আমার মুক্তিযুদ্ধ, ছাত্ররাজনীতি ও কিছু স্মৃতি

মো. শফিকুল আলম খান | শনিবার , ৩ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির হাজারো বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন। দেখতে দেখতে স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ বছর ২৬ মার্চ মহা ধুমধামের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্‌যাপন করা হয়েছে। ঠিক এই সময়ে, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সে সময়ের ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে নিজের অংশগ্রহণের স্মৃতিচারণ করতে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি।
ব্যক্তিগত তথ্য : আমি ১৯৫১ সালের ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার অন্তর্গত গহিরা, মোবারকখীল, খালদর খান চৌধুরী বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। ১৯৬৭ সালে এস.এস.সি এবং ১৯৬৯ সালে গহিরা কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাস করে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে বি.এ.(সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি হই। সেখান থেকে আমি কৃতিত্বের সাথে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করি।
পেশাগত জীবন : আমি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করি। পরে সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালক এবং সর্বশেষ রেলওয়ের সদর দপ্তর ঢাকায় পরিচালক পদে প্রায় ৪ বছর চাকরি করে ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি।
সাংবাদিকতা : সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে আমি চট্টগ্রাম থেকে সর্বপ্রথম অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা ডেইলী লাইফে সাব এডিটর হিসেবে যোগদান করি। সরকারি চাকরিতে যোগদানের পরেও রেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১৯৮৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আমি এই পত্রিকায় সিনিয়র সাব এডিটর (সন্ধ্যাকালীন) হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর আর একটি ইংরেজি পত্রিকা ‘ডেইলী পিপলস ভিউতে’ ক্ষুদ্র অংশীদার হিসেবে প্রায় চার বছর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি।
ছাত্র রাজনীতি : গহিরা হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নবম এবং দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতির প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সে সময় এলাকায় সরকার বিরোধী কোন মিটিং, মিছিল, হরতাল হলে তাতে অংশগ্রহণ করতাম। ১৯৬৭ সালে নব প্রতিষ্ঠিত গহিরা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমি এবং আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ নাজিম উদ্দীন খান ছাত্রলীগে যোগদান করি। এখানে উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা তৎকালীন বাকশাল, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক, গণ পরিষদ সদস্য মরহুম আবদুল্লাহ আল হারুন, তারই ছোট ভাই আবদুল্লাহ আল রায়হান (রাজু) এবং মামাতো ভাই চট্টগ্রামের অবিসাংবাদিত নেতা সাবেক মেয়র এ.বি.এম মহিউদ্দীন চৌধুরীর সান্নিধ্য এবং প্রেরণা আমাদের দু’জনকে ছাত্রলীগে যোগদান উদ্বুদ্ধ করে। শহীদ নাজিম উদ্দীন খানকে আহ্বায়ক এবং আমাকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে গহিরা কলেজ ছাত্রলীগের সর্বপ্রথম আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর আমাদের প্রচেষ্টায় গহিরা কলেজ তথা গহিরায় ছাত্রলীগের অবস্থান খুবই সুদৃঢ় হয়। ইতোমধ্যে আমরা রাউজান থানা ছাত্রলীগের কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। ১৯৬৯ সালে জেলা ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা আবদুল্লাহ আল রায়হান (রাজু) এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে রাউজান থানা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মোঃ ইউসুফকে সভাপতি আমাকে সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং শহীদ নাজিম উদ্দীন খানকে সাধারণ সম্পাদক করে রাউজান থানা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। সম্মেলনের কয়েক মাস পর মো. ইউসুফ সরকারি চাকরিতে যোগদান করলে আমাকে থানা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। এরপরে উত্তর মহাকুমা ছাত্রলীগের কমিটিতে শহীদ নাজিম উদ্দীন খানকে সভাপতি এবং আমাকে সহ সম্পাদক করা হয়। একই সাথে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কার্যক্রমের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম।
