ইতিহাস গড়ার দিনে গ্যালারিতে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বাবা’

স্পোর্টস ডেস্ক | শুক্রবার , ২১ নভেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

দ্বিতীয় দিনের প্রথম ওভারে মুশফিক খানিকটা নড়বড়ে শুরু করলেন। আগের দিন অপরাজিত ৯৯ করে মাঠ ছেড়েছিলেন। গ্যালারিতে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন অনেকে। তাদের মধ্যে একজন মাহবুব হামিদ। তার বড় পরিচয় তিনি মুশফিকের বাবা। যার একটি রানের প্রতীক্ষায় গোটা দেশ, তার পরিবারের সদস্যদের অপেক্ষার যন্ত্রণা সহজেই অনুমেয়! কাঙ্ক্ষিত সেই মুহূর্তটি যখন এলো, পরিবারের সবার উচ্ছ্বাস যেন ছুঁতে চাইছিল আকাশ, আর মাহবুব হামিদের নিজেকে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বাবা। আগের রাতটা তার ভালো কাটেনি। উদ্বেগ আর উত্তেজনায় ঘুম ভাঙছিল বারবার। খেলা শুরুর বেশ আগেই ছুটে এসেছেন মাঠে। বাবা হিসেবে, সমর্থক হিসেবে তো বটেই, পাশাপাশি স্মৃতিতে ফিরে ছোট্ট মুশফিককে বড় হতে দেখার সেই পুরনো টান এই অনুভূতিগুলোই তার সকালটা বিশেষ করে দিয়েছে। মুশফিকের পরিবারের জন্য এই টেস্টে একটি হসপিটালিটি বক্স বিশেষভাবে উপহার দিয়েছে বিসিবি। তবে তার বাবাকে বেশির ভাগ সময় দেখা গেছে গ্যালারিতেই। দর্শকদের ভিড়েই অতীতে তাকে দেখা গেছে অনেকবারই।এবার যেন আরও বেশি তিনি মিশে গেছেন সবার আবেগের স্রোতে। প্রথম দিন শেষে তবু মাঠ ছেড়ে গেছেন তিনি মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। মুশফিক রান পেয়েছেন, কিন্তু একটুর জন্য সেঞ্চুরিটা হয়নি। এক রানের দূরত্বটা যখন রাত হয়ে ভর করল, তখন মনটাও তার একটু ভার ছিল, বললেন বাবা মাহবুব হামিদ। ‘একটা রানের জন্য একটা রাত অনেক বড় আফসোস নিয়ে থেকেছি। অনেক উদ্বেগে কেটেছে। বড় আশা ছিল, আবার হতাশাও মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়েছে। কারণ, এরকম ৯৯ রান বা এর আশেপাশে বেশ কবার আউট হয়েছে ও। যেহেতু আজকে প্রথম বলটার মুখোমুখি হবে সকালের দিকে উইকেটটা একটু ভেজা থাকে। এজন্য আমার মধ্যে একটা সংশয় ছিল। তবে বিশ্বাস ছিল যে হবে। সকালে যখন একটা ওভার পুরোটা ডট খেলল, তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ও অনেক চাপ নিয়ে ফেলেছিল মনে হয়। চাপ খুব খারাপ জিনিস যে কোনো খেলায়। শেষ পর্যন্ত যখন হলো, বুকের ভেতর থেকে অনেক বড় পাহাড় নেমে গেলে যেমন লাগে, অমন আমার মনে হয়েছে, আমার অনুভূতি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বাবার মতো। মনে হয়েছে, আজকে আমিই সবচেয়ে সুখী বাবা।’

বাবা হয়ে ছেলের অনেক ম্যাচ মাঠে বসে দেখেছেন। স্বাক্ষী হয়েছেন মুশফিকের অনেক স্মরণীয় ইনিংসের। তবে তার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার গলে সেই ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংসটি। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও যে ইনিংস অমর হয়ে আছে দেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি হিসেবে। ‘ওর খেলা থাকলে আমি দেশের বাইরেও গিয়েছি। গলে প্রথম ২০০ রানটা আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে। যদিও ওর থেকে আগে ডাবল সেঞ্চরি হওয়ার কথা ছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের। কিন্তু আশরাফুল ১৯০ রানে আউট হয়ে গিয়েছিল। মুশফিক বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেছে। আমার কাছে এটাই ওর সেরা ইনিংস। তবে আজকেরটা আমার কাছে বিশেষ কিছু এই কারণে যে, এই সেঞ্চুরিতে সে একটা বিরল রেকর্ডে ঢুকে গিয়েছে। একশ টেস্টে একশ রান করা ক্রিকেটারদরে মধ্যে মধ্যে মুশফিক একাদশ ক্রিকেটার। এটা সত্যিই দারুণ আমার জন্য, আমাদের পরিবারের জন্য।’ আগের দিনের উদ্বেগউৎকণ্ঠার আঁচ অবশ্য ছেলের গায়ে লাগতে দেননি বাবা। শুধু এবারই নয়, খেলা বা সিরিজ চলার সময় কখনোই ক্রিকেট নিয়ে মুশফিকের সঙ্গে সেভাবে কথা বলেন না তিনি।

খেলা চলার সময়, তা টেস্ট হোক, ওয়ানডে বা টিটোয়েন্টি খেলা নিয়ে তখন কোনো আলোচনা করি না। আমরা কথা বলি না, কারণ কথা হলেই খেলাকে কেন্দ্র করে নানা কিছু চলে আসবে। অপ্রয়োজনে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করলে ওর ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তাই কথা হয় না। বাসায় অন্যদের সঙ্গে কথা হয়, কিন্তু আমার সঙ্গে নয়। আমি মনে করি, আমার চেয়ে সে খেলা বেশি বোঝে। আমি চাই না, আমার কোনো কথা দিয়ে তাকে বিরক্ত করি বা চাপ দিই।’ ‘মুশফিকের মাও আজকের সেঞ্চুরি দেখে খুব খুশি হয়েছে। আগে সে খেলাটা পুরোপুরি বুঝত না। এখন চার বা ছয় মারার নিয়ম বোঝে। আমিও শেখানোর চেষ্টা করেছি, আর সে কিছু কিছু অংশ নিজে দেখার মাধ্যমে শেখার চেষ্টা করছে।’ সেঞ্চুরির পরপরই অবশ্য আউট হয়ে গেছেন মুশফিক। তবে শততম টেস্টে ছেলের শত রানের ইনিংস দেখেই বাবার মন ভরে গেছে। ‘যা হয়েছে, আমি তৃপ্ত। প্রথম দিনে হয়তো শতক হয়নি, তবে পরে কোনো ম্যাচে হতে পারত। বাবা হিসেবে ছেলের পারফরম্যান্সই আমাকে সবচেয়ে খুশি করেছে। এখন যা হবে, সেটা আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধহামজাকে ধন্যবাদ জানালেন মুশফিক
পরবর্তী নিবন্ধস্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা মুশফিকের