আমাদের পথের দিশারী

হ্যাপী বড়ুয়া | বুধবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ

কোন কোন মানুষের সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও কেমন করে যেন আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার শ্বশুর অধ্যাপক মৃণাল কান্তি বড়ুয়া তেমনই একজন মানুষ। যিনি জন্মদাতা পিতা নন, বৈবাহিক সূত্রে আমার শ্বশুর, কিন্তু তাকে ছাপিয়েও তিনি কখন যেন আমার বাবার আসনেই বসে গেছেন! ২০০০ সালে আমার বিয়ে হয়ে যখন এ বাড়িতে বড় বৌ হয়ে আসি, তখন থেকেই এ মানুষটি সবসময় আমাকে স্নেহের চাদরে মুড়ে রেখেছেন। আমাকে কোনদিনই বৌমা বলে ডাকেননি, নাম ধরে ডেকেছেন। তাঁদের মেয়ের অভাব পূরণ করতে গিয়ে আমাকে দিয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা, ঘোমটা টানা বৌ হয়ে আমাকে থাকতে হয়নি, বিয়ের কদিন পর থেকেই থ্রীপিস পরে আমি ঘুরে বেরিয়েছি, ইউনিভার্সিটি গিয়ে ক্লাস করেছি। যা আমার সমসাময়িক অনেক মেয়ের পক্ষেই করা সম্ভব হয়নি।
কত মেয়েরই তো বিয়ের পরে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়! অথচ আমার বেলায় ঘটেছে এর উল্টো। মাস্টার্স পড়ুয়া এই আমি, বৌ হয়ে এসে মাস্টার্স পাশ করলাম, আমার শ্বশুর ও শাশুড়িমার একান্ত ইচ্ছায় এম.ফিলও করলাম, এমনকি বিসিএস করার পেছনেও আমার শ্বশুরের উদ্যোগই ছিল প্রধান। একদিন তিনি বাসায় এসে আমার হাতে তুলে দিলেন ২৪তম বিসিএস এর আবেদন ফরম। বললেন এটা ফিলাপ কর। আমি বললাম, বাবা, এটা কেন আনলেন? আমাকে দিয়ে বিসিএস হবে না। বাবা বললেন, ‘হোক বা না হোক, তুমি এটা ফিলাপ কর। কার ভাগ্যে কি আছে কেউ জানে না।’ আসলে তাঁর কথা রাখতেই আমি ফরমটি পূরণ করে জমা দেই, এরপর তাঁর কথা রাখতেই আমি প্রিপারেশান নেয়া শুরু করি, যার ধারাবাহিকতায় আমি আজ একটি সরকারি কলেজের শিক্ষক।
আমাদের এই সমাজে একজন কর্মজীবী মায়ের চলার পথ খুব কঠিন, কারণ সংসার সামলে, বাচ্চা সামলে নিজের পেশায় মনোযোগ দেয়া অনেক কঠিন, সেই তুলনায় আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করি, আমার সংসার, তিনটি বাচ্চাকে বড় করার পাশাপাশি পেশাগত কাজ করে গেছি সমানভাবে, আর তা করা সম্ভব হয়েছে আমার পরিবারের এই মানুষগুলোর ঐকান্তিক সাহায্য আর সহানুভূতির কারণে।
আমার মেয়েকে একবার স্কুলে প্রশ্ন করেছিল, ‘তোমার প্রিয় বন্ধু কে?’ উত্তরে সে বলেছিল, ‘আমার দাদু’। আসলেই, এই পরিবারের পাঁচটি বাচ্চার প্রিয় বন্ধু ওদের দাদু। কত গল্প করে, কত দুষ্টুমি করে দাদুর সাথে, তাঁর কিছুতেই কোন বিরক্তি নেই। বাচ্চাদের আশ্রয় আর নির্ভরতার জায়গাও ওদের দাদু। দাদু ঠাকুরমার রুম, বিছানা সারাদিন এই বাচ্চাদের দখলেই থাকে।
বাবা পেশায় একজন প্রকৌশলী, শিক্ষক। তিনটি ছেলেকে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে, নিজের আদর্শে, সঠিক উপদেশ ও নির্দেশনা দিয়ে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। শুধু তাই নয়, তিনটি বাইরের পরিবারের মেয়েকে নিজের ঘরে এনে সবাইকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছেন, যে কারণে আমাদের এই একান্নবর্তী পরিবারে আমরা হাসি কান্না সুখ দুঃখ সব একসাথে ভাগাভাগি করে নিই। আমার শ্বশুর শাশুড়ির সহন ক্ষমতা, দূরদর্শীতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।
শুধু নিজের পরিবার নয়, এ সমাজের আরও বহু পরিবারেরও তিনি অভিভাবক হয়ে আছেন। নিজ গ্রামের ও নিজ সমপ্রদায়ের সর্বোপরি নিজ মাতৃভূমির অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নের জন্যই তাঁর চিন্তা চেতনা সবসময় আবর্তিত হয়। এমনকি মৃত্যুর পরে তাঁর এ দেহটি যাতে ভবিষ্যৎ ডাক্তারদের কাজে লাগে সে জন্য তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেলের এনাটমি ডিপার্টমেন্টে মরণোত্তর দেহ দান করেছেন। অত্যন্ত সাধারণ, ছিমছাম জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে নিজের পুরো জীবন অতিবাহিত করেছেন, আজ তিনি পঁচাত্তর বছরে উপনীত। বয়সী বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় আমরা সন্তান সন্ততিরা পথ চলছি নির্ভয়ে, কারণ আমরা জানি, তিনি আছেন আমাদের পথের দিশারী হয়ে। তিনি থাকুন আরও বহু দিন আমাদের মাথার উপরে ছায়া হয়ে, আমাদের পথের সামনে আলোকবর্তিকা হয়ে। তাঁর নীরোগ ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমশার জ্বালা
পরবর্তী নিবন্ধ‘এ চড়াই-উতরাইকে প্রতিদিনই আনন্দচিত্তে আলিঙ্গন করতে হবে’