আসুন, প্রকৃতি নির্ভর সাতরাস্তার মোড়কে বাঁচাই

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানী চট্টগ্রাম

ড. গাজী সালেহ উদ্দিন | শুক্রবার , ১৬ জুলাই, ২০২১ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ


আমি প্রথমে ধন্যবাদ দেই আজাদী পত্রিকা কর্তৃপক্ষ কে, চট্টগ্রাম রেলওয়ে বিল্ডিং অর্থাৎ সি আর বিতে বেসরকারি উদ্যোগে একটি হসপিটাল গড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক যেভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে তাদের মতামত নিয়ে প্রতিফলন ঘটাবে আজাদী পত্রিকা-সেই সুযোগটা করে দিয়েছে।
আমি রেলকর্মচারীর একজন সন্তান হয়ে এবং বাল্যস্মৃতি ধরে রেখে চট্টগ্রাম শহর যে পরিবর্তনগুলো ঘটেছে তার একটি রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করবো। সমুদ্র নদী পাহাড় বেষ্টিত চট্টগ্রাম শহর, প্রকৃতির এই সমন্বয় খুব কম দেশে রয়েছে। বর্তমান চট্টগ্রাম শহরটি বেশীরভাগ ছিল পাহাড়ি অঞ্চল। ব্রিটিশ যুগে চট্টগ্রাম শহরের বৃহৎ একটি অংশ রেলওয়ে ও বন্দরের মালিকাধীন ছিল। একসময় দুটি প্রতিষ্ঠানই একক প্রতিষ্ঠান ছিল,চট্টগ্রামের পূর্ব নাম ছিল “পুষ্পগ্রাম “(কৈলাস চন্দ্র সিংহ ১৩০৩ বঙ্গাব্দ,১৬৪.(তখন এটি প্রাচীন ত্রিপুরার অধীন ছিল) নামকরণের মধ্যেই চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা রয়েছে। চট্টগ্রামের সমতলভূমি খুব কম ছিল, বেশিরভাগ ছিল পাহাড়, যেমন পরীর পাহাড়, চট্টশ্বরী রোডের পাহাড়- যেখানে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে, আমিরাবাদ পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছ। সার্সন রোড, মহসিন কলেজ, এখনো পাহাড়গুলি অক্ষত। ও আর নিজাম রোড, কাজীর দেউড়ি মোড় হিল, (বর্তমানে অ্যাপোলো মার্কেট ও আই পি টাওয়ার) উত্তর খুলশী দক্ষিণ খুলশী। এসব পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে।
বাকি ছিল রেলওয়ে এলাকা। এখানে পাহাড়তলী চক্ষু হসপিটাল, ইমপেরিয়াল হসপিটাল, ইউএসটিসি, ভাসানী ভবন, কিডনি ভবন, ডায়াবেটিক হসপিটাল ও বিজিএমই ভবন, তিনটি পেট্রোল পাম্প রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ হতে খুব কম মূল্যে বা বিনামূল্যে প্রাপ্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এখান হতে রেলওয়ে বা রেল কর্মচারীদের কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। যা পাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল।
চট্টগ্রামের আরেকটি নান্দনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান হল “ফয়’স লেক” এই লেকের পানি পান করেই আমরা জীবন কাটিয়েছি।বিএনপি সরকারের সময় ফয়’স লেক সহ বেশিরভাগ জমির নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি/লীজ দিয়েছে। বর্তমানে ফয়’স লেকের পানি এত দূষণ হয়েছে যা গন্ধে ভরপুর। যদিও শর্তে ছিল ইঞ্জিন বোট চালু হবে না। কিন্তু সে সব শর্ত ভেঙে তারা ইঞ্জিন বড় চালাচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারীদের কাছে এই ফয়’স লেক একটি পবিত্র স্থান। কারণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এখানে শত শত বাঙালিদের হত্যা করেছে নির্যাতন করেছে ও বাঙালি নারীদের ধর্ষণ করে হত্যা করেছে। আমরা ১৯৭৩ সনে ফয়’স লেকের ভেতরে একটি শহীদ মিনার করেছি, সম্মান জানাতে কিন্তু ফুল দিতে যেতে পারি না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ফয়’স লেক এই স্থানটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংরক্ষিত এলাকা। কিন্তু কেউ এই উদ্যোগ গ্রহণ করছে না।
