
ইতিহাস চর্চায় আবদুল হক চৌধুরী একটি নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে ভূমির দলিল, পুকুর-দীঘির পাড় ও শান বাঁধানো ঘাট। আর পুঁথি-পাণ্ডুলিপি। ইতিহাস রচনার জন্য ঐতিহাসিকরা নির্ভর করেন মুদ্রা, শিলালিপি, তাম্রশাসন, প্রাচীন পুরাকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এছাড়া কোন প্রাচীন গ্রন্থ, পর্যটক বা ভৌগলিকদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত, রাজা-বাদশাহদের আত্মজীবনী বা বিভিন্ন অভিযানে তাঁদের সঙ্গী কোন বিদ্বান বা জ্ঞানপিপাসু কোন ব্যক্তির রচিত দিনপঞ্জি, পুঁথি সাহিত্য। দলিল দস্তাবেজও ইতিহাসে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন ইতিহাসবিদরা। পুঁথিকে ঐতিহাসিক তথ্য আহরণের মূল্যবান উৎস হিসেবে কার্যকর প্রয়োগ করেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক শাহেদ আলী, ড. আবদুল করিম প্রমুখ। চট্টগ্রামে প্রত্নতাত্তিক খাননকার্য না হওয়ায় প্রত্নতাত্ত্িক সম্পদ তেমন পাওয়া যায় নি। চট্টগ্রাম ভারত বা বাংলার শাসনকেন্দ্র দিল্লি বা গৌড়ের নিরবচ্ছিন্ন শাসনাধীনে না থাকায় উক্ত স্থানের রাজা-বাদশাহের জারিকৃত মুদ্রা, প্রদত্ত তাম্রশাসন, নির্মিত স্থাপনা ও তাতে উৎকীর্ণ শিলালিপিও খুব একটা পাওয়া যায়নি।
আবদুল হক চৌধুরী ইতিহাসের বাঁধা সড়ক এড়িয়ে আলপথে বিচরণ করেছেন। কেননা তিনি কোন স্বীকৃত ঐতিহাসিক ছিলেন না; তাঁর কোন উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো না, তিনি কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৃত্তিভোগী গবেষকও ছিলেন না। তথাপি তাঁর মাথায় ইতিহাসের ভূত চেপেছিলো বা এভাবেও বলা যায় ইতিহাস দেবতা তাঁকে দিয়ে ইতিহাসের কিছু দায় মেটাতে আবদুল হক চৌধুরীর আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষারত ছিলেন।
আবদুল হক চৌধুরীর প্রথম গ্রন্থ ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে। ইতিহাসের নানা বিষয় নিয়ে রচিত প্রথম গ্রন্থটি প্রকাশ করতে অর্ধশত বছর পেরিয়ে যায়। তারও আগে ৩২ বছর তিনি এই গ্রন্থ রচনারা জন্য ব্যয় করেন। এর মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি আমাদের জানা হয়, তা’ হলো আবদুল হক চৌধুরী বেশ আটঘাট বেঁধে অর্থাৎ দীর্ঘ-প্রস্তুতি নিয়ে ইতিহাসের সদর দরজার কড়া নেড়েছেন। দ্বিতীয়ত তিনি বেশ পরিণত বয়সে ইতিহাসের আসরে অবতীর্ণ হন।
জমির মাপজোক অর্থাৎ আরএস, পিএস, বিএস জরিপের খতিয়ানের মধ্যে যে ইতিহাসের মূল্যবান সূত্র নিহিত থাকতে পারে, সেটি প্রথম আবদুল হক চৌধুরী উপলব্ধি করতে সমর্থ হন। তিনি রাউজান থানার একটি প্রাচীন ভুস্বামী বংশের সন্তান। সেই সূত্রে জায়গা-জমির দলিলের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন এবং তাতে উপ্ত ইতিহাসের রহস্য উন্মোচনের সূত্র আবিষ্কার করেন। এখানেই আবদুল হক চৌধুরীর শ্রেষ্ঠত্ব, ইতিহাস চর্চায় তাঁর জিৎ। তাঁর জন্মস্থান রাউজানে ছোটবেলা থেকে তিনি দেখতে পান অনেক বড় বড় দীঘি, পুকুর এবং ঘাট; ঘাটের মধ্যে কান পেতে তিনি শুনতে পেলেন দুরাগত অশ্বের খুরধ্বনি, মধ্যযুগের দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা, রাজপুরুষ এবং আমীর-ওমরা ও নায়েব, জমিদারের কীর্তিগাথা, আবদুল হক চৌধুরী নিজেই বলছেন-‘চট্টগ্রামের এমন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমার জন্ম, যেখানে আমরা আশৈশব দেখে আসছি সুলতান নসরত শাহর প্রতিষ্ঠিত কোতোয়ালীর ধ্বংসাবশেষ, দীঘি, রাস্তা ও খনিত খালের অংশ, বারভূইয়া প্রধান ঈসা খাