আমার সেই ঈদ আর এই ঈদ

মেজর মোঃ এমদাদুল ইসলাম (অবঃ) | শনিবার , ২৯ মার্চ, ২০২৫ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

আমার শৈশব কৈশোরে ঈদ উদযাপনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে যেত রোযার মাঝামাঝি সময় থেকে, বিশেষ করে নতুন জামা কাপড় কেনাকাটার মাধ্যমে। রোযা রাখা নিয়েও এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলত আমাদের সম বয়সীদের মাঝে। এর মাঝে এ নিয়ে মনোমানিল্যও হয়েছে বন্ধুদের মাঝে। সেটি এখন মনে হলে নিজেতেই নিজে হাসি আড়ালে আবডালে। বিষয়টি হল “কলা গাছে রাখা আর ফিরিয়ে নেওয়া রোজা নিয়ে”। এটি একটু খুলে বলি, শৈশবে মায়েরা, আমার মাও আমাকে দিয়ে করিয়েছেন হয়ত অভূক্ত শিশু সন্তানের কষ্টের কথা ভেবে, মা বলতেন যাও কলা গাছে কামড় দিয়ে কলা গাছকে বলবে আমার রোজাটা জমা রাখ আমি আবার এসে নিয়ে যাব। মার আদেশে ঘরের পিছনে কলা গাছে কামড় দিয়ে রোজা জমা রেখে, মা’র কাছে গেলে মা বলতেন তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও তারপর কলা গাছ থেকে আবার রোজা নিয়ে নিও। গো গ্রাসে খেয়ে তাড়াতাড়ি আবার কলাগাছের কাছে গিয়ে বলতাম, আমার রোজা ফিরিয়ে দাও, বলেই কলা গাছে আবার কামড়। রোজা আবার শুরু হয়ে গেল, আমি আবার রোজাদার। ঝামেলা বাঁধত কার কয়টি রোজা হিসাব করতে গিয়ে কোন কোন বন্ধুর কলা গাছে রাখা আর ফিরিয়ে নেওয়া রোজাকে রোজা বলতে রাজি না হওয়া, এ নিয়ে বহু মনোমালিন্য হয়েছে অবুঝ বন্ধুদের মাঝে।

এবার জামা কাপড়ের কথায় আসি।

কৈশোরে আমার মেঝ মামার মোটর সাইকেলের পিছনে বসে একবার চট্টগ্রাম শহরের নিউ মার্কেট গিয়েছিলাম ঈদের জামা কিনতে। শীতের দিন। আমাদের সুবর্ণ গ্রাম থেকে শহরে নতুন জামা কিনতে যাওয়ার উত্তেজনার আবেশে শীতের জামা কাপড় না পরে মামার মোটর সাইকেলের পিছনে বসে পড়েছিলাম। গ্রাম থেকে শহরে যেতে প্রায় কুড়ি মাইল শীতের হিমেল হাওয়া আমাকে প্রায় কাবু করে ফেলেছিল। নিউ মার্কেটে পৌঁছে মামা যখন আমাকে নামতে বলেন তখন আমি অনেকটা ঠান্ডায় জমে গেছি, মোটর সাইকেল থেকে নামার জন্য যে পা তুলব সে বোধও আমার পায়ে বা শরীরে ছিল না। আমি শীতে কাঁপতে থাকি মামা আমাকে ধরে কোন রকমে নামান, ঠান্ডার কামড় আমার সমস্ত শরীরকে প্রায় আড়ষ্ঠ করে রাখে। অনেকক্ষণ পর আমার শরীর শীতের সেই কামড় থেকে আমাকে মুক্তি দিলে আমি অনেক কষ্টে আর লজ্জায় সোজা হয়ে দাঁড়াই। কৈশোরের এই স্মৃতি যখনই আমার মনে উঁকি দিয়েছে তখনই আমার সমস্ত যাপিত ঈদ আমার সামনে আমার ছেলেবেলা হয়ে অনাবিল হাসি হেসেছে, আমিও উদ্বেলিত হয়ে স্মৃতির কৈশোরকে নিয়ে নিউমার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে গেছি অনেকবার। ঈদের চাঁদ দেখা, ঈদ আনন্দের আরেক উপলক্ষ। রোজা শেষে ঈদের চাঁদ দেখার সেকি উৎসুখ্য, সেকি প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। বাড়ির ছাদে উঠে সূর্যাস্তের আগ থেকে পশ্চিমমুখী হয়ে বসে থাকা, কখন সূর্য অস্ত যাবে ঈদের চাঁদ দেখব! যে আগে চাঁদ দেখবে সে সবচেয়ে সৌভাগ্যবাননেককার। এবোধ থেকে চাঁদ দেখার, চাঁদকে সবার আগে খুঁজে বের করার কি এক প্রানান্ত প্রচেষ্টা! চাঁদ কেউ একজন দেখল তারপর শুরু হয়ে যেত হৈ হুল্লুর, তকবীর ধ্বনিত হত এখান সেখান থেকে। কেউ কেউ বাজিও ফুটাত। চাঁদ মেঘের আড়ালে রয়ে গেল, দেখা যায়নি, তখন আবার উৎসুখ্য খবর নেওয়ানেওয়ি দেশের কোথাও চাঁদ দেখা গেল কিনা? এমন কঠিন পটভূমিতে যেই রেডিওতে বেজে উঠত

