তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো অম্ল–মধুর। খুনসুটি, বন্ধুত্ব, ঝগড়া, মান–অভিমান, পারস্পারিক নির্ভরতা, প্রগাঢ় বিশ্বাস – সম্পর্কের এই প্রকাশগুলো আমাদের মধ্যে বরাবরই ছিলো। ভারী চশমা পরিহিত সাদামাটা পোশাকের নিপাট সজ্জন ব্যক্তি, স্ব–নামে খ্যাত একজন মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক ছিলেন আমার বাবা।
জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, বন্ধু, পথপ্রদর্শক ও আমার মানসিক শক্তি প্রদায়ক ছিলেন তিনি। এখনো মনে পড়ে ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে মাস্টার্স সমাপনী পরীক্ষায় ১ম পত্রের পরীক্ষা আশানুরূপ না হওয়ায় হোস্টেল থেকে এক প্রকার পালিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। বাবার কাছে পরীক্ষা ড্রপ দেয়ার ইচ্ছে পেশ করলাম। বললাম, পরীক্ষায় ফেল করার চেয়ে ড্রপ দেয়া অনেক সম্মানের, ফেল করলে সবাই খারাপ বলবে। বাবা তখন তাঁর স্বভাব সুলভ দৃঢ়তায় তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন, ‘তুমি আমার সন্তান, কে কী বললো তাতে আমার কিছুই আসে যায় না, তুমি ফেল করলে ফেল করবে, আমি চাই তুমি পরীক্ষা দিবে।’ তাঁর এই আদেশের সাথে সাথেই আমার হৃত মনোবল দ্বিগুণ হলো, ফিরে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাদ–বাকী পরীক্ষাগুলো ঠিকঠাক মতোন সম্পন্ন করলাম। রেজাল্ট হলে দেখলাম স্কলার রেজাল্ট না হলেও যথারীতি মান–সম্মত রেজাল্ট করলাম। ঠিক সময়ে বাবার এমন একটি সিদ্ধান্ত না পেলে হয়তো শিক্ষা জীবন থেকে একটি বছর অপচয় হয়ে যেতো। বাবার বিচক্ষণতা ছিলো অসাধারণ। শিক্ষক বাবা–মায়ের সন্তান হওয়ায় আমাদের জীবনে কিছু বাড়তি প্রাপ্তি ছিলো, যে কোনো পর্যায়ে স্যারের মেয়ে কিম্বা দিদিমণি‘র মেয়ে এই পরিচয়ে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলাম। এই পরিচিতিটা আমাদের মাঝে অলিখিত দায়বদ্ধতা তৈরি করেছিলো, আমরা যেন কোনো অবস্থাতেই বাবা–মায়ের অসম্মানের কারণ না হই বরং আমাদের কারণে যেন তাঁদের সম্মান আরো সমুজ্জ্বল হয়। তাই, যখনই কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, তখনই বাবার সাথে আলাপ করে সুন্দর সমাধানে সমর্থ হয়েছি। কর্ম–জীবনে রাজনৈতিক প্রভাবশালী সহকর্মীর অনৈতিক রোষানলে পড়ে বেশ উদ্বেগজনক এক সময়ে আমার যুদ্ধ জয় কিম্বা হারা সম্পূর্ণ নির্ভর করেছিলো আমার বাবার সমর্থনের উপর। এই ক্ষেত্রেও বাবার সাহসী সিদ্ধান্ত, ‘তুমি আমার মেয়ে, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না।’ আমার জন্যে বাবার এই আশীর্বাদ বাণীই যথেষ্ট। যুদ্ধ জয় করেই ফিরলাম।
বাবার উদারতা আমাকে আজো বিস্মিত করে, তাঁর স্বল্প সামর্থ্যে আমার দেখা কমপক্ষে ২৫০ মানুষ স্ব–নির্ভর হলেন। শিক্ষা বিস্তার তাঁর ব্রত ছিলো। উনার নিকট–ভবিষ্যৎ বাণী বরাবর মিলে যেতো। যেমন পরীক্ষা শেষে সর্বমোট কত নাম্বার পাবো, ভর্তি পরীক্ষায় কী হবে, চাকরির ইন্টার্ভিউতে কী প্রশ্ন করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা অবাক হতাম বরাবর মিলে যাওয়ায়। সেই বাবা ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে জীবনের শেষ ভবিষ্যৎ বাণীটি করেছিলেন আমাদের পাড়ার এক মামীর কাছে আমাকে নিয়ে, ‘দেখবেন একদিন আমার এই মেয়েটা অনেক বড়ো হবে।’ আমি এখনো সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি, কোনদিন, কখন আমার বাবার শেষ ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হবে! আমি কবে আমার বাবার স্বপ্নের মতোন বড়ো হবো!