়িত্ব।
মহানবী (দ.) এর সম্মানে মিলাদ–কিয়াম রাসূলুল্লাহ্ (দ.) এর সময়েও বিদ্যমান ছিল। আবদুল খাত্তাব ওমর কলভী (রহ.) এর ‘কিতাবুল তানবীর ফি মৌলুদুল বসির ওয়াল নজির’ এবং আল্লামা সুয়ূতির (রহ.) ‘সুবিলীল হুদা ফি মৌলুদিল মোস্তফা’ কিতাবে হযরত আবু দ্বারদা (রা.) এর একটি বর্ণনাতে দেখা যায়, হযরত আবু আমের (রাঃ) এর গৃহে মহানবীর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা কালে হুজুর (দ.) সেখানে উপস্থিত হয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। মহানবী (দ.) তখন উল্লেখ করেন, ‘ওহে আবু আমের, নিশ্চয় আল্লাহ্তায়ালা তোমাদের জন্য রহমতের দুয়ার উন্মুক্ত করেছেন এবং সমস্ত ফেরেশ্তারা তোমাদের জন্য দোয়া করছেন। যারা তোমাদের মতো এ রূপ মিলাদ–মাহফিল করবে তারাও তোমাদের মতো পরিত্রাণ পাবে।’ মিলাদ সম্পর্কিত বিষয়ে হযরত হাফেজ ইবনে হাজার মক্কী (রহ.) ‘মৌলুদুল কবির’, আবুল কাসেম মুহাম্মদ ইবনে ওসমান (রহ.) ‘দুররুল মোনাজেম’ এবং আল্লামা সুয়ূতি তাঁর পূর্বোক্ত কিতাবে হযরত আব্বাস (রা.) এর গৃহে মিলাদ অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বর্ণনা প্রদান করেছেন। এ বিষয়ে মহানবী (দ.) উল্লেখ করেন, ‘তোমাদের জন্য শাফায়াত করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে গেল।’
মিলাদুন্নবী (দ.) এর সমর্থনে যারা ফতোয়া দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতি (রহ.), হযরত আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.), হযরত ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.), হযরত শামসুদ্দীন আল–জযয়ী (রহ.), হযরত ইমাম শামসুদ্দীন বিন নাছির উদ্দীন দামেস্কী (রহ.), হযরত কামাল উদ্দীন আল–আদফবী (রহ.), হযরত ইমাম যুরকানী (রহ.), হযরত মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.), হযরত মুহাদ্দিস ইবনে জুযী (রহ.), মসজিদে নববীর ইমাম হযরত শেখ আবু শামা (রহ.), হযরত ইমাম সাখাভী (রহ.), হযরত কুস্তলানী (রহ.), হযরত ইমাম ইবনে হাজার মক্কী (রহ.), শেখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.), হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.), ইমাম কুতুবুদ্দীন আল হানাফী (রহ.), হযরত এমদাদুল্লাহ মোহাজের মক্কী (রহ.) প্রমুখ। এছাড়া ইবনে তাইমিয়া, আবু যরআ ইরাকী, নাছিরুদ্দীন ইবনুত তবাখ, জালাল উদ্দীন কাত্তানী, জহির উদ্দীন জাফর আল মিশরী, শাহ আবদুর রহিম দেহলভী, মাওলানা আবদুল হাই লৌক্ষ্ণভী, মুহাম্মদ বিন জারাল্লাহ বিন যহিরা, শেখ মুহাম্মদ রেযা মিশরী, মৌলভী আশরাফ আলী থানবী সহ অসংখ্য খ্যাতিমান চিন্তাবিদ মিলাদুন্নবী (দ.)-এর পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন।
ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদ্যাপনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) মাত্র তেষট্টি বৎসর পৃথিবীতে অবস্থানকালে তাওহীদ তথা আল্লাহ্ একত্ববাদ প্রচার এবং মানব চরিত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনে বিভিন্ন সময় যে ধরনের কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিলেন এ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করা। যেমন; আল্লাহ্ প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে যেভাবে তিনি জুলুম, নির্যাতন এবং সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে প্রতিপক্ষের হিংসা–বিদ্বেষপূর্ণ আচার–ব্যবহারের সম্মুখীন হয়েও পরম ধৈর্য, সহনশীলতা, সত্যবাদিতার মাধ্যমে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন তা বর্ণনা করা প্রয়োজন। বিশ্বনবী (দ.) শুধু রাষ্ট্রনেতা অভিপ্রায়ে যদি ধর্ম প্রচার করতেন তাহলে ধর্ম প্রচার ব্যতীতও আরবের বাদশাহ্ করার প্রস্তাব তাঁর প্রতিপক্ষরা তাঁকে প্রদান করেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের লোভনীয় ক্ষমতাদর্পের দাম্ভিক প্রস্তাব তিনি অসীম সাহসিকতায় প্রত্যাখ্যান করে প্রমাণ করেছেন যে; তাঁর মহান লক্ষ্য অর্থ–বিত্ত–ক্ষমতা প্রভাব–প্রতিপত্তি নয়, বরং এক আল্লাহ্্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ভিত্তিতে মানব চরিত্রের পরিবর্তন সাধন এবং প্রয়োগিক সংশোধন সম্পন্ন করে মানবকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মর্যাদায় উন্নীত করা। এ জন্যে তিনি মানব চরিত্রে মহান রাব্বুল আলামীনের অতুলনীয় অসীম সৌন্দর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সমূহের বিকাশ সাধনকল্পে নৈতিক বিপ্লব সাধনে সর্বোচ্চ কর্মপন্থা গ্রহণ করেন। এ ধরনের কর্মপন্থা এবং প্রচার কাজে যারা বার বার বাধা প্রদান করে শুভ আয়োজন ও দাওয়াতকে বিনাশ করতে সশস্ত্র কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে তিনি তাদের আক্রমণ এবং জীঘাংসা প্রতিহত ও প্রতিরোধকল্পে আল্লাহ্ নির্দেশে জিহাদের ডাক দিয়েছেন। একই সঙ্গে মানব চরিত্রের ব্যষ্টিক পরিবর্তনের ফলে সামাজিক গতি প্রবাহে যে সামষ্টিক পরিবর্তন সহজসাধ্য হয়ে যায় তার সর্বোচ্চ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে মদীনা সনদের ভিত্তিতে ধর্ম–বর্ণ–গোত্র নির্বিশেষে সকল প্রকার মানবগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতকল্পে সাম্য, ন্যায় বিচার ও মানব মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে মদীনা সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে চরম প্রতিকূল অবস্থা তথা সশস্ত্র পন্থায় বাধাগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত সংঘর্ষ পরিহার করে আল্লাহ্্্র প্রতি আনুগত্য এবং সকল মানুষের প্রতি প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসার দাওয়াত প্রদানের মাধ্যমে অগ্রবর্তী হওয়ার নজির উপস্থাপন করা। এ ধরনের মিশন তিনি মদীনা সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর পর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সাহাবীদের মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে এ ধরনের মিশনে অকুতোভয়ে এগিয়ে আসেন তাঁরই মহান আদর্শে মহীয়ান অসংখ্য অলি, দরবেশ, গাউস, কুতুব, ফকির, মস্ত, কলন্দর, মযজুব চরিত্রের তাসাওউফ সাধকরা। পবিত্র মিলাদুন্নবী (দ.) উদ্্যাপনের জন্যে যেহেতু আল্লাহ্্্ এবং তাঁর প্রিয়তম রাসূলের (দ.) প্রতি পরম আনুগত্য এবং নিঃশর্ত ভালোবাসার সীমাহীন উষ্ণতা উত্তাল তরঙ্গমালার মতো মুসলিম উম্মাহ্্ সহ বিশ্ববাসীকে উদ্বেলিত করে তখন উপর্যুক্ত কর্মপন্থা সমূহের বয়ান সমাজ সংশোধন ও পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম বলে ধারণা করা যায়।
পৃথিবীতে বর্তমান সময়ে নানা ধরনের মতবাদ ও প্রাচ্য–পাশ্চাত্য দর্শন ঘিরে মানব সমাজে বহুধা বিভক্তি রয়েছে। এ সকল মতাদর্শগুলোর মধ্যে অনেক মতবাদ আল্লাহ্র অস্তিত্ব অস্বীকারকারী, ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণকারী এবং কোন কোনটি নৈরাশ্যবাদী, নৈরাজ্যবাদী এবং অনৈতিকতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পৃথিবীর অনেক মানুষ এ সকল মতবাদের পূজারীও বটে। এদের প্রচার–প্রপাগাণ্ডা বহুমুখি। অনেকগুলো মতাদর্শ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ম্যাজিক্যাল আয়োজনে প্ররোচনাদায়কের ভূমিকাও পালন করে থাকে। এ ধরনের অপশক্তি এবং দানবীয় চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ এবং পরাভূত করার জন্য প্রকাশ্যে বিশাল গণ জামায়েত এবং শোভাযাত্রা প্রদর্শনের প্রয়োজন আছে। এ ধরনের সমাবেশ এবং শোভাযাত্রা (জুলুস) ঈদ উৎসবের খোশ মেজাজে যতো বেশি আয়োজন করা যায়, ততো বেশি আল্লাহ্ এবং রাসূল (দ.) বিদ্বেষী মতবাদ অনুসারী দানবরা ভীত এবং সংযত থাকবে। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শোভাযাত্রার জনস্রোত যতো দীর্ঘ এবং জনতার অংশগ্রহণমূলক হবে ততো বেশি ধর্ম, নৈতিকতা এবং তাওহীদ বিরোধীদের অপচিন্তা–অপকর্ম হ্রাস পেতে থাকবে। এছাড়া ইসলাম ধর্মের পুনঃজাগরণ লক্ষ্যে অস্ত্রবল নয় বরং প্রচণ্ড নৈতিক মানসম্পন্ন জনবলের প্রয়োজন অত্যধিক। এ জনবলের দীপ্ত কণ্ঠে যখন ‘ইয়া নবী সালাম আলাইকা’ ধ্বনিত–প্রতিধ্বণিত হবে তখন মানব শত্রু শয়তান ও তার অনুগামীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে। ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদ্যাপনে গণ–সম্পৃক্ততা যতো বেশি বাড়ানো যাবে ততো বেশি মহানবীর (দ.) মর্যাদার পতাকা ভূবনময় পরিদৃষ্ট হবে, বিশ্বময় চির মহান ও নন্দিত থাকবেন মহানবী (দ.) আমিন।
লেখক: লেখক ও গবেষক।