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ” এই ঈদ সঙ্গীত বেজে উঠার সাথে সাথে কারো মনে আর কোন সন্দেহ থাকত না চাঁদ দেখা যাওয়া নিয়ে। মা গুড়া পিঠা তৈরি রাখতেন, চাঁদ দেখা শেষে আমরা খুব মজা করে সে পিঠা খেতাম।

আমার শৈশব কৈশোরে ঈদের দিন প্রথম কাজ ছিল সকাল সকাল গোসল করে নতুন জামা কাপড় পড়ে আঁতর লাগিয়ে তকবির দিতে দিতে ঈদ গা’র উদ্দেশ্যে যাত্রা। সমস্ত শরীর মনে সেকি শিহরন। একসাথে হাজারো মানুষের নামাজ আদায়। নামাজ শেষে সালাম জানিয়ে কোলাকুলি গলাগলিচিনি বা না চিনি সবার সাথে। অতঃপর ঈদ গা সংলগ্ন কবরস্থানের সামনে গিয়ে দাড়ানো। দোয়া কালাম পড়ে মুনাজাত। আনন্দের দিনে যারা এই প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন প্রিয়জনদের তাদের কথা স্মরণ করে পরম স্রষ্টার কাছে মাগফেরাত কামনা। ঈদের আনন্দের মাঝেও কবরবাসী প্রিয় মানুষগুলিকে মনে করা আমার মনে হয় এটিও ঈদের এক অপুর্ব দ্যোতনা। আমাদের পাড়াটি উত্তর দক্ষিণে কিছুটা লম্বালম্বি, প্রায় দুইশ পরিবারের বসবাস। ঈদ গা থেকে বেরিয়ে কবর বাসীদের জন্য দোয়কালাম শেস করে পাড়ার দক্ষিন দিক থেকে শুরু হত ঘরে ঘরে ঢুকে মুরুব্বি মহিলাদের সালাম। ঘরে ঘরে তৈরি নানা ধরনের খাবার আয়োজন বিশেষ করে নানা ধরনের সেমাই, কোন ঘরে পেপের, কোন ঘরে লাঊয়ের, কোন ঘরে গাজরের তবে ময়দার সেমাই ছিল সবখানে, চুট্টি (হাতে তৈরি ময়দার এক ধরনের গুড়ি গুড়ি সেমাই), মোরগ পোলাও থাকত কোন কোন ঘরে এসব খেতে খেতে নিজ বাড়িতে ফিরতাম।

আমাদের ঘরে ঈদের আয়োজন ছিল ব্যতিক্রমী। গরুর ভাড়াল, গরুর গোস্তের কাল বুনা, গরুর নলা’র ঝোল আর সাদা ভাত। এই আয়োজন পাড়া পড়শীদের মাঝে সব সময় সাড়া জাগাতে দেখেছি ব্যাপকভাবে।

দুপুর গড়াতে স্কুলের মাঠে পাড়ার সব ছেলে মেয়ে জড়ো হয়ে যেত আয়োজিত খেলা ধূলায় অংশ গ্রহণের জন্য। খেলা ধূলার মাঝে উল্লেখ যোগ্য ছিল’ দৌড় প্রতিযোগিতা, সাঁতার প্রতিযোগিতা, মোরগ লড়াই, সূই সুতা গাথা প্রতিযোগিতা, যেমন খুশি সাজ, চামুচে মারবেল রেখে ভারসাম্য দৌড় প্রতিযোগিতা, পিলু পাসিং, বিস্কুট দৌড়, ছালার বস্তায় দু পা ঢুকিয়ে দৌড় ইত্যাদি। প্রতিটি প্রতিযোগিতা আয়োজিত হত বয়স ভিত্তিক যেন সবাই সুযোগ পায় এবং কোন অসম প্রতিযোগিতা যেন না হয়। প্রতিযোগীতায় বিজয়ীদের পুরস্কার হিসাবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বই উপহার দেওয়া হত। এর পিছনে যুক্তি ছিল সবার মাঝে বই পড়ার যেন অভ্যাস গড়ে উঠে। খেলাধূলা প্রতিযোগিতা প্রতিযোগিদের মাঝে কিশোর বয়স থেকেই জীবনে নানা প্রতিকূলতার মুখামুখি হওয়ার প্রত্যয় সৃষ্টিতে কাজ করে বলে আমার প্রতীতি। খেলাধূলার পালা সাঙ্গ হওয়ার কিছু পরে চারিদিকে হ্যাজাক লাইট জ্বলে উঠত আমাদের স্কুলের পুরা মাঠ জুড়ে।

