ঘণ্টা বাজে টুনটুন, টুং টাং। ঘণ্টার শব্দে জেগে ওঠে শিক্ষার্থী। ঘণ্টা কথা বলে, ঘণ্টার শব্দের সাথে চলে শিক্ষার্থীর রুটিন। দীর্ঘদিন শোনা যায়নি মধুর সেই শব্দ। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে নীরবতায় ডুবেছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রায় দেড় বছর পর আবার বাজল ঘণ্টা। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় প্রাণ ফিরেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বহুদিন পর সহপাঠীদের কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা কেউ কেউ। অন্য সময়ের সাথে এবার ব্যবধান কেবল মুখে মাস্ক। মাস্ক পরেই খুনসুঁটি ও আড্ডায় মেতে ওঠে শিক্ষার্থীরা। মাথায় রাখতে হয়েছে স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনাও। ক্লাস রুমেও এসেছে বড় পরিবর্তন। আগে এক বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসলেও এবার দুজনের বেশি বসা মানা। অনেকেই প্রথমবারের মতো স্কুল-কলেজের নতুন ক্লাসে এসেছে গতকাল। আবার ভর্তির পর একেবারেই নতুন এসেছে কেউ কেউ। প্রতিষ্ঠান প্রধান ও অন্যান্য শিক্ষকদের নামও জানা নেই অনেকের। তবে তাতে কোনো দোষ নেই। এর আগে যে ক্লাস করারই সুযোগ হয়নি তাদের। এদের চোখে-মুখে তাই প্রথমবার স্কুলে আসার আনন্দ। বহুদিন পর সহপাঠী-বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার উচ্ছলতা। সব ছাপিয়ে স্কুলে স্কুলে গতকাল শিক্ষার্থীদের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে গেছে শিক্ষক-অভিভাবকদেরও।
বাবা সেলিম মাহমুদের হাত ধরে স্কুল গেটে দাঁড়ানো হামীম মাহমুদ। হাজী মুহাম্মদ মহসিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র সে। দীর্ঘ সময় পর সকালবেলা স্কুলে এসেছে হামীম। মুখে মাস্ক, কাঁধের ব্যাগটি তখনো বাবার হাতে। তার আগে-পরে আরো অনেকেই দাঁড়ানো স্কুল গেটে। কারও সাথে মা, কারো বাবা। অনেকে একা। তবে সবার চোখেমুখে স্পষ্ট আনন্দের ছাপ। এ যেন দীর্ঘদিন পর মুক্তির স্বাদ।
গেট পার হয়ে স্কুলের আঙিনায় কথা হয় হামীমের সাথে। সে জানায়, অনেক দিন পর স্কুলে আসা। বন্ধুদের সাথে দেখা হবে; সে কথা ভেবে আগের রাতে ঠিকমতো ঘুমই হয়নি। আর অনেক দিন পরে স্কুলের উদ্দেশ্যে ভোরবেলা বিছানা ছাড়তে হয়েছে। কষ্ট হলেও ঠিকই উঠেছে সে। তার মনে হচ্ছে, সে যেন নতুন ক্লাসে প্রথমবার স্কুলে এসেছে। আগে বছরের শুরুতে এ রকম মনে হতো। তবে এখনও যেন প্রথম স্কুলে আসা। স্কুলে আসতে পেরে অনেক ভালো লাগছে জানিয়ে হামীম জানায়, বাসায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্তি চলে আসছিল। স্কুল খোলায় এখন স্কুলে আসতে পারবে। এটা ভেবে অনেক আনন্দ লাগছে।
দুুপুর দেড়টার পর ক্লাস শুরু অস্টিন পালিত ও মো. আহসান আল জামীর। স্কুলেই কথা হয় চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এই দুই ছাত্রের সাথে। অস্টিন ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিল এই স্কুলে। কিন্তু ক্লাস নাইনের পুরো বছরই হারিয়ে গেছে করোনায়। একদিনও ক্লাস করার সুযোগ পায়নি সে। যার কারণে এই স্কুলে নতুন করে কোনো বন্ধু হয়নি তার। গতকালই প্রথমবারের মতো ক্লাসে আসা। তার কাছে স্কুলের সবকিছুই যেন নতুন। নতুন স্কুলে প্রথম ক্লাসে আসা, এটা অন্যরকম এক অনুভূতি বলে জানায় অস্টিন।
ড্রেস ছাড়াই স্কুলে আসে আল জামীর। সে জানায়, ড্রেস সেলাই করতে দেওয়া হলেও দর্জি ঠিক সময়ে দিতে পারেনি। যার কারণে ড্রেস ছাড়াই আসতে হয়েছে। তার মতো আরো বেশ কয়েকজনকে ড্রেস ছাড়াই দেখা যায়।
শিক্ষার্থীদের স্কুলে ঢোকানোর মুহূর্তে প্রবেশ গেটে ছিলেন প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ ও সিনিয়র শিক্ষক আবু তাহের কাজলসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক। প্রথম দিকে একটু জটলা হলেও শিক্ষার্থীদের লাইন করে ঢোকানো হয়। ড্রেস ছাড়া আসা শিক্ষার্থীদের সাথে আলাদা করে কথা বলতে দেখা যায় প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহকে। সেলাই হওয়া মাত্র নতুন ড্রেস নিয়ে স্কুলে আসার কথা বলতে শোনা যায় তাকে। প্রথম দিন হিসেবে ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী, ৫ম শ্রেণি এবং ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস ছিল গতকাল। এসব ক্লাসের মোট ১ হাজার ২১০ জনের মধ্যে ১ হাজার ২২ জন শিক্ষার্থী প্রথম দিন উপস্থিত ছিল বলে জানান প্রধান শিক্ষক। হিসেবে প্রথম দিন উপস্থিতির হার ৮৪ শতাংশের বেশি।
প্রথম দিন ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে উপস্থিত হয়েছে বলে জানান হাজী মুহাম্মদ মহসিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুল আমিন। প্রথম দিন হিসেবে এটি সন্তোষজনক বলে মনে করেন তিনি।
প্রথম দিন প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। খুব কম সংখ্যক ছাত্রী প্রথম দিন অনুপস্থিত ছিল বলে জানান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শাহিদা আক্তার। কলেজিয়েট স্কুলেও প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল বলে জানান প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম।
তবে গতকাল প্রাথমিক পর্যায়ে উপস্থিতির হার তুলনামূলক কম ছিল। নগরীর পশ্চিম গোসাইলডাঙ্গা সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল পথম দিন। অনেক শিক্ষার্থী গ্রামে চলে যাওয়ায় উপস্থিতির হার কম বলে মনে করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মল্লিকা বড়ুয়া।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ক্লাস রুমে জেড আকারে শিক্ষার্থীদের বসানোর কথা থাকলেও বেশিরভাগ স্কুলেই সেটা দেখা যায়নি। এক বেঞ্চে অন্তত দুজন করে শিক্ষার্থী বসাতে দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তবে নজরে আনার পর প্রধান শিক্ষকের নির্দেশনায় ক্লাস রুমে শিক্ষার্থীদের নতুন করে সাজাতে দেখা যায় শ্রেণি শিক্ষকদের। বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা হিসেবে বেসিন চোখে পড়েছে। তবে কোনো কোনো স্কুলে শিক্ষার্থীরা ঢোকা মাত্র বেসিনে হাত ধুলেও কিছু প্রতিষ্ঠানকে এটা তত্ত্বাবধান করতে দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীরা সরাসরি ক্লাস রুমে ঢুকে যায়। যদিও প্রায় সব স্কুলের প্রবেশ মুখেই তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা ছিল। আর শিক্ষার্থীদের চকলেট, ফুল ও মাস্ক দিয়ে বরণের আয়োজন ছিল বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের গেটও ফুল দিয়ে সাজাতে দেখা গেছে।
সব মিলিয়ে অন্যরকম আবহে গতকাল শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বিষয়টি দেখতে স্কুলে স্কুলে পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসন, মাউশি ও শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন তারা। তবে কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবস্থাপনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পরিদর্শনে যাওয়া বোর্ডের কর্মকর্তারা।