কিন্তু হায় বাঙালি, আমাদের বিএনপি নেতারা এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে লিজ দিয়ে প্রমোদ স্থানের পরিবর্তিত করেছ। বর্তমানে সিআরবি প্রাক্তন রেলওয়ে হাসপাতালটি ইউনাইটেড হাসপাতালের নামে একটি প্রতিষ্ঠান, হসপিটাল সহ গোয়ালপাড়া সহ ৫০০শয্যা বিশিষ্ট হসপিটাল করতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের সাথে রেল কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। রেলের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে বলা হচ্ছে শুধুমাত্র যে হসপিটাল, বাড়িঘর পরিত্যক্ত সেখানে ৬একর জমিতে হসপিটালটি গড়ে উঠবে শিরীষতলা কোন ক্ষতি হবে না। বিভিন্ন তথ্য মতে এই হাসপাতালের মালিক চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতা ও ডাক্তার রয়েছেন।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে : এখানে যদি হসপিটাল হয় তাহলে এখানকার এনভারমেন্ট পরিবর্তন ঘটবে, হাসপাতালে কেন্দ্র করে দোকানপাট হবে গাড়ির ও মানুষের চলাচল অনেক বেড়ে যাবে, শান্ত নিরিবিলি মুক্তবাতাস থাকবে না। চট্টগ্রাম শহরের এ স্থানটি হচ্ছে সবচেয়ে নিরিবিলি এবং বায়ু সেবনকারীদের জন্য যথোপযুক্ত স্থান। অন্যান্য স্থান দখল হয়ে যাচ্ছে। যেমন সার্কিট হাউজ মাঠ,স্টেডিয়াম এলাকা দোকান দোকানময়, ডিসি হিল সংরক্ষিত এলাকা হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন : চট্টগ্রাম শহরে অনেকগুলি হসপিটাল রয়েছে, যেমন সরকারি মেডিকেল কলেজ বেসরকারি সিএসসিআর, EPIC, national, Imperial, bangabandhu Medical College মা ও শিশু, ম্যাক্স সহ আরো অনেক। তাই শহরের কেন্দ্র স্থলে আরেকটি হাসপাতালের প্রয়োজন আছে কি?
তৃতীয়ত রেলের জায়গায় যদি করতেই হয় হালিশহরে ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে, সেখানে প্রচুর জায়গা রয়েছে। ট্রেনিং সেন্টার কে সিআরবিতে স্থানান্তরিত করলে অফিসাররা তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবে, পক্ষান্তরে হালিশহর/পাহাড়তলী এলাকায় কোনো ভালো হসপিটাল নেই, তাছাড়া এলাকা ঘেঁষে আন্তর্জাতিক রোড হয়েছে। কঙবাজার, সাতকানিয়া, বাঁশখালী,আনোয়ারা, সীতাকুণ্ড, মিরেরশ্বরাই ফেনী নোয়াখালী হতে খুব অল্প সময়ে রোগী আসতে পারবে।
চতুর্থত কুমিরায় পাহাড়ের উপর রেলওয়ে হসপিটাল ছিল, যেহেতু সেখানে স্থাপনা রয়েছে, তাই সেখানে হসপিটাল হতে পারে, যাতায়াত ব্যবস্থা যেহেতু অনেক উন্নত হয়েছে, তাই চট্টগ্রাম, রাঙামাটি খাগড়াছড়ি, ফেনী নোয়াখালী সীতাকুণ্ড থেকে প্রচুর রুগী আসার সম্ভাবনা থাকে।
চট্টগ্রাম শহরের বাইরে রোগীদের স্বার্থে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বার্থে আমরা উল্লেখিত দুটি স্থানের মধ্যে যেকোন একটি স্থানে হাসপাতাল স্থাপিত হলে ভালো হয়। এ ব্যাপারে সক্রিয় হওয়ার হতে পারে রেল শ্রমিক নেতা এবং কর্মচারী কর্মকর্তাবৃন্দ, কারণ এই প্রকল্পে তাদের কোন লাভ নেই। আসুন আমরা প্রকৃতি নির্ভর সাতরাস্তার মোড়কে বাঁচাই। আমরা বাঁচি।
লেখক : সমাজবিজ্ঞানী; সাবেক শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোভিড জয়ের লড়াইয়ে
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা