ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হক

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

কানিজ ফাতেমা | শুক্রবার , ২৭ মে, ২০২২ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ


ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। আপন ব্রতে নিবেদিত কর্মবীর। ক্ষুরধার লেখনী, গভীর অনুসন্ধিৎসা, একনিষ্ঠ অনুশীলন, মেধা ও মনন, নিরলস প্রচেষ্টা, পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং ভাষাগত পাণ্ডিত্যের কারণে আধুনিক যুগের একজন প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের একমাত্র ফুলব্রাইট স্কলার ছিলেন এই গুণী অধ্যাপক। তিনি আমাদেরকে এম.এ. ক্লাসে ৫০১ নং কোর্স “Contemporary History of Europe and America since 1919” পড়াতেন। তাঁর পাঠদান পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিটলার-নাৎসিজম, মুসোলিনি-ফ্যাসিজম, উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা ও জাতিসংঘ, চার্চিল, স্টালিন, ভার্সাই চুক্তি, ফ্রান্সের নিরাপত্তা সমস্যা প্রভৃতি কঠিন ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলোকে খুবই সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিজয়ীদের বিজয় গাঁথা এবং পরাজিতদের করুণ কাহিনী স্যারের আলোচনায় নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হতো। হিটলার পরাজিত হলেও স্যারের মনোমুগ্ধকর আলোচনায় মনে হতো হিটলারই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীর। ড. হকের ইতিহাসচর্চার মূল বিচরণক্ষেত্র ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস, বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা এবং এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। ড. হকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬টি এবং দেশ-বিদেশের গবেষণামূলক জার্নালে অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সুদীর্ঘ গবেষণা জীবনে ইতিহাসচর্চা ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হক দেশ-বিদেশে অনেক একাডেমিক পুরস্কার, স্কলারশিপ, ফেলোশিপ ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি চট্টগ্রাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৯ এর “Scholar’s Day” তে সেরা স্কলার এ ভূষিত হন।

ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হক ১ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের সমুদ্র উপকূলবর্তী জোড়ামতল এলাকার ঘোড়ামরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রাহাত আলী এবং মাতা আয়েশা খাতুন। শিক্ষার হাতেখড়ি পরিবারেই। এরপর তিনি রাজাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। উক্ত বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ৫ম শ্রেণিতে টেলেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করে কুমিরা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে ৮ম শ্রেণিতে জুনিয়র মেধাবৃত্তি লাভ এবং ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ হতে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মেধা তালিকায় ১১তম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন এবং ১৯৬৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিকেও কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের মেধা তালিকায় মানবিক বিভাগ থেকে ১৬তম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে চারটি বিভাগ যথাক্রমে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতির মধ্যে ইতিহাস বিভাগ ছিল অন্যতম। এই ইতিহাস বিভাগেই ছাত্রাবস্থায় মাহমুদুল হক উপমহাদেশের স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আবদুল করিম এবং অধ্যাপক ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন এর ন্যায় শিক্ষকদের সান্নিধ্য লাভ করেন। অসাধারণ মেধার অধিকারী মাহমুদুল হক বাংলাদেশ সরকারের মেধাবৃত্তি নিয়ে কৃতিত্বের সাথে ১৯৭৩ সালে স্নাতক সম্মানে ২য় শ্রেণীতে ২য় স্থান এবং ১৯৭৪ সালে ১ম শ্রেণীতে ২য় স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের মেধাবী ছাত্র মাহমুদুল হক আলাওল হল থেকে গ্রামের বাড়ি সীতাকুন্ডের ঘোড়ামরায় চলে আসেন। মে মাসের মাঝামাঝিতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তেজপুরে চলে যান। তেজপুরের ক্যাম্পে দেড় মাস তিনি গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশলসহ অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে অপরাপর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাঁদের গ্রুপ দেশে প্রবেশ করে। এ গ্রুপে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন কাট্টলীর আনোয়ারুল হক চৌধুরী। মাহমুদুল হক ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার। তাঁরা ১৪ ডিসেম্বর কুমিরা যুদ্ধে অংশ নেন এবং পাকবাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধে জয় লাভ করে। ড. হক ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে রণাঙ্গনে সম্মুখ সারিতে থেকে যুদ্ধ করেছেন। যদিও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করেননি। কেন অন্তর্ভুক্ত করেননি এর জবাবে তিনি বলেন, “দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, কিছু পাওয়ার জন্য করিনি।”

