মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর নারী অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বহুবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, পেয়েছেন জীবনের অর্ধেকের বেশি সময়ের কারাদণ্ডাদেশ, অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে এখনও কারাবন্দি আছেন– সেই ইরানি অধিকার কর্মী নার্গিস মোহাম্মদী পাচ্ছেন এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার। খবর বিডিনিউজের।
নরওয়ের নোবেল ইন্সটিটিউট গতকাল শুক্রবার অসলোতে এক সংবাদ সম্মেলনে ১০৪তম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নার্গিস মোহাম্মদীর নাম ঘোষণা করে। নোবেল কমিটি বলেছে, ইরানে নিপীড়িত নারীদের জন্য নার্গিস মোহাম্মদীর সংগ্রাম এবং সবার মানবাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য তার যে লড়াই, তারই স্বীকৃতিতে তাকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর অধিকারের দাবিতে যে সাহসী সংগ্রাম তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন, সেজন্য তাকে অভাবনীয় মূল্য দিতে হয়েছে। ইরান সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেছে ১৩ বার, পাঁচবার তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। সব মিলিয়ে ৩১ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে এই সাহসী নারীকে। শরিয়া আইনে ১৫৪টি বেত্রাঘাতের মত শাস্তিও পেতে হয়েছে তাকে এবং এই মুহূর্তেও তিনি কারাবন্দি।
৫১ বছর বয়সী নার্গিস মোহাম্মদীর জন্ম ১৯৭২ সালের ২১ এপ্রিল। ১৯৯০’র দশকে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী থাকার সময়ই তিনি সাম্য আর নারী অধিকারের প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে আলাদা করে গড়ে তুলেছিলেন। পড়ালেখা শেষ করে তিনি কাজ শুরু করেন প্রকৌশলী হিসেবে। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কারপন্থি সংবাদপত্রে কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ‘হোয়াইট টর্চার : ইন্টারভিউজ উইথ ইরানিয়ান উইমেন প্রিজনার্স’ নামে একটি বই রয়েছে তার। ২০০৩ সালে তিনি বেসরকারি সংগঠন ‘ডিফেন্ডারস অব হিউম্যান রাইটস সেন্টার’ এর সঙ্গে যুক্ত হন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদী আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ২০০১ সালে গড়ে তোলেন ওই সংগঠন। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কাজ করে যাওয়া নার্গিস মোহাম্মদী প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২০১১ সালে। কারাবন্দি মানবাধিকারকর্মী ও তাদের পরিবারকে সহায়তার অভিযোগে সেসময় তাকে জেল দেওয়া হয়েছিল।
নোবেল পুরস্কারের ১২২ বছরের ইতিহাসে নার্গিস মোহাম্মদী হলেন ১৯তম নারী, যিনি শান্তির জন্য এ পুরস্কার পেলেন। এ পুরস্কারের অর্থমূল্য এবার ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার।
গত বছর ইরানের নীতি পুলিশের হেফাজতে ২২ বছর বয়সী মাশা জিনা আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে তখন থেকে চলা বিক্ষোভ এবং নারী অধিকারের আন্দোলনে নার্গিস মোহাম্মদীর অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে। সেখানে বলা হয়েছে, নার্গিস মোহাম্মদী নারীদের বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়ছেন। নারীদের পূর্ণ মর্যাদায় বাঁচার অধিকারের সংগ্রামকে তিনি সমর্থন দিচ্ছেন। এই সংগ্রামের কারণে ইরানে দণ্ড, নির্যাতন এমনকি শাস্তিও পেতে হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নারীদের আড়ালে রাখা ও শরীর ঢেকে রাখার মত নিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।
মানবাধিকার সংগঠন ‘ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডারস’র বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, ১২ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে ইরানের তেহরানের এভিন কারাগারে বন্দি আছেন নার্গিস মোহাম্মদী। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়ানোর অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। গত দুই দশকের বেশিরভাগ সময় তিনি কারাবন্দি ছিলেন। নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি নার্গিস মোহাম্মদীকে মুক্তি দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে। পুরস্কার ঘোষণার সময় মোহাম্মদীকে ‘স্বাধীনতা যোদ্ধা’ হিসেবে বর্ণনা করেন কমিটির প্রধান বেরিট রেইস–অ্যান্ডারসেন।
ইরানের স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত : শান্তির নোবেলের জন্য নার্গিস মোহাম্মদীর নাম ঘোষণার পর তার পরিবার বলেছে, এই পুরস্কার ইরানের স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। নার্গিস মোহাম্মদীর অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রামে তারা বলেছেন, এই পুরস্কার সকল ইরানির। বিশেষ করে ইরানের সাহসী মেয়ে ও নারীদের জন্য এই পুরস্কার, যারা স্বাধীনতা ও সাম্যের লড়াইয়ে তাদের সাহসিকতা দেখিয়ে বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে।
যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের তথ্য–প্রমাণ তুলে ধরতে অসাধারণ ভূমিকা রাখায় গত বছর শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছে বেলারুশের কারাবন্দি অধিকার কর্মী আলেস বিয়ালিয়াৎস্কিকে। তার সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পায় ইউক্রেনের সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিস এবং রাশিয়ার বন্ধ করে দেওয়া মানবাধিকার সংগঠন মেমোরিয়াল।