আমাদের কন্যারা! সগৌরবে মহিমান্বিত হও

ফারিহা জেসমিন | মঙ্গলবার , ৪ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ভাবতে ভালোই লাগছে, লিখতে গর্ব বোধ করছি এই পৃথিবীতে, যেখানে কোথাও কোথাও মেয়ে শিশুরা এখনো পুরোপুরি মানুষের মর্যাদা পায়নি, সেই পৃথিবীতে তাদের জন্য আলাদা একটা দিবস আছে। এই দিনে কন্যা শিশুর জন্ম ও কর্মকে স্বীকৃতি এবং সম্মান জানানো হয়। তাদের অধিকার, সুযোগ সুবিধা, তাদের সাথে হয়ে যাওয়া বৈষম্য এবং এর প্রতিকার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সাড়ম্বরে এই দিনটি উদযাপনের জন্য প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব কন্যা শিশু দিবস পালন করা হলেও বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে কন্যা শিশু দিবস পালন করা হয়। এই বছর ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ সেই রোববার।
২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় কন্যা শিশু দিবস পালিত হয়ে থাকে। একজন কন্যা হিসেবে আমি সমস্ত কন্যা সন্তানকে আমার এই লিখনি উৎসর্গ করলাম।
আমার হারানোর তালিকা ততটা দীর্ঘ নয়, যতটা দীর্ঘ হলে মন ভেঙে যায়, বেঁচে থাকা এক ধরনের শাস্তি মনে হয়। তবে ব্যাপার আছে। আমি যা যা হারিয়ে ফেলেছি, সেসব বিষয় বেশ গুরুত্ববহ বা মানুষগুলো অনেক মূল্যবান যা আর কখনো ফিরে আসবে না।
আমি স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই তিনি আমাকে কন্যা শিশু হিসেবে জগতে পাঠিয়েছেন। আমি জানি আমার মা-বাবাও আমার মতো কন্যা সন্তান পেয়ে চিরকাল উদ্বেলিত। আমারও একটা কন্যা সন্তানের খুব শখ ছিল, আমি কল্পনায় তার নামও রেখেছিলাম। আমার দেখা সুন্দরতম নদীর নামে, ইয়ারা। যা-ই হোক আমার হারানোর তালিকায় সেই স্বপ্ন যোগ দিয়েছে, সেই মূল্যবান স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে।
আজ পৃথিবীর সব ইয়ারা ও সব ইয়ারার মাদের আমি শুভেচ্ছা জানাতে চাই। সব ইয়ারা যেন পৃথিবীর সুন্দরতম সুখী কন্যা হয়, ঠিক আমার মতো। আমার নাম এর অর্থের মতো। পৃথিবীর সব ইয়ারা যেন মানবিক ও সাহসী মানুষ হয়, আমার কল্পনার মতো। লিঙ্গ বৈষম্যের এই পৃথিবীতে সকল ইয়ারা হোক মুক্ত বিহঙ্গ, ডানা মেলে উড়ে বেড়াক স্বপ্নের স্বাধীন আকাশে।
আমার ইয়ারা, জীবন চলার পথটা মসৃণ নয়, এখানে চড়াই -উৎরাই থাকবে। কেউ তোমার হাত ধরবে, কেউ হাত ছেড়ে দিবে। কেউ পাশে থাকবে, কেউ পাশ থেকে সরে যাবে। তুমি একা হয়ে যাবে। তুমি শুন্যতা অনুভব করবে। কিন্তু তুমি একেবারেই ভয় পেয়ো না। হাজারের তাবত শক্তি তোমার মাঝে সুপ্ত, তুমি নিজেকে শুধু আবিষ্কার করো। তোমার আলোকিত অন্তরের স্বচ্ছ আয়নায় নিজেকে দেখো, খুঁজে পাবে এক শক্তিশালী, উন্নত, বুদ্ধিদীপ্ত এবং জোরালো প্রতিচ্ছবি। বিশ্বাস রেখো ওটাই তুমি , শক্তিমান তুমি।