মাহমুদুল হক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শেষে ১৯৭৪ সালের জুলাইতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। কয়েক বছর শিক্ষকতার পর ১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় ৮ম স্থান অধিকার করে বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে এ.এস.পি. হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষাটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম লিখিত বিসিএস পরীক্ষা। রাজশাহীর সারদায় পুলিশ প্রশিক্ষণকালীন তিনি পুলিশ সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পুনরায় প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৮২ সালে কানাডার অনটারিও প্রদেশের উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে দ্বিতীয় এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জেমস কার্বি মার্টিন এর তত্ত্বাবধানে “Quest for Stability : The Role of the United States in the India-Pakistan Conflict, 1947-1971.” শীর্ষক অভিসন্দর্ভের উপর ইতিহাসে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৯৪ সালের মার্চে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সুদীর্ঘ ৪২ বৎসর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে ২০১৫ সালের জুনে অবসর গ্রহণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে Adjunct Professor এবং গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ড. হকের গবেষণা দক্ষিণ এশিয়া বিশেষত: ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সম্পর্কিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বিষয়ে ইতিহাস পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।

ড. হকের The Role of the USA in the India-Pakistan Conflict, 1947-1971: Quest for Stability বইটি তাঁর পি.এইচ.ডি. অভিসন্দর্ভের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়। তিনি বইটিতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অনুকূল অবস্থান থেকে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে দু’দেশের প্রতি মার্কিন ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। উপমহাদেশ ও বাংলার ইতিহাস (১৫২৬-১৯৪৭) বইটিতে ইংরেজ শাসন ও আধুনিক ভারত এবং রাজনৈতিক বিবর্তন (১৮৮৫-১৯৪৭) ড. হক সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেন। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে War and Peace in South Asia: American Policy in Historical Perspective. বইটিতে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশীয় অঞ্চলের “যুদ্ধ ও শান্তি” বিষয়ক ইস্যুগুলোর উপর আমেরিকার নীতি সম্পর্কে করেছেন।
From Autonomy to Independence: The United States, Pakistan, and Emergence of Bangladesh বইটিতে তিনি পঞ্চাশের দশকের শুরুতে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলন থেকে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো অগণিত নারী-পুরুষ ও শিশুদের উদ্দেশ্যে বইটি উৎসর্গ করেছেন। Bangladesh History, Politics, Economy, Society and Culture: Essays in Honour of Professor Alamgir Muhammad Serajuddin বইটি (বর্তমান জাতীয় অধ্যাপক) প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন এর সম্মানে ড. হক সম্পাদনা করেছেন। ৩১ জন পন্ডিতের গবেষণাসমৃদ্ধ এই বিশাল গবেষণাটি বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি ও শাসন, অর্থনীতি ও উন্নয়ন এবং সমাজ ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত সর্বশেষ গবেষণালব্ধ জ্ঞান শুধু বিজ্ঞ সমাজের সামনে উপস্থাপন করেননি, ভবিষ্যৎ গবেষণারও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। ড. মাহমুদুল হকের সম্পাদনায় American Policy towards the Liberation War of Bangladesh in 1971: A Collection of Essential Documents বইটি মূলত: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরী কিসিঞ্জার কর্তৃক অনুসৃত আমেরিকার নীতি সম্বলিত নথির সংগ্রহ।

শিক্ষকতা পেশার সুবাধে যখন ইতিহাস বিভাগের করিডোর দিয়ে যাতায়াত করি তখন স্যারের ছাত্রী হিসেবে ফেলে আসা সে সময়কেই ধারণ করি। আমি ঘ্রাণ পাই হেঁটে যাচ্ছেন একজন মাহমুদুল হক বিভাগের করিডোর দিয়ে। সাদাসিদে বেশে সুন্দর পরিপাটি ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। যার কপালের ভাঁজে খেলা করত ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীদের ঘিরে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আমি আরও টের পাই ইতিহাস বিভাগের ৩১৫ নং কক্ষের ইট-পাথরগুলো জপছে মাহমুদুল হক স্যারের নাম এবং অনুরণন হয় হিটলার, নাৎসী, মুসোলিনী, উড্রো উইলসন, শান্তি চুক্তি-১৪ দফা। ব্যক্তিগত জীবনে সহজ, সরল, নিরহংকারী, অমায়িক ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রচারবিমুখ এই জ্ঞানতাপস ২৫ মে ২০২১ দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্যারকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মকামে অধিষ্ঠিত করুন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি তাঁর কর্ম ও কীর্তির মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগযুগান্তর।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের যাপিত জীবন
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা