দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, সাম্য, মানবাধিকার এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে জাতিসংঘের জন্ম হয়েছিল। বিশেষ করে যুদ্ধ, সংঘাত ও হানাহানি বন্ধ করে বিপর্যস্ত মানবতাকে উদ্ধার করে অন্যের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখার তাগিদ থেকেই এই মহৎ অভিপ্রায়ের শুভযাত্রা ঘটেছিল। ৭৭ বছর আয়ু অতিক্রম করে জাতিসংঘ এখন আস্থার সংকটে পড়েছে। সমগ্র পৃথিবীজুড়েই প্রশ্ন উঠেছে জাতিসংঘ নামক প্রতিষ্ঠানটি আর থাকবে কি থাকবেনা। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণেই এই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের কোনো সাফল্য নেই এই কথা নিরঙ্কুশভাবে বলা যায় না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম এবং তৎপরবর্তী নানা দুর্যোগে জাতিসংঘ বাংলাদেশের পাশে ছিল। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ যখন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল তখন জাতিসংঘ এই স্বাধীনতা আন্দোলনকে শুধু মুক্তি আন্দোলন হিসেবে দেখেনি। জাতিসংঘ এটিকে বিবেচনা করেছিল মৌলিক মানবাধিকার দলনের বিরুদ্ধে একটি ন্যায্য আন্দোলন হিসেবে।
তাই জাতিসংঘ সেদিন শরণার্থীদের সহায়তা দানের মধ্য দিয়ে মূলত পূর্বপাকিস্তানের মানুষের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী নেতৃবৃন্দ বাংলার মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় জরুরী সহায়তা চেয়ে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্টের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্বপাকিস্তানের মানুষের ওপর যে ভয়ঙ্কর গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছিল তখন উথান্ট এই গণহত্যাকে তীব্র নিন্দা করে একে ‘মানব ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। যা সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইম বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সফর শুধুই যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সহযোগিতা বয়ে এনেছিল তা নয়; বরং বাংলাদেশের জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় এটি ছিল জাতিসংঘের প্রকাশ্য সমর্থন। পৃথিবীর নানা প্রান্তেই যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে সেখানেই জাতিসংঘ সরব হবার চেষ্টা করেছে। জাতিসংঘের ভূমিকা এবং সামর্থ্য যদি বর্তমানে এমনটাই থাকতো তাহলে পৃথিবীবাসীর জন্য এটি হতো সুসংবাদ। জাতিসংঘের বর্তমান অবস্থা এমন যে, বলা চলে বিশ্ববাসীর আস্থাহীনতা আজ প্রতিষ্ঠানটির জন্য পীড়াদায়ক ঘটনা।
মধ্যপ্রাচ্যের সুদীর্ঘ সংকট নিরসনে জাতিসংঘের নীরবতা শুধু উদ্বেগজনক নয়, রহস্যজনকও। অসহায় ফিলিস্তিন জাতির ভূমি ইসরাইল দখল করে নিজেরা ভূমিপুত্র সেজে বসে আছে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে। পরাক্রমশালী ইসরাইলকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন ও মদদ দিচ্ছে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলি বোমার আঘাতে রক্তাক্ত মরদেহ রাস্তায় পড়ে থাকলে বিশ্ববিবেক শঙ্কিত হয়েছে, আতঙ্কিত হয়েছে । শুধু বিচলিত হয়নি জাতিসংঘ। জাতিসংঘ এই ব্যর্থতা আড়াল করবে কি দিয়ে। মিয়ানমার কর্তৃক অমানবিক ও নৃশংস নির্যাতনে যখন রোহিঙ্গারা দিশেহারা, বাস্তুহারা তখনো জাতিসংঘ মিয়ানমারের ওপর কোনো কার্যকরি হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। বাংলাদেশ যখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে লক্ষ লক্ষ ভাসমান রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার বড় নজির স্থাপন করলো তখন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজবাসভূমে ফিরিয়ে নিতে জাতিসংঘ কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকটকে বাংলাদেশের সংকট নয়, বৈশ্বিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করে এদেরকে নিজদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তাগিদ দিলেও জাতিসংঘের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। কাশ্মীরে রক্ত ঝরছে বহুকাল। কাশ্মীর সংকট সমাধানেও জাতিসংঘ সফল হতে পারেনি। বছরের পর বছর ধ্বংসযজ্ঞ চলছে সিরিয়া ও ইয়েমেন যুদ্ধে। কয়েক লাখ মানুষের প্রাণপ্রদীপ নিভেছে এই সমরে, বাস্তুহারাদের সংখ্যা অনির্ণেয়। এখানেও জাতিসংঘ অসফল। উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সংকট এখন প্রাচীন হতে চলেছে। তাদের বিবদমান দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তির ভূমিকায় জাতিসংঘের কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ বিশ্ববাসী এখনো দেখেনি। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ এমন একটি সময়ে চলমান যখন করোনা মহামারি পৃথিবীর অর্থনীতি ও বাণিজ্যকে একটি ধাক্কা দিয়ে গেলো। রাশিয়া নিজেই জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র পাঁচটির একটি। জাতিসংঘে এই রাষ্ট্রের ক্ষমতা অসীম। ভেটো প্রদানের ক্ষমতার ইতিবাচক প্রয়োগ না করে ভেটোক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলো মূলত জাতিসংঘের মালিক পক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যে স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা পালন করার কথা তারা নিজেরাই যুদ্ধের ইন্ধনদাতা এবং যুদ্ধাবাজ হিসেবে পৃথিবীতে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। তাই রাশিয়ার যুদ্ধাক্রমণ থামিয়ে ইউক্রেনের আকাশে-বাতাসে বারুদের ধোঁয়ার বিপরীতে জাতিসংঘ শান্তির কপোত উড়াবে এমন আশা করাটা প্রায় অসম্ভব কল্পনামাত্র। যুদ্ধের বিপরীতে শান্তি প্রতিষ্ঠাতো অনেক বড় চ্যালেঞ্জই বৈ কি। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নে জলবায়ু প্রশ্নেও জাতিসংঘ কোনো সন্তোষজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। শিল্পোন্নত দেশগুলো দ্বারা সৃষ্ট এই সংকটের ফলভোগ করতে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। দেশগুলোতে নিয়মিত অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও সুনামিসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা দুর্যোগ। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় করণীয় নির্ধারণের ভূমিকাতেও অনুজ্জ্বল জাতিসংঘ।
একজন ব্যক্তি সাদ্দাম হোসেনকে পাকড়াও করার অজুহাতে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ইরাক জনপদের প্রাচীন মেসোপটেমিয় সভ্যতা। তারা লুণ্ঠন করেছিল সমৃদ্ধ বাগদাদ জাদুঘর। ইরাকে কার্যত কায়েম করেছিল পুতুল সরকার। মাত্র একজন ব্যক্তি উসামা বিন লাদেনকে ঘায়েল করে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার দোহাই দিয়ে কান্দাহার পর্বতমালায় যত বোমা নিক্ষেপ হয়েছে এর হিসাব সংক্ষিপ্ত নয়। এই আক্রমণ ও ধ্বংসলীলা কতটা অন্যায্য হয়েছে তা পৃথিবীবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। জাতিসংঘ বলিষ্ঠ কণ্ঠে একটি বিবৃতি দিয়ে এই বর্বরতাকে নিন্দা পর্যন্ত জানাতে পারেনি।
তাই সময় এসেছে জাতিসংঘের গঠনতন্ত্রকে পুনর্বিবেচনা করার। জাতিসংঘ সনদের মূলকথা হচ্ছে- সকল রাষ্ট্রের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি এবং সকল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। বিশ্ববাসীকে যুদ্ধ ও অশান্তি থেকে রক্ষা করা যদি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে জাতিসংঘের সংস্কার এখন সময়ের দাবি। জাতিসংঘ ব্যর্থ হচ্ছে বলে এর অবলুপ্তি নয় বরং বিশ্বশান্তির প্রয়োজনে একটি বিশ্বমানের সংস্থা পৃথিবীবাসীর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন আছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভেটো ক্ষমতার সংস্কার হতে পারে জাতিসংঘ সংস্কারের একটি বড় পদক্ষেপ। অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা কম শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থরক্ষায় জাতিসংঘের প্রয়োজনীয় সংস্কারের পক্ষে রাষ্ট্রীয় জনমত তৈরি করে দাবি উত্থাপন হতে পারে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এই গ্রহটি শান্তির আবাসস্থল হোক জাতিসংঘ দিবসে এই আমাদের আশাবাদ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ।