ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাপন্থী সংগঠন হামাসের ভয়াবহ হামলার পর ইসরাইল–ফিলিস্তিন সংঘাত নতুন রূপ নিতে পারে বলে ধারণা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। ৭ অক্টেবরের হামলার ভয়াবহতা ইসরাইলিদের অবাক করেছে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলি হত্যার সাম্প্রতিক এ ঘটনার দায় শুধু হামাস ও নেতানিয়াহু সরকারের নয়, পশ্চিমা নেতৃত্বও এর জন্য দায়ী। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার ভালো করেই জানে, গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রকৃতপক্ষে প্ররোচিত করা হয়েছে। কেননা তারা দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইল যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে আসছে, তাতে সমর্থন দিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়ন এবং বাকিদের তাঁদের বসতিতে বন্দি করে রাখার ঘটনায় পশ্চিমা সরকারগুলো সমর্থন দিয়ে আসছে। গাজায় এখন যে বর্বর আচরণ ইসরাইল শুরু করেছে, তার জন্য পশ্চিমা বিশ্বই দায়ী। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট খাদ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বন্ধ করে দিয়ে ইসরাইল সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ। ছিটমহলে খাঁচার মতো আবাসনে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি নারী, শিশু, পুরুষ ও বৃদ্ধদের তিনি ‘মানুষ রূপী পশু’র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম ‘মিডল ইস্ট আই’–এর একটি প্রতিবেদনে এমন পরিস্থিতি উঠে এসেছে। ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক আমির মাখুল বলেছেন, এটি নজিরবিহীন কৌশলগত হামলা। এর অবসান আন্দাজ করা কঠিন। কারণ উত্তেজনার এমন বৃদ্ধি অস্বাভাবিক প্রকৃতির। এমনকি ফিলিস্তিনি হামলার অবসান হলেও এর দীর্ঘমেয়াদী ও কৌশলগত প্রভাব থাকবে। এটি সংঘাতের প্রকৃতি ও মাত্রা বদলে দিতে পারে। তিনি আরও বলেন, ইসরাইলের গোয়েন্দা, সামরিক ও রাজনৈতিক দ্বিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে শত্রু অঞ্চলে ইসরাইলের যুদ্ধ পরিচালনার যে নীতি রয়েছে সেটির অবসান ঘটেছে। বিবিসির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন এর মতে, হামলাটি ছিল গাজা থেকে হামাসের চালানো সবচেয়ে সুপরিকল্পিত এক সফল অভিযান। সীমান্ত পেরিয়ে হামাস যোদ্ধাদের সবচেয়ে মারাত্মক হামলা ছিল এটি। এক প্রজন্মের বেশি সময়ের মধ্যে ইসরাইল এমন হামলার মুখে পড়েনি।
হামলা সম্পর্কে হামাসের উপ–প্রধান সালেহ আল–আরোরি বলেছেন, তাদের এ লাড়াইয়ের উদ্দেশ্য স্বাধীনতা অর্জন। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম ‘আল জাজিরা’কে তিনি বলেন, এটা কোনো অপারেশন বা চোরাগুপ্তা হামলা নয়। আমরা সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছি। আমরা লড়াই চালিয়ে যেতে এবং লড়াইয়ের পরিধি বাড়াতে চাই। আমাদের প্রধান লক্ষ্য একটা, সেটি হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের পবিত্র স্থানগুলোর স্বাধীনতা। তিনি আরও বলেন, ‘বিজয়, মুক্তি ও স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত হামাস লড়াই চালিয়ে যাবে।’ হামাসের এই আকস্মিক হামলার পর জনগণের উদ্দেশে দেওয়া বিবৃতিতে হামাসকে নজিরবিহীন মূল্য দিতে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ইসরাইলের জনগণ, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি। তিনি আরও বলেন, ‘পাশাপাশি আমি সর্বোচ্চ সংখ্যায় রিজার্ভ সেনাদের সমবেত করার নির্দেশ দিয়েছি। যাতে এমন বড় ও তীব্র পাল্টা হামলা চালানো যায়, শত্রুপক্ষ আগে কখনোই যেমন হামলার সম্মুখীন হয়নি।’
পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকেন, তাদের সঙ্গে ইসরাইলিদের উত্তেজনা প্রায়শই চরমে ওঠে। গাজা ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস শাসন করে। ইসরাইলের সঙ্গে তাদের অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে। গাজার সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল এবং মিশর, যাতে করে হামাসের নিকট কোনো অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে। গাজা এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ইসরাইলের নানা পদক্ষেপ ও কঠোর বিধি নিষেধের কারণে তারা খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। অন্যদিকে ইসরাইল দাবি করে, ফিলিস্তিনিদের সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের এই কাজ করতে হয়। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার বিষয়ে বিবিসি’র নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাংক গার্ডনার মনে করেন, ইসরাইলের নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেট, গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, এর বুহর্মুখী গুপ্তচর সংস্থা, এমনকি ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর যতকিছু আছে– সব মিলেও হামলার হুমকি আঁচ করতে পারেনি কিংবা তারা কোনো সতর্কবার্তা পেয়ে থাকলেও ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য শান্তিবিষয়ক দূত টর ওয়েনেসল্যান্ড বলেন, দুই পক্ষ পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে এগিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস শান্তি ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি তৎপরতা আরো বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
