ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশে অনন্য দৃষ্টান্ত চট্টগ্রাম

আ ব ম খোরশিদ আলম খান | মঙ্গলবার , ২ আগস্ট, ২০২২ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

অনেকেই চট্টগ্রামকে দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী আখ্যা দিয়ে পুলক অনুভব করে থাকেন। অন্যদিকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামের নাম দীর্ঘদিন ধরে উচ্চারিত হলেও সত্যিকার অর্থে চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী হতে পেরেছে তা নির্দ্বিধায় বলা যাবে না। কারণ বাণিজ্যিক রাজধানীর তকমা পেতে যত গুণ-বৈশিষ্ট্য-কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন- এর কোনোটিই নেই চট্টগ্রামে। তবে চট্টগ্রাম যে দেশের সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে পীঠস্থান এতে বোধহয় কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। দেশে বহু পথ-মতের মানুষ আছে। প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি রয়েছে। বহু ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে চর্চিত কৃষ্টি সংস্কৃতি এখানকার বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সহাবস্থান জানান দেয়। এদেশে সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ও নিজেদের ধর্মীয় কৃষ্টি সংস্কৃতি মেনে জীবনযাপন করে আসছে।

হিজরি সনের প্রথম মাস মুহররমের দুটি দিন অতীব মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে গণ্য। ১ মহররম হিজরি নববর্ষের প্রথম দিনটিও গুরুত্বপূর্ণ। ১০ মহররম আশুরা আমরা বেশ শোকাতুর চিত্তে পালন করি। কেননা, এদিনে দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে কারবালা ময়দানে। নবী পরিবার তথা আহলে বায়তে রাসূলের (দ) নিষ্পাপ পূতপবিত্র সদস্যগণ ৬১ হিজরিতে কারবালা ময়দানে দ্বীন ও ইসলামের জন্য অকাতরে জীবন উৎসর্গ করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। চট্টগ্রাম থেকে ১২ রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) দিবসে ১৯৭৪ সন থেকে বর্ণাঢ্য আয়োজনে সূচিত জশনে জুলুস আজ সারা দেশ এমনকি সারা বিশ্বে বেশ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। এর রূপকার হলেন গাউসে জামান আওলাদে রাসূল (দ.) আল্লামা হাফেজ সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্‌ (রহ.)। ১৯৮৬ সনে চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ্‌ মসজিদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মহররম মাসের ১ থেকে ১০ম দিন আশুরা পর্যন্ত আহলে বাইতে রাসূল (দ.) স্মরণে শাহাদাতে মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আর ২০১০ সন থেকে ১ মহররম হিজরি নববর্ষ উদযাপনের পথিকৃৎও চট্টগ্রামের কিছু উদ্যমী প্রতিশ্রুতিশীল ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠক। এই জশনে জুলুস, আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল এবং হিজরি নববর্ষের ব্যতিক্রমী আয়োজনের জন্য চট্টগ্রামের নাম ইতিহাসে বিশেষভাবে ঠাঁই করে নেবে এ আশা করা যায়।

বৈশ্বিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী চট্টগ্রামের জশনে জুলুস : গাউসে জমান আওলাদে রাসূল (দ) আল্লামা হাফেজ সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্‌ (রহ.) এর নির্দেশে চট্টগ্রাম নগরের বলুয়ার দিঘি খানকাহ্‌ থেকে আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর (রহ.) নেতৃত্বে ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সনে পর পর দুই বছর সীমিত পরিসরে জশনে জুলুস অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সন থেকে ১৯৮৬ সন পর্যন্ত টানা ১০ বছর জশনে জুলসে নেতৃত্ব দেন রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত শাহসূফি আল্লামা হাফেজ সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্‌ (রহ.)। আর এ জশনে জুলুসের মতো ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের ইসলামী সংস্কৃতির প্রবর্তক হলেন তিনি। প্রায় চার দশক ধরে চট্টগ্রামে লাখো লাখো দ্বীনদার নবীপ্রেমী জনতার অংশগ্রহণে জশনে জুলুসের নেতৃত্ব দেন রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত আওলাদে রাসূল (দ) শাহসূফি আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ (মজিআ)। নবীপ্রেমী লাখো লাখো মানুষ রাজপথে হেঁটে হেঁটে প্রিয় নবীর (দ.) প্রতি সালাত-সালাম পাঠের মাধ্যমে অন্তরের গভীরতম ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায় জশনে জুলুসের মাধ্যমে। ইয়া নবী (দ.) সালাম আলাইকা, ইয়া রাসূল (দ.) সালাম আলাইকা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। আশা করা যায়, চট্টগ্রামের এই জশনে জুলুস একদিন ওয়ার্ল্ড গিনেস বুকে স্থান পাবে এবং জাতিসংঘের ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। বর্তমানে এই জশনে জুলুস ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে সাড়ম্বরে আয়োজিত হচ্ছে বিভিন্ন দরবার ও সংগঠনের পক্ষ হতে।

