আলসে মায়ের দল

সাজিদ মোহন | বুধবার , ১০ নভেম্বর, ২০২১ at ৮:৪৮ পূর্বাহ্ণ

নদীর ঘুম ভাঙে একদম ভোরে। তখনও চারিদিকে আবছা অন্ধকার। ঘুম থেকে উঠেই মাকে হাতড়ায় নদী। মা বলেন, ঘুমাও। সকাল হতে দেরী আছে। বাইরে এখনো শীত। মা’র কথা শুনে নদীর মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটার কথা।
‘হয়নি সকাল ঘুমাও এখন,
মা বলবেন রেগে।
বলব আমি, আলসে মেয়ে
ঘুমিয়ে তুমি থাক
হয়নি সকাল তাই বলে কি
সকাল হবে না’ক?’
কিন্তু মাকে তো আর আলসে মেয়ে বলা যায় না।
জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢোকে মিষ্টি নরম আলো। পাখি ডাকে একটার পর আরেকটা। নদীর ঘুম আসে না।
মা ঘুম থেকে ওঠেন আরও পরে। ততক্ষণে মোয়াওয়ালা লোকটা বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে
মোয়া লাগবে মোয়া…মোয়া লাগবে মোয়া…বলে কয়েকবার ডেকে যায়।
যে উঠানের মাঝখানে লোকটা দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করে সেটার চারপাশে তিন চারটা ঘর। ছোট ছিমছাম একটা বাড়ি । সবাই সবার আত্মীয়। নদী ও তার বান্ধবীরা তাদের পরিবার নিয়ে থাকে ঘরগুলোতে।
লোকটাকে খুব দেখতে ইচ্ছ করে নদীর। সে তার বান্ধবীদের কাছে শুনেছে লোকটার নানান গল্প। তার এক বান্ধবী সোমা বলেছে, লোকটা নাকি অনেক দূর থেকে আসে। গভীর রাতে রওনা দেয় বাড়ি থেকে। গ্রামে আসতে যেন দেরী না হয়।
আরেক বান্ধবী তপা বলেছে, লোকটার মাথায় একটা বড় বস্তা থাকে। বস্তা ভরে সে মোয়া নিয়ে আসে। সব মোয়া বিক্রি করার পর বস্তাটা খালি হয়ে গেলে, ছোট ছোট বাচ্চাদের সে বস্তার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে। পথে কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। আর জিজ্ঞেস করলেও সে বলে, আজ তেমন বিক্রি হয়নি। দেখেনই তো বস্তাটা ভরা। বাচ্চাগুলোকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে সে মোয়া তৈরীর কাজে লাগায়।
তপার কথাটা নদীর বিশ্বাস হয় না। লোকটার কন্ঠ শুনে মনে হয় না সে খারাপ। কী মধুর সুরে সে ডাকে মোয়া লাগবে মোয়া লাগবে মোয়া…
তপা বলে, তুই দেখি কিছুই জানিস না।হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা যে এতোগুলো বাচ্চাকে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছিল, তার বাঁশির সুরও তো মিষ্টি ছিলো।
পাল্টা জবাবে নদী কিছুই বলতে পারে না।
নদীর আরেক বান্ধবী মিতু বলে, লোকটার নাকি বাড়িতে মা ছাড়া কেউ নেই। মা ছেলের সংসার। মা তাকে মোয়া বানিয়ে দেয়। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শীতের সকালে মোয়া বিক্রি করে সে সংসার চালায়।
নদীর বান্ধবীরা আরও নানান কথা বলে। এসব কথা তারা সবাই শুনেছে তাদের মা’র কাছে। নদীর মত নদীর বান্ধবীদের কেউও লোকটাকে দেখেনি। তাদের সবারই ঘুম ভাঙে খুব ভোরে। কিন্তু মায়েদের ঘুম ভাঙে দেরীতে। ঘুম ভাঙলেও শীতের কারণে মায়েদের উঠতে ইচ্ছে করে না। আর মায়েরা উঠতে উঠতে লোকটা মোয়া লাগবে মোয়া.. বলে অনেকক্ষণ উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডাকে। কয়েকটা কুকুর এসে ঘিরে ধরে তাকে। কয়েকটা মোয়া বের করে সে কুকুরগুলোকে দেয়। কুকুরগুলো আর শব্দ করে না। মানুষের সাড়া শব্দ না পেয়ে সে শেষবারের মত মোয়া লাগবে মোয়া.. ডাকতে ডাকতে চলে যায় অন্য কোন বাড়িতে।
অন্য বাড়িগুলো অবশ্য নদীদের বাড়ির মতো নয়। লোকটা মাথায় মোয়ার বস্তা নিয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে মোয়া লাগবে মোয়া… বলে ডাক দিতেই ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে বাচ্চাকাচ্চারা।দামাদামী করে। হাসি ঠাট্টা করে।একধরনের উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। লোকটা ভারী মজার। সবাইকে এ কথা সে কথা বলে আনন্দ দেয় সে। ভালোবেসে একটা দুইটা মোয়া কেনে সবাই। কাউকে কাউকে লোকটা বিনা পয়সায়ও মোয়া খাওয়ায়। শীতের ঠান্ডা সকালটাকে আনন্দে ভরিয়ে দেয় সে।
ওদিকে নদীদের বাড়িতে মায়েদের ঘুম ভাঙলে ঘর থেকে বের হবার সুযোগ পায় নদীরা। অনেক দেরী হয়ে যায় ততক্ষণে।হাত মুখ ধুয়ে কিছু একটা মুখে দিয়েই সবাই ছোটে স্কুলের দিকে। স্কুলে যাওয়ার পথেই মোয়াওয়ালার বাড়ি। প্রতিদিন নদীদের সঙ্গে তার দেখা হয়। সকালে মোয়া বিক্রির পর বাড়ির সামনে কাঁচা মাটির রাস্তার একপাশে শীতের মিঠে রোদে বসে একমনে কাগজের ঠোঙ্গা বানায় সে। নদীদের প্রতিদিন সে দেখে আর ভাবে, এই মেয়েগুলো জানি কোন বাড়ির। কত বাড়িতে সে যায়। কত মেয়ে সে দেখে। কিন্তু এই মেয়েগুলোকে কখনোই ভোরবেলা সে দেখে না।
মনে মনে সে আরও ভাবে, ভুলে কি এলাকার কোন বাড়ি প্রতিদিন বাদ পড়ে যায়। মনে মনে এক দুই তিন করে বাড়িগুলো সে গুণতে থাকে। না ঠিকই তো আছে। সব বাড়িতেই তো সে যায়।
তাহলে কি মেয়েগুলো পরী? হুট করে আসে, হুট করে চলে যায়।
নানান কথা সে ভাবে আর কাগজে আঁঠা লাগিয়ে ঠোঙা বানায়।
তাড়াহুড়োর কারণে প্রতিদিন এতোটাই ব্যস্ত থাকে নদীরা, লোকটাকে পেরিয়ে যাওয়ার সময় একবারও চোখে পড়ে না তাদের। আর চোখে পড়লেও বা কি? ভোরবেলার মোয়াওয়ালা লোকটা আর ঠোঙ্গা বানানো লোকটা যে একজনই সেটা কী তারা জানে!

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাজার বছর আগে ডুবে যাওয়া শহর
পরবর্তী নিবন্ধবিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসএসসি বিদায় সংবর্ধনা