রান্নার মহোৎসব শুরু হত। রাতে পুরা গ্রামের মানুষ নারী পুরুষ র্নিবিশেষে সবার এক সাথে খাওয়ার আয়োজন। জনে জনে সেকি সখ্যতা, সেকি গলাগলি হৃদ্যতা। চারদিকে এক ধরনের হৈ হৈ রৈ রৈ অবস্থা। রান্না শেষ হতেই খাওয়ার পালা শুরু। এ ওর পাতে খাওয়ার তুলে দেওয়ার, পানির গ্লাস এগিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতা। এভাবেই সারাদিনের আনন্দ উৎসবের ক্লান্তিকে গায়ে মেখে আমাদের ঘরে ঘরে ঘুম নেমে আসত। ঈদের পর দিন শুরু হয়ে যেত আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি বাড়ি বেড়ানো। সে বেড়ানোর পথে পথে যাকেই যেখানে পাওয়া গেছে তার সাথে কুশল বিনিময়। দিনমান ঘুরে বেড়ানোর একরাশ স্মৃতির ধূলা গায়ে মেখে ঘরে ফেরা। একধরনের পর্যালোচনার আসর বসত আমাদের ঘরে ঘরে। কে কি জামা পড়েছে, কোথায় কি খাওয়া হল, কার কার সাথে দেখা হল এসব নিয়ে। ঈদ আমাদের পাড়া গাঁয়ে, আমাদের ঘরে ঘরে অনাবিল আনন্দ বিলিয়ে এভাবেই বছর বছর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেত। আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থেকেছি পরবর্তী ঈদের চাঁদ দেখার জন্য পরবর্তী ঈদের আনন্দে অবগাহনের জন্য। অপেক্ষার সেইসব ঈদ কাটিয়েছি আনন্দের ভেলায় ভেসে বছরের পর বছর। স্থির সময়ের বুকে কালেরযাত্রা আমাদের বয়ে নিয়ে চলেছে। মানুষ তার জীবনযাত্রা নির্বাহে অবিরাম নিত্য নতুন পথে এগিয়েছে। এরই মাঝে কলখারখানা, বাণিজ্য, কর্মের সন্ধান মানুষকে ধাবিত করেছে, স্থান থেকে স্থানে মানুষ বসতি করেছে সে বসতি নতুন পরিস্থিতিতে তাকে আবার তাড়িত করেছে।

এভাবেই যেন মর্াক্সিয় তত্ত “থিউরী অব এ্যালিনেশান” অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতার বিষণ্নতা আমাদের সমাজ সংসারে বাসা বাঁধার সুযোগ পেয়ে যায়। আমার শৈশব কৈশোরের সে পাড়া বেড়ানো, স্কুল মাঠে খেলাধূলায় মত্ত হওয়া, রাতে পাড়া পড়শীর একসাথে মহা তৃপ্তিতে মহা আনন্দে ভোজন এখন অনেকটা তিরোহিত।

এখন ঈদ আসলে আমাদের ঘরে ঘরে মায়েরা, বোনেরা সন্তানেরা চোখের পানি মোচেন দূরে যে স্বজন পড়ে আছে বিশেষ করে আমাদের প্রায় প্রতি ঘরের কেউ না কেউ বিদেশ বিভূঁইয়ে তাদের স্মরণে। এখন দেড় কোটির উপর বাঙ্গালী স্বজন আপনজন ছেড়ে জীবিকার তাগিদে পৃথিবীর দেশে দেশে। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য সব খানেই আমাদের প্রিয় স্বজনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এইসব স্বজনদের সাথে ‘পঙ্কজ উদাস’ এর বিখ্যাত গজল চিঠি আয়ে .. স্বদেশের মাটির গন্ধভরে চিঠি নয় আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার বদৌলতে কথা হয়, এ প্রান্ত ও প্রান্ত দুদিকেই চোখের জল টলমল। ঈদের আনন্দের মাঝেও এখন বিচ্ছিন্নতার বিষন্নতাবোধ ঘিরে রাখে আমাদের গ্রাম গঞ্জের পরিবার গুলিকে, বিদেশ বিভূইয়ে যারা তাদেরও।

ছেলের পাঠানো টাকায় নতুন জামা কাপড় পড়ে ঈদের দিন মা বাবা চোখের জলে ভাসেন ছেলের কথা মনে করে, স্ত্রী স্বামীর কথা ভেবে, সন্তান সন্ততি বাবার কথা ভেবে, ভাইবোন প্রিয় ভাইয়ের কথা ভেবে স্মৃতির ভেলায় ভাসেন। ঈদের আনন্দের মাঝে এ এক বেদনার কষ্টের নতুন অভিযোজন আমাদের সমাজ সংস্কৃতিতে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক

কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংগীতে ঈদ
পরবর্তী নিবন্ধমুসলিম মিল্লাতের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব ঈদুল ফিতর