জমিয়তুল ফালাহ্‌ মসজিদে আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল : মহররম মাসে আহলে বায়তে রাসূল (দ) স্মরণে ১৯৮৬ সন থেকে চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে বর্ণাঢ্য আয়োজনে ১০ দিনব্যাপী পালিত হয়ে আসছে শাহাদাতে কারবালা মাহফিল। এবছর এ মাহফিল ৩৭ বছরে পদার্পণ করেছে। আর চট্টগ্রামে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে বেশ ঘটা করে ধুমধামে শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা হলেন জমিয়তুল ফালাহর প্রথম খতিব অধ্যক্ষ আল্লামা মুহাম্মদ জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ)। আর শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের শুরু থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন বরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে মহররম মাসে আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের দেখাদেখি সারা দেশে বহু স্থানে আজ আহলে বায়তে রাসূল (দ.) স্মরণে শাহাদাতে কারবালা মাহফিল আয়োজিত হচ্ছে। আল্লামা জালালুদ্দীন আল কাদেরী হুজুর কেবলা (রহ) প্রায় সাড়ে চার দশক কাটিয়েছেন চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস ও অধ্যক্ষ হিসেবে। বত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি জামেয়ার অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আর ১৯৮৬ সন থেকে ২০১৬ সন ইন্তেকাল পর্যন্ত ৩১ বছর ধরে তিনি জমিয়তুল ফালাহর খতিব পদে ছিলেন এবং ততোদিন পর্যন্ত শাহাদাত কারবালা মাহফিল আয়োজনেও ছিলেন অগ্রণী ও দিশারীর ভূমিকায়।

সবার আগে চট্টগ্রাম : শত বছর আগেই মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘Chittagong the fore’ বা চট্টগ্রাম সবার আগে। কথাটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য ও বাস্তব। কারণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, ঊনষত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে চট্টগ্রাম দেশবাসীকে পথ দেখিয়েছে। চট্টগ্রামের রাজনীতিক ও সংগঠকরা সব আন্দোলন সংগ্রামে ছিল অগ্রণী ভূমিকায়। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনকালে একুশের প্রথম প্রহরে ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’-শিরোনামে সর্বপ্রথম কবিতা লিখে আলোড়ন তুলেছিলেন চট্টগ্রামেরই বরেণ্য কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক প্রয়াত মাহবুব উল আলম চৌধুরী। যা চট্টগ্রামের কোহিনুর প্রেস থেকে বেশ সাহস নিয়ে ছেপেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব আবদুল খালেক। যিনি ছিলেন গাউসে জমান আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্‌ সিরিকোটির (রহ.) প্রধান খলিফা এবং চট্টগ্রামের পাঠকধন্য দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। একুশের কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও চট্টগ্রাম প্রথম ও সব থেকে এগিয়ে।

হিজরি নববর্ষ উদযাপনও চট্টগ্রাম থেকেই সূচনা : হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। ১ মহররম হিজরি নববর্ষ। এদেশে বাংলা ও খ্রিস্টিয় নববর্ষ বেশ সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়ে এলেও হিজরি নববর্ষ পালনে উদাসীনতা চোখে পড়ে। তবে আশার কথা, দেশে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে বেশ ঘটা করে হিজরি নববর্ষ পালিত হয় ২০১০ সনের ৭ ডিসেম্বর, নগরীর ডিসি হিলে। প্রথম আয়োজনে ছিল চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট। চট্টগ্রামের সমমনা ইসলামী সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদের ব্যানারে ২০১১ সনের ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম ডিসি হিলে দ্বিতীয় বারের মতো হিজরি নববর্ষ পালন করা হয়। হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে এবারসহ তের বারের মতো চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরস্থ আপন গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টারে (৩১ জুলাই ২০২২) রোববার বর্ণাঢ্য আয়োজনে হিজরি নববর্ষ উদযাপিত হয়েছে। হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদের ব্যানারে চট্টগ্রামে হিজরি নববর্ষ উদযাপন নতুন মাত্রা পেয়েছে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

লেখক : সাংবাদিক। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব : হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকেবল বন্ধুত্বই নয়, সব সম্পর্কই দামী
পরবর্তী নিবন্ধক্ষমতার রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক সমাজ মানস