পৃথিবীতে সবাই সমান ভাগ্যশালী হয় না, সবার সাথে জুড়ে থাকতে পারে না। মনের মিল হলেও মতের মিল নাও হতে পারে। হঠাৎ করেই তোমাকে একা করে চলে যেতে পারে। তাই তোমাকে একাকীত্বকে বরণ করে নেয়ার মত মানসিক সক্ষমতা অর্জন করে নিতে হবে।
মনে রাখবে, জীবনের ক্যানভাসে একাকীত্ব একটা আর্ট, সবাই একে উপভোগ করতে পারে না , সবাই এত শক্তিমান শিল্পী হয় না। তুমি হবে সেই গর্বিত শিল্পী যে তার শোককে শক্তিতে বিনির্মাণ করে, যে পুরো জীবনের পথ একাই ভ্রমণের সাহস রাখে।
ইয়ারা, তোমার শুনে অবাক লাগবে মেয়ে শিশুরা এই পৃথিবীতে এখনো কতোটা অবহেলিত নিপীড়িত! তোমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে যখন তুমি জানবে এই জগতে এখনো কন্যা শিশুর কতোটা অমানবিক পরিনতি হয়। অনেক সময় কন্যা শিশু হবার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হয়, ঠিক আদিম যুগে যেমন জীবন্ত কবর দেয়া হত। জগতের কিছু মানুষ এখনো এত নিষ্ঠুর যে, এই বিশ্বায়নের সময়ে যখন চারিদিকে মানবাধিকারের জয় জয়কার, তখনো অনেক দেশে কন্যা শিশুকে পৃথিবীতে আসার আগেই হত্যা করা হয়। পুরুষের শাসন করা সমাজে কন্যা শিশুকে পরিবারের বোঝা হিসেবে দেখা হয়, তাদেরকে পর্যাপ্ত বিদ্যা-শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, ঘরের আস্তাকুঁড়ে ফেলে রাখা হয়। তুমি শুনলে অবাক হবে যে, আমাদের দেশে অনেক কন্যা শিশুকে নিতান্তই শিশু বয়সে যখন তার প্রাইমারি স্কুলে যাবার কথা সেই বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়, যাকে বলা হয় বাল্য বিবাহ। এতে করে সেই কন্যা শিশু অল্প বয়সে স্বাস্থ্যহানি, অকাল সন্তান জন্মদান, পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতাসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
পৃথিবীতে তোমার গন্তব্যের দিকে তোমার পথটা ভীষণ দুর্গম। চলতে চলতে দেখবে, মাঝ পথে শকুন এসে খামচে ধরছে কিন্তু সেই শকুনের চোখ তোমাকে উপড়াতে হবে। মেয়ে শিশুরা অনেক সম্ভাবনাময়ী, তারাও ছেলে সন্তানদের মত উপযুক্ত সুবিধাসহ বেড়ে উঠার অধিকার রাখে।
মনে রাখবে, নারীরাও পুরুষের সমান কাজ করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়, সেই যোগ্যতা তাদের আছে। যেকোনো ধরনের বৈষম্য তাদের সেই ক্ষমতাকে অবদমিত করে রাখতে পারে।
কর্মস্থলসহ বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় এমনকি তোমার পরিবারে -বিভিন্ন সময় তোমাকে বৈষম্যের শিকার হতে হবে। তোমাকে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তোমার বাইরে কাজ করার উপর নিষেধাজ্ঞা আসবে, তোমার আর্থিক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হবে। সবাই এডজাস্ট করতে বলবে। তুমি তা করো না ইয়ারা। তাহলে তুমি হয়ে যাবে একা, অবহেলিত, টেকেন ফর