ছাত্র আন্দোলন : ছাত্রলীগে যোগদানের পর ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১১ দফা তথা অসহযোগ আন্দোলনসহ সমস্ত আন্দোলন, হরতালে আমি সরাসরি অংশ নিয়েছি। থানা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর শহীদ নাজিমের নেতৃত্বে আমরা রাউজানের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। রাউজান কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিজয়ের জন্য গহিরা থেকে আমি, শহীদ নাজিম উদ্দীন খান ও মারুফ শাহ চৌধুরীসহ ছাত্রলীগের সবাই কঠোর পরিশ্রম করেছি।
সাধারণ নির্বাচন : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চট্টগ্রামের অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এর বিজয়ের জন্য আমি অন্যান্যের সাথে সারা রাউজানে প্রতিদিন প্রচারণা চালিয়েছি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যাপক খালেদ এর প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লীগের প্রার্থী ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাড়ি ছিল আমাদের এলাকা গহিরায়। যার কারণে সে সময় আমাদেরকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করে খালেদ সাহেবের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হত। সে সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাউজান কলেজ মাঠে নির্বাচন সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। আমরা ছাত্রলীগের কর্মীরা এই মহাসমাবেশ এর সফলতার জন্য রাত দিন কেটেছি। রাউজান কলেজ মাঠে সমাবেশ শেষে বঙ্গবন্ধু সন্ধ্যের পর বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুনের বাসায় আসেন। সেখানে একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধু আমরা ছাত্র লীগের কর্মীদের সাথে পৃথকভাবে মিলিত হন এবং আমাদেরকে নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেন।
জানুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনা : পরিতাপের বিষয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ের পরও পাকিস্তানি সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করায় আমরা গহিরাসহ সমগ্র রাউজানে প্রতিদিন মিছিল, মিটিং করে জনগণকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতাম। অসহযোগ আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা সমগ্র রাউজানে আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছি। এরমধ্যে গহিরা হাই স্কুল মাঠে বিকেলে সামরিক মহড়া শুরু করে দিয়েছি। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর পহেলা এপ্রিল পর্যন্ত আমরা সেখানে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাই। গহিরা স্কুলের দোতলায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই.পি.আর এর ক্যাম্প স্থাপনে সর্বাত্তক সহযোগিতা করি। তাদের জন্য এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে রসদ সংগ্রহ করে তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করি। সে সময় খবর আসে যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন জোয়ান পথ হারিয়ে বেতবুনিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের কর্মীরা জনগণকে নিয়ে তাদের ঘেরাও করে রাখে এবং পরে তারা আত্মসমর্পণ করে। রাতে তাদেরকে গহিরা হাই স্কুলের দোতলায় নিয়ে আসা হয়। তাদের মধ্যে একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ঐ দিন গভীর রাতে তাদেরকে সর্ত্তার ঘাট ব্রিজে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ভূমিকা : ইতোমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রাম শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সামনের দিকে আগাতে থাকে। আমরা চিন্তা করলাম এখন আর দেশে থাকা নিরাপদ হবে না, এপ্রিল মাসের ২ তারিখ শহীদ নাজিম উদ্দীন খানের নেতৃত্বে, আমি নিজে, মারুফ শাহ চৌধুরী এবং কামাল মিয়া ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ফটিকছড়িতে একরাত অবস্থান করে পরের দিন আমরা রামগড়ে পৌঁছাই। ঐদিন বিকেলেই আমরা ফেনী নদী পার হয়ে ভারতের সাব্রুং এ প্রবেশ করি। সেখানে সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যের পর রামগড় হাই স্কুলে ফিরে আসি। রামগড় হাইস্কুলে শুরু হয় নতুন জীবন। স্কুলের ছাত্রদের বসার লম্বা টুলে রাতে ঘুমানো, সারা রাত মশার কামড়, পরদিন সকালে স্কুল মাঠে প্যারেডসহ বিভিন্ন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণে অংশ নেয়াই ছিল আমাদের কাজ। সেখানে সে সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান, তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ছাড়া বাঁশখালীর এম.পি সুলতানুল কবির চৌধুরী, কঙবাজারের গোলাম রাব্বানী, ছাত্রনেতা এস.