৭ তারিখ সকালে কয়েকশ ফিলিস্তিনি যোদ্ধা গাজা উপাত্যকার সীমানা অতিক্রম করে ইসরাইলে প্রবেশ করে। তারা স্থল, সমুদ্র ও আকাশ পথে প্রবেশ করে ইসরাইলি শহর দখল করে বিস্ময় ছড়ায়। একইসাথে তারা কয়েক হাজার রকেট ছুড়ে ইসরাইলি ভূখণ্ডে। হামাসের পক্ষ থেকে সকল ফিলিস্তিনি সংগঠন ও তাদের মিত্রকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। ৮ তারিখও সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে বেশ কয়েকটি স্থান ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ইসরাইল গাজায় বিমান হামলা শুরুর পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ইসরাইল একটা দীর্ঘ ও কঠিন যুদ্ধে প্রবেশ করেছে। ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক হানি মাসরি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার দুর্বিষহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ফলাফল। ইসরাইল নিয়মিত দখলকৃত পশ্চিম তীর, পবিত্র মসজিদ এবং ইসরাইলে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের হামলা চালিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নিপীড়নের রীতি রয়েছে। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। তবে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন কিছু ইস্যুতে মোটেও একমত হতে পারছে না। এর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে, পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো থাকবে নাকি সরিয়ে নেওয়া হবে, জেরুজালেম নগরী কী উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে; আর সবচেয়ে জটিল ইস্যু হচ্ছে ইসরাইলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন।
হানি মাসরি আরও বলেন, ইসরাইল হয়ত বর্তমান পরিস্থিতিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে কাজে লাগাবে। নেতানিয়াহু সরকারের বিতর্কিত বিচার ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। এ সংস্কার ঘিরে পুরো ইসরাইল বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং বড় ধরনের বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু এই হামলা নিশ্চিতভাবে ইসরাইল–ফিলিস্তিন সংঘাতের ধারা পাল্টে দিবে। ইসরাইলের সম্ভাব্য পদক্ষেপ হিসেবে গাজা উপত্যকায় সেনা মোতায়েন করতে পারে নেতানিয়াহু সরকার। ফলে ২০০৫ সাল থেকে বিদ্যমান উপকূলীয় ছিটমহলটির বর্তমান অবস্থা পাল্টে যেতে পারে। হানি মাসরি আরও বলেছেন, ইসরাইল হয়ত ফিলিস্তিনি ও প্রতিরোধকারীদের ওপর শক্তিশালী হামলা চালাবে। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের হত্যা করতে পারে। সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে নতুন রণক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলীয় লেবানন সীমান্তে। তবে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবিলার যে প্রক্রিয়া ইসরাইলের রয়েছে তা বদলানো কঠিন হতে পারে। কারণ হামাসের কাছে ইসরাইলি বন্দি রয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে একটা ‘দীর্ঘ যুদ্ধ’ সামনে। এই দীর্ঘ যুদ্ধ তাদের সমরাস্ত্র শিল্পের জন্য এবং অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে জনগণের চোখ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে এটি আশীর্বাদ হিসেবে প্রমাণিত। মার্কিন বিমানবাহী রণতরী এখন ফিলিস্তিনের উপকূলের পথে। ইসরাইলকে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা পাঠাচ্ছে ওয়াশিংটন। ইসরাইলি সেনাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের হত্যায় সেগুলো ব্যবহৃত হবে। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে স্থল আগ্রাসনে ইসরাইলি সেনারা এসব অস্ত্র ব্যবহার করবে। এখন বছরে যে চার বিলিয়ন ডলার ইসরাইলকে দেওয়া হয়, নিশ্চিতভাবেই এখন প্রদত্ত অর্থ তার চেয়েও বেশি হবে। ওয়াশিংটনের পাঠানো সেই অর্থ ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নেওয়ার উদ্দেশে ব্যয় করবে। আজকের যে মহা বিপর্যয়, সেটার জন্য পশ্চিমা শক্তির উদাসীনতা, পক্ষপাতিত্ব এবং বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে চালানো ইসরাইলি নৃশংসতার পক্ষে কূটনৈতিক বর্ম গড়ে তোলার বিষয়টি রয়েছে।
বাংলাদেশসহ মুসলিম প্রধান দেশগুলো সবসময় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসলেও বড় ধরনের সংকটে পুরো মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় না। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি কিংবা আরব লীগও ইসরাইলের সঙ্গে সংকটকালে ফিলিস্তিনের পক্ষে খুব জোরালো কোনো ভূমিকা নিতে পারে না। এবার গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস ইসরাইলি ভূখণ্ডে ভয়াবহ হামলার পর নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। উভয় পক্ষের আক্রমণে বহু সামরিক ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সমর্থনে এগিয়ে আসলেও; মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো তেমনভাবে এগিয়ে আসেনি ফিলিস্তিনের পক্ষে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুসলিম বিশ্বেও জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে একাট্টা হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলার কারণে সরকারগুলোর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। ইসরাইলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতার জায়গা হলো ইসরাইলের পক্ষে পশ্চিমাদের অবস্থান। তবে সংঘাতের অবসানে আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ হয়ত সফল হতে পারে। তবে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মনে করেন, বেশ কিছু বিষয় ইসরাইলকে উত্তেজনা বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পশ্চিমাদের আরেকটি বড় সংঘাতের প্রতি অনীহা এবং যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু সৌদি আরব–ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে তখন দেশটি সহিংসতা এড়াতে চাইবে।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।