গ্রান্টেড। তোমাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়তে হবে, মানবিক যুদ্ধে নামতে হবে। তোমাকে দেখিয়ে দিতে হবে তোমার চাওয়া-পাওয়া, তোমার নেয়া সিদ্ধান্তগুলো যৌক্তিক ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে চলে আসা বৈষম্যের সংস্কারের শিকড় তোমাকে উপড়ে ফেলতে হবে তোমার নিজের যোগ্যতায়। মানুষের বিবেকের দীনতা, চোখের নিলাজ চাহনি এবং কন্যা শিশুর বিরোধিতার বলী হওয়া যাবে না কোনোভাবেই। তাই তোমার লড়াই হবে কঠিন ও দীর্ঘ। কিন্তু বিশ্বাস রেখো নিজের উপর গন্তব্য তুমি খুঁজে পাবেই।
ইয়ারা, তুমি জানলে কষ্ট পেয়ো না যে, এই গ্রহ এখনো কন্যা শিশুর জন্য নিরাপদ নয়। বাইরে বের হলে ধর্ষণের শিকার হবার ভয় থাকে, অন্যায়ভাবে নিপীড়িত হবার আশঙ্কা থাকে। আমাদের দেশেই প্রতিদিন ইভটিজিং এর শিকার হয় অনেক কন্যা শিশু, অপমান সইতে না পেরে তাদের অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এতে করে, ঝরে যায় কতো সম্ভাবনাময় তাজা প্রাণ।
তোমার শারীরিক গঠন ও তোমার পোশাকের উপর কিছু মানুষরূপী অমানুষের লোলুপ দৃষ্টি থাকবে। আর তাই তোমাকে হতে হবে তেজস্বী ও প্রতিবাদী।
কোনো সময় হয়তো দেখবে, তোমার কিংবা তোমার পরিবারের সবচে কাছের পুরুষ বন্ধুটাই তোমাকে হতবাক করে দিয়ে তোমার খোলা পিঠে হাত দিতে চাইবে অথবা তোমাকে ধর্ষণ করবে। তুমি বা পরিবার চুপ করে থাকবে কারণ লোকে নিন্দে করবে। কিন্তু তোমাকে সেই পরিস্থিতি উতরে আসতে হবে, তোমার পাশে কেউ থাকবে না। সমাজ বা রাষ্ট্র এর বিচার করবে না। কিন্তু তুমি প্রতিবাদ করবে, তোমাকে অসম্মান করার প্রতিশোধ নিবে। দেখো একদিন সকলে তোমাকে বাহবা দিবে, তুমি নন্দিত হবে ইয়ারা।
আমার ইয়ারা, এই পৃথিবীতে পদে পদে তোমাকে নিজের যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হবে, কোথাও পাশের সনদ মিলবে, কোথাও সেটা জুটবে না। অনেকেই তোমার নারীত্বকে নগ্নভাবে অবহেলা করবে, উপেক্ষা করবে তোমার নিখুঁত পারদর্শিতাকে। শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে কটাক্ষ করে তোমার উপযুক্ততা স্বীকার করে নিতে চাইবে না। তুমি ভেঙে পড়ো না, কাউকে পরোয়া না করে শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াবে। দেখো, একদিন তুমি হবে সূর্যের মত শক্তিমান, পাহাড়ের মত স্থির, ধরণীর মতো সহনশীল। তবে নদীর মতো বহতা হতে ভুলো না। এখানেই তুমি স্নিগ্ধ, এখানেই তোমার নারী জন্মের সৌন্দর্য, সার্থকতা। আজ পৃথিবীর সকল কন্যা সন্তানকে বলছি, সগৌরবে, সর্ব গৌরবে মহিমান্বিত হও। পৃথিবীর বুকে তোমার অস্তিত্বের চিহ্ন রেখে যাও।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রাণের উচ্ছ্বাসে প্রাণবন্ত হোক শারদীয় উৎসব
পরবর্তী নিবন্ধবন্ধ না করে চিনিকলগুলোর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রয়োজন