স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেকের ‘কীর্তিময় জীবন’ চট্টগ্রামসহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যভুক্ত করার সুপারিশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। একইসঙ্গে প্রতি বছর সাংবাদিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজে প্রতিষ্ঠিতদের ‘ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান ও পান্ডুলিপি আকারে থাকা তাঁর অপ্রকাশিত বিভিন্ন রচনা প্রকাশেরও সুপারিশ করেছেন তাঁরা।
গতকাল শনিবার বিকালে নগরীর জামালখান রীমা কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক : বাংলাদেশের সংবাদপত্রের অন্যতম পথিকৃৎ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু একাডেমি কেন্দ্রীয় কমিটি এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি ও সাংবাদিক নাজিমুদ্দীন শ্যামল।
বঙ্গবন্ধু একাডেমি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ দিদার আশরাফীর সঞ্চালনায় আলোচক ছিলেন প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, ইউএসটিসির সাবেক উপাচার্য ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর হাসিনা জাকারিয়া বেলা।
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদী ও চট্টগ্রাম একে অপরের পরিপূরক। আজাদী পত্রিকাকে বাদ দিলে চট্টগ্রাম নিয়ে আলোচনা চলে না। আবার ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে বাদ দিলে চট্টগ্রামের ইতিহাস বিশেষ করে আধুনিক মানুষের মনন চর্চার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
তিনি আরো বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সংবাদপত্র জগতে না এসে অন্য কাজও করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ওই সময়েই চিন্তা করেছিলেন, চট্টগ্রামের মানুষের মনের কথা, মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, মানুষের সমস্যা এবং চট্টগ্রামের অপার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরার জন্য সংবাদপত্রের বিকল্প নাই। তাই তিনি পত্রিকা প্রকাশনার পথে আসেন এবং তার আসাটা সার্থক হয়েছে। কারণ, আজ আজাদী পত্রিকাকে মানুষ নিজের করে নিয়েছে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আজাদী পড়তে না পারলে মানুষের মন কেমন যেন আনচান করে। প্রশাসক বলেন, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মানুষ আজাদী দেখে বলে, আমার মনের কথাটাই লিখেছে, আমার এলাকার সমস্যার কথাই লিখেছে। তাই মানুষ আজাদীকে নিজের ভাবছে।
মূল প্রবন্ধে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি নাজিমুদ্দীন শ্যামল বলেন, বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের বিরল অবদানের কথা যেমন স্বীকার্য তেমনি তাঁর কীর্তিময় জীবন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সাংবাদিকতা বিভাগে পাঠ্য হওয়া আবশ্যক। তিনি কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক স্মৃতি পুরস্কার চালু করার জন্য রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রবন্ধকার বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের জীবন ও কর্মকীর্তি নিজের জন্য ছিল না। বরং দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন ছাড়াও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তান আমলে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেছেন বুদ্ধিজীবী ও মনীষী হিসেবে। একইসাথে কোহিনূর পত্রিকা থেকে দৈনিক আজাদী প্রকাশনার মাধ্যমে চট্টগ্রাম তথা সারা বাংলাদেশে সংবাদপত্র জগতে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর সম্পাদিত ও প্রকাশিত পত্রিকাসমূহের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও দেশের উন্নয়নের জন্য বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়েছেন।
নাজিমুদ্দীন শ্যামল বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের স্বপ্ন ও মানস সন্তান দৈনিক আজাদী দীর্ঘ পথ চলায় বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধসহ সর্বক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তিনি বলেন, শুধু রাজনীতি, অর্থনীতি নয়, শিল্প সাহিত্য, মনন-মানস, সংস্কৃতি তথা সবকিছুতেই চট্টগ্রাম ছিল এতদঞ্চলে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকার প্রকাশনায়ও পূর্ববাংলায় চট্টগ্রামের যে অগ্রণী ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে ছিল, তাও এগিয়ে নিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। ১৯৫০ সালের ২২ ডিসেম্বর তার সম্পাদিত কোহিনূর পত্রিকার মাধ্যমে ব্রিটিশমুক্ত পাকিস্তানের নানা অন্যায়ের প্রতিবাদও তিনি করেছিলেন। কোহিনূর প্রেস হয়ে উঠেছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি। ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতাটি প্রথম ছাপানোর বিরল গৌরব অর্জন করেছিল কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস তথা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক।
প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ বলেন, সমাজ বদলাতে এবং সমাজে সচেতনতা সৃষ্টিতে সংবাদপত্র কতটা ভূমিকা রাখতে পারে সেটা অনুধাবন করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। সেজন্য তিনি প্রকৌশলী হয়েও, এমনকি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর মতো বিদ্যুৎ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন। কীর্তিমান পুরুষ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাংবাদিকতা জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন এবং সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য নিজেকে নিবেদন করেছেন।