এম. ইউসুফ সহ জেলা ছাত্র লীগের অনেক নেতাকে দেখতে পেয়ে আমরা বেশ অনুপ্রাণিত হই। ২৬/২৭ এপ্রিল তারিখে আমরা ভারতে পার হয়ে যাই। সেখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর আমরা দু’জন অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই শহীদ নাজিম ছাড়া আমরা তিনজন রামগড় থেকে ভিন্ন পথে বের হয়ে দেশে রওনা হই। তবে সিদ্ধান্ত ছিল ছাত্রলীগের আরো কর্মী নিয়ে আমরা আবার ভারতে ফিরে যাব। দেশে ফিরে দেখি গ্রামের অবস্থা খুবই শোচনীয়। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দোসরদের নিয়ে রাউজানের সমস্ত হিন্দু বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, দানবীর নতুন চন্দ্র সিংহসহ শত শত লোককে তারা নির্বিচারে হত্যা করেছে। চারদিকে ঘর বাড়ি লুটপাট করেছে। মারুফ শাহ এবং আমি বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে লুকিয়ে আছি। এর মধ্যে মামাতো ভাই মহিউদ্দীন চৌধুরী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সরাসরি গ্রামে আসেন। তিনি আমার মায়ের আপন জেঠাতো ভাইয়ের ছেলে। তিনি আমাদের ঘরে দু’দিন ছিলেন। [৪ জানুয়ারি ’১৯ তারিখে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার লেখা ‘মহিউদ্দীন চৌধুরী স্মৃতির দর্পণ’ শীর্ষক নিবন্ধ দ্রষ্টব্য] আমি এবং চাচাতো ভাই মারুফ শাহ চৌধুরী তাঁর সাথে ভারতে যেতে চাইলে তিনি আগে ভারতে পৌছে খবর দেয়ার পর আমাদেরকে ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
গেরিলা অপারেশন : আমি এবং মারুফ শাহ চৌধুরী আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আমাদের জুনিয়র কয়েকজন ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে ফিরে কোন অপারেশন ছাড়া বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকি। আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করলাম। তাদেরকে নিয়ে চাচাতো ভাই মারুফ শাহ চৌধুরীর কাচারি ঘরে গভীর রাতে মিটিং করতাম। তাদেরকে বললাম এভাবে বসে থাকলে তো হবে না। আমাদেরকে অপারেশন চালাতে হবে। ঠিক করলাম আসে পাশের কোন রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন চালাব। পাকিস্তানি আর্মীদের কাছ থেকে আগে পাওয়া কিছু অস্ত্রসহ ইতোমধ্যে আমাদের কাছে বেশ কিছু রাইফেল, এল.এম.জি, এস.এম.জি এবং গ্রেনেড হস্তগত হয়। প্রথমে আমরা চট্টগ্রাম রাঙামাটি সড়কে সত্তারঘাট ব্রিজে পাহারারত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার কথা ভেবেছি। কিন্তু ব্রিজটি প্রধান সড়কের উপর অবস্থিত বিধায় বেশি ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে তা বাতিল করি। পরে আমরা কাগতিয়া হাটের ব্রিজে পাহারারত রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নি। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন রাত বারোটার পর মুক্তিযোদ্ধা মারুফ চৌধুরীর কাচারি ঘরে আমরা সমবেত হই। এই অপারেশনে আমি নিজে, মুক্তিযোদ্ধা মারুফ শাহ চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লা, মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ খান, সিরাজদৌলা খান, আকতার আহমদ খান অংশ গ্রহণ করি। বাইরে তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে দু’মাইল পথ হেটে আমরা কাগতিয়া হাট পোস্ট অফিসের সামনে পৌঁছাই। সেখান থেকে আমরা রাজাকার ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি চালাই। প্রায় দু’ঘন্টা থেমে থেমে আমরা গুলি চালাতে থাকি। এরমধ্যে রাজাকারদের মধ্যে অনেকে নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে এবং অন্যরা পালিয়ে গিয়েছিল। এই অপারেশন এর কারণে ঐ এলাকা দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত রাজাকার মুক্ত ছিল এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ঐ রাস্তা দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পেরেছিল। আমাদের ঘরে মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিতেন। শহীদ নাজিম উদ্দীন খান এবং মঞ্জুর মোর্শেদকে বিভিন্ন সময়ে আমাদের ভিতরের ঘরের একটি রুমে রাখা হত। আমার মা বাঁশের বেড়ার ঘরের চারদিকে শাড়ি এবং বিছানার ছাদর দিয়ে ঢেকে দিতেন যাতে পাশের ঘর থেকে কেউ দেখতে না পায়। উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধে আমার মায়ের বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি অস্ত্র লুকিয়ে রাখাসহ বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা মারুফ শাহ্‌ চৌধুরী কর্তৃক ১৩ এপ্রিল ২০১৪ আজাদী পত্রিকায় লিখিত “জীব কেটে যায় লজ্জায়” শীর্ষক নিবন্ধে বিস্তারিত রয়েছে।
মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র আক্রমণ : এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হাটহাজারীস্থ মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অপারেশন চালানোর জন্য আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম নোয়াজিসপুরে আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আবদুল বারীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। তারা আমাদের গ্রামের বাড়ির পার্শ্বে হালদা নদী দিয়ে আবুরখীলে যাবেন। আমাদেরকে এই ব্যাপারে সংবাদ দিলে আমাদের বাড়ির পাশে সোনাইর মুখে আমরা আগে থেকে নৌকা ঠিক করে রাখি। আমি নিজে, আকতার মিয়া, মারুফ শাহ চৌধুরী, সিরাজদৌলা খান তাদেরকে আশ্রয়স্থল থেকে নিয়ে নৌকায় করে আবুরখীল আশ্রয়স্থলে পৌছে দিয়েছি [২৪ জানুয়ারি ’১৫ ভোরের কাগজে মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু কর্তৃক লিখিত ‘মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র অপারেশন’ নিবন্ধে বিস্তারিত]।
সনদ বিষয় : ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি এবং মারুফ শাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম শহরে এসে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগ নেতা এস.এম. ইউসুফ ভাইয়ের সাথে দেখা করি। তিনি আমাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমাদের এলাকায় যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাদের জন্য মুজিব বাহিনী প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি স্বাক্ষরিত সনদপত্র আমাদের নিকট হস্তান্তর করেন। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর আমাদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন বিপর্যয়। এলাকার মুসলিম লীগ সমর্থকেরা তখন আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা আমাকে প্রধান আসামী করে মারুফ শাহ চৌধুরী, কামাল মিয়া, আকতার মিয়া, নওশের আলী খান, বখতেয়ার উদ্দীন খান, জসিম উদ্দীন খান, সাইফুদ্দীন খালেদ খান এবং আলি আসগর এর বিরুদ্ধে দুটি অস্ত্র মামলা দায়ের করে। আমরা প্রায় এক বছর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াই। পুলিশ আমাদের বাড়িতে বারবার হানা দেয়। এ সময়ে আমার সহজ সরল মা মুক্তিযুদ্ধের আমার সনদপত্র, বঙ্গবন্ধুর সাথে তোলা ছবি এবং ছাত্রলীগের সমস্ত কাগজপত্র চুলার আগুনে জ্বালিয়ে ফেলে। পরে তৎকালীন আইন সচিব আবদুল কুদ্দুস সাহেবের সহযোগিতায় নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়ায় আমরা মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাই।
সনদ প্রসঙ্গে আমার কথা : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলাম। মাত্র ৫ বছর ছাড়া চাকরি জীবনের পুরো সময়ই স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী সরকারের অধীনে আমাকে চাকরি করতে হয়েছে। সারা জীবন অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেও চাকরিকালীন মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। উল্লেখ্য যে, আমার সাথে সর্বপ্রথম যারা ভারতে গিয়েছে এবং আমার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছে সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরবর্তী সময়ে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নিলে দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার চীফ রিপোর্টার স্নেহভাজন ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা নওশের আলী খান ব্যক্তিগতভাবে আমার অফিসে উপস্থিত হয়ে আমাকে ফরম দিয়ে যায় এবং তা পূরণ করে দেয়ার জন্য বারবার ফোনে তাগিদ দেয়। চাকরির ব্যস্ততা এবং এক ধরনের অবহেলার কারণে তা আর দেয়া হয়নি। তখন ভাবছিলাম নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য এ বয়সে আবার কর্তৃপক্ষ বা অন্যের নিকট ধর্ণা দিয়ে কি হবে! মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে সরকারের নিকটতো নতুন করে আমার চাওয়ার কিছুই নেই। নিজের যোগ্যতায় চাকরি নিয়েছি এবং সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। জীবনে যাই কিছু প্রতিষ্ঠা বা অর্জন সবকিছু হয়েছে ব্যক্তি প্রচেষ্টায়। সেখানে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সনদ বা অন্য কারো কোন সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মুক্তিযুদ্ধের সনদ দিয়ে নতুন করে পাওয়ার কিছুই নেই। যুদ্ধে গিয়েছি, যুদ্ধ করেছি দেশের ও প্রাণের তাগিদে, কিছু প্রাপ্তির জন্য নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ অংশ নিতে পেরেছি জীবনে এটাই বড় প্রাপ্তি।

লেখক
বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনার সংক্রমণ বৃদ্ধিতে জনজীবন বিপর্যস্ত, প্রয়োজন অধিক সতর্কতা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে