আমেরিকা-কানাডার পথে

এম. সোহেল খান (টিপু) | শনিবার , ৯ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

ছোটবেলা থেকে আমার দেশ ভ্রমণের ওপর বিশেষ দুর্বলতা ও আকর্ষণ ছিল। তাই যখনই সুযোগ পেয়েছি তখনই বিভিন্ন দেশ ঘোরার চেষ্টা করেছি। তবে ব্যস্ততার কারণে লেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না। এবার চেষ্টা করলাম উত্তর আমেরিকার দুই বৃহৎ দেশ আমেরিকা ও কানাডা ভ্রমণ নিয়ে লিখতে।
২০১৬ সালের জুলাই মাসের আমার আমেরিকা ভ্রমণ নিয়ে আজকের এই লেখা। এর পূর্বে হংকং এ চাকুরির সুবাদে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করলেও আমেরিকা যাওয়া হয়নি। যথা সময়ে ভিসা নিয়ে ও এমিরেট্‌স এর টিকেট নিয়ে ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসির ডালাস এয়ারপোর্টে আমেরিকার সময় দুপুরের দিকে ল্যান্ড করলাম। কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন অতিক্রম করে লাগেজ নিয়ে বের হতেই আমার ছোট বোন শারমিন ও ভগ্নিপতি (ওয়াশিংটনে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চ পদে কর্মরত) ডাঃ তারেককে দেখে আশ্বস্ত হলাম। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি ভার্জিনিয়ার ফেয়ার ফ্যাঙের বোনের বাসায় উঠলাম। আমি আসার কিছুক্ষণ পর আমার বোনের ননদ আলিয়া ও তার অধ্যাপক স্বামী এবং ভার্জিনিয়ায় বসবাসরত চট্টগ্রামের সাবেক ডেপুটি মেয়র ও লায়ন ভাইস্‌ গভর্নর ফারুক সাহেব সস্ত্রীক আমার সাথে দেখা করার জন্য আসলেন। সবাই একসাথে বোনের বাসায় বিভিন্ন পদের সুস্বাদু রাতের খাবার সেরে গল্প-গুজবে ভাল সময় কাটালাম। তারপর ঘুমাতে গিয়ে জেট লেগের কারণে ভাল ঘুম হয় নাই। তাই খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। ফজরের নামাজ পড়ে আশে পাশে একটু ঘুরে দেখলাম। পরিচ্ছন্ন অভিজাত আবাসিক এলাকার প্রত্যেকটি বাড়িই প্রায় একি রকম। কিন্তু ঐ এলাকার আশেপাশে তেমন কোন লোকজন চোখে পড়লনা। বোনকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল- ঐ এলাকায় ডববশবহফ ছাড়া খুব একটা লোকজন দেখা যায় না। পরে সকালের নাস্তা সেরে ভগ্নিপতি তারেককে নিয়ে আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে গেলাম। প্রথমে দেখলাম বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের বাসভবন ডযরঃব ঐড়ঁংব। বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজের মাঝে একটি সাদা বাড়ি। পুরো এলাকাটা ভালো করে ঘুরে দেখলাম কিন্তু পূর্বানুমতি ছাড়া ভিতরে প্রবেশ করা নিষেধ তাই আর আমার ভিতরে যাওয়া হল না। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যেই দেখলাম আশেপাশে প্রচুর কাঠ বিড়ালী নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন ছিল জুলাই মাস আমেরিকার সামার তাই চমৎকার আবহাওয়া। তারপর গেলাম ওয়াশিংটন মনুমেন্ট বা স্মৃতিস্তম্ভ দেখার জন্য যা ডযরঃব ঐড়ঁংব এর খুব কাছেই। মনুমেন্ট ঘুরে মেগডোনাল্ড এ দুপুরের খাবার সেরে স্পেস মিউজিয়ামে গেলাম। যেখানে আমেরিকার মহাশূন্য অভিযানের সব নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। স্পেস মিউজিয়ামে এপোলো-১১ এর চাঁদে অভিযানের মডিউল এবং চাঁদের মাটি হাত দিয়ে ধরে দেখলাম। তাছাড়া আরও বিভিন্ন মহাশূন্য অভিযানের নিদর্শন দেখলাম। বিজ্ঞান যে কতটুকু এগিয়ে গেছে এবং আল্লাহ যে মানুষকে কতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে এই মিউজিয়াম দেখলে বুঝা যায়। তারপর বোনের বাসায় ফিরে এসে বিকেলে নাস্তা সেরে বোনকে নিয়ে কাছে অল্প কিছু কেনাকাটা সেরে তার বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় ফিরে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ পরের দিন আমাদের দাদা (আমার দাদার চাচাতো ভাই) প্রফেসর ড. হারুন খানের বিশেষ অনুরোধে আরকানসাস্‌ যাওয়ার জন্য খুব ভোরে ফ্লাইট ধরতে হবে। ওয়াশিংটন থেকে আরকানসাসের সরাসরি কোন ফ্লাইট নাই, তাই টেঙাস হয়ে আরকানসাস্‌ যেতে হবে। আমেরিকান এয়ারলাইন্সে যথাসময়ে টেঙাস হয়ে আরকানসাস্‌ এর নর্থ-ওয়েস্ট এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালাম। প্রথমে দাদা ড. হারুন খানকে ফোন দিলাম, তিনি অনেক্ষণ এয়ারপোর্টে ঘুরাঘুরি করে আমাকে না পেয়ে জিজ্ঞাস করলেন- তুমি কোন এয়ারপোর্টে? আমি বললাম- নর্থ-ওয়েস্ট আরকানসাস্‌ এয়ারপোর্টে। তিনি বললেন- আমি তো তোমার জন্য লিটলরক এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছি। লিটলরক থেকে নর্থ-ওয়েস্ট আরকানসাসের দূরত্ব নাকি প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। আমার ধারণা ছিল আরকানসাস্‌ ছোট শহর, হয়তো একটাই এয়ারপোর্ট। তাই যাত্রার পূর্বে উনাকে জিজ্ঞাস করা হয় নাই এবং ট্রাভেল এজেন্ট আরকানসাস্‌ বলাতে নর্থ-ওয়েস্ট আরকানসাসের টিকেট দিয়েছে। তখন আমার খুবই অসহায় অবস্থা, প্রফেসর হারুন সাহেব আমাকে বললেন উনার এক বন্ধু আজকে নর্থ-ওয়েস্ট আরকানসাস্‌ থেকে লিটলরকে আসবেন এবং আমাকে লিটলরকে নিয়ে আসার অনুরোধ করবেন। আমি নর্থ-ওয়েস্ট আরকানসাস্‌ এয়াপোর্টে অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখন এক ভারতীয় মহিলা বিমান যাত্রী আমাকে ভারতীয় মনে করে ছোট বাচ্চা নিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন এবং জিজ্ঞাস করলেন- ভারতীয় কিনা। আমি বাংলাদেশি বলাতেও উনি আমার সাথে বেশ আলাপ করলেন। উনি নর্থ-ওয়েস্ট আরকানসাসে ওয়ালমার্ট এর (বিখ্যাত আমেরিকান ব্র্যান্ড যা তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বাংলাদেশে পরিচিত) হেড অফিসে কর্মরত উনার স্বামীর কাছে এসেছেন। ভদ্র মহিলা উনার স্বামীর জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষার পর আমার দাদার অধ্যাপক বন্ধু ডঃ ইব্রাহীম সাহেব আমাকে খুঁজে নিয়ে উনার বাসায় নিয়ে খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, মুরগির মাংস ও গরুর মাংস ভুনা দিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। ভদ্র লোক এবং উনার স্ত্রী বেশ অতিথিপরায়ন। বাঙালি যে খুবই অতিথিপরায়ন বিদেশও তা আবারও দেখলাম। তারপর দুপুরের খাবার শেষে আমরা লিটলরকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভুলের কারণে এই যাত্রায় আমার নর্থ-ওয়েস্ট আরকানসাস্‌ দেখা হল এবং নর্থ-ওয়েস্ট থেকে লিটলরক আসার পথের দৃশ্যটাও বেশ উপভোগ্য। পথে পথে পাহাড়, লেক এবং সবুজের সমারোহ। অনেক হরিণের আনাগোনা দেখলাম। ঐ এলাকায় নাকি অনুমতি নিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ে শিকার করা ও মাছ ধরা যায়। পথিমধ্যে এক জায়গায় সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম দদঘবীঃ ঠরষষধমব ধভঃবৎ ৫০ শরষড়সবঃবৎ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ২৫চ অবাক হয়ে চিন্তা করলাম ওদের ঐখানে আমাদের তুলনায় প্রতি কিলোমিটারে জন ঘনত্ব কত কম। অধ্যাপক সাহেবের কাছে শুনলাম এই আরকানসাসে নাকি বেশ কিছু যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিককে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে এবং তিনি ঐ পুনর্বাসনের সাথেও জড়িত। প্রায় ৪ ঘন্টা ভ্রমণ শেষে আমরা ৭টার দিকে লিটলরকে এসে পৌঁছালাম। আমার দাদা হারুন খান সাহেবের বাসায় উঠলাম উনার স্ত্রী তখন নিউইয়র্কে ছিলেন তারপরও উনি আমার জন্য অনেক পদের রাতের খাবারের আয়োজন করলেন। রাতের খাবার সেরে উনি ছোট বেলায় আমাদের চান্দগাঁও এর বাড়ির আড্ডা ও আমার মা-বাবার (প্রয়াত জেবুন নাহার খান ও ডাঃ শায়েস্তা খান) আতিথেয়তার কথা স্মরণ করলেন। অনেকক্ষণ আমাদের বাড়ীর পুরোনো গল্প শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। (চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিনম্র শ্রদ্ধায় কামিনীকুমার ঘোষ
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাতঙ্কে আয়েশের শীতকাল