শিক্ষাবিদ প্রফেসর হাসিনা জাকারিয়া বেলা বলেন, আমার তিনটা প্রস্তাবনা আছে। যতদূর জানি, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের কিছু লেখা তথা মহৎ মানুষের জীবনী, কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ ও কিছু স্কুলের পাঠ্যবই পাণ্ডুলিপি আকারে আছে। এগুলো প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব করছি। এছাড়া বর্তমান প্রজন্মকে যদি সত্যিকার অর্থে আলোকিত করতে চাই তাহলে অবশ্যই স্কুল লেবেলে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সম্পর্কে জানাতে হবে। তাই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত সাংবাদিকতা বিভাগে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। তাকে নিয়ে সিলেবাস হোক, সেমিনার ও গবেষণাপত্র হোক। একইসঙ্গে পুরো দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিতদের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হোক।
তিনি আরো বলেন, মুদ্রণশিল্প ও টেকনোলজি যখন অনগ্রসর অবস্থায় ছিল, তখনই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। এর কারণ ছিল চট্টগ্রামের মানস সংস্কৃতিতে আলো ছড়িয়ে দেবেন এবং চট্টগ্রামকে আলোকিত করবেন। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদীর কথা এলে কোহিনূর প্রেসের কথাও আসে। কোহিনূর নামের মধ্যেই আলো বা দীপ্তি আছে। কোহিনূর প্রেস, কোহিনূর লাইব্রেরি ও সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা; তিনটি গড়ে তোলার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামবাসীর বন্ধ মনোজগতের দরজা খুলে দেওয়া।
ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া তাঁর বক্তব্যে প্রবন্ধকার নাজিমুদ্দীন শ্যামল ও হাসিনা জাকারিয়া বেলার প্রস্তাবনায় সমর্থন জানান। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি অব্যাহত রাখলে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রধান প্রকৌশলী হতেন। কিন্তু তিনি সেই জৌলুশের প্রলোভন ছেড়ে মানুষের কথা বলার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক আজাদী। তিনি ধর্মে, কর্মে, জ্ঞানে, মননে পুণ্যবান মানুষ ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা তিনি তাঁর কোহিনূর প্রকাশনা থেকে প্রকাশ করেছিলেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের। তিনি আরো বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক তাঁর কর্মের জন্য মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন।
মফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পের পথিকৃৎ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ও মানবদরদী। সুফিবাদ দর্শন ধারণ করেছিলেন তিনি। সত্যিকার অর্থে একজন প্রজ্ঞাবান মানুষ ছিলেন। ১৯৩৮ সালে তুরস্কে যখন ভূমিকম্প হয় তখন চট্টগ্রাম থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন তিনি। সংবাদপত্র শিল্পের যখন ক্রান্তিকাল তখন তিনি সংবাদপত্র প্রকাশনার মতো সৃষ্টিশীল কাজ করেছেন।
স্বাগত বক্তব্যে সেমিনার প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব আলী আহমেদ শাহিন বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে পেরে আমরা গর্ববোধ করছি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদী স্বাধীনতার কথা বলেছিল। গণতন্ত্র ও নিরীহ মানুষের কথা বলে এ পত্রিকা। পৃথিবী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন সাধারণ মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক।
অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম খান বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ পত্রিকা বলতে বুঝে আজাদী। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে গণমানুষের মুখপত্র হয়ে উঠেছে আজাদী।
জাসদ মহানগর কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সেলিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তৎকালীন সময়ে যাদের নামের আগে ইঞ্জিনিয়ার ছিল, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন উপভোগের সুযোগ ছিল তাঁদের। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে গিয়ে দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক।
চট্টগ্রাম নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি লায়ন এ কে জাহেদ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামের হলেও দৈনিক আজাদী স্বাধীনতার লগ্ন থেকে জাতীয় মর্যাদা লাভ করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে মানুষের প্রতি কমিটমেন্টের কারণে। ইঞ্জিনিয়ার হয়েও চট্টগ্রামবাসীকে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করার জন্য দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক।
ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মিতুল দাশগুপ্ত বলেন, স্বাধীনতা থেকে শুরু করে স্বাধীনতাত্তোর আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের দৈনিক আজাদী।
মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমেদ বলেন, যখন পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে তখন দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক।
জাসদ উত্তর জেলার সভাপতি ভানুরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, চট্টগ্রামকে এবং বাংলার মানুষকে আলোকিত করার জন্য দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক।
সেমিনার উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক হাজী সাহাবউদ্দিন বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ব্যক্তি মানুষ হিসেবে ধর্মপরায়ণ, সেবাপ্রবণ ও দরদি মনের অধিকারী ছিলেন।
সম্মাননা : বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ১১ জনকে সম্মাননা জানানো হয় সেমিনারে। এরা হচ্ছেন মৌলানা কাজী আনোয়ারুল ইসলাম খান, লায়ন এ কে জাহেদ চৌধুরী, আলী আহমেদ শাহীন, ওসমান গণি চৌধুরী, হাজী মোহাম্মদ শাহজাহান, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসির, শাম্মী শিল্পী তুলতুল, তাপস কান্তি দত্ত, এম এ রাসেল, মো. সোলাইমান ও ডা. মৌলানা মোস্তফা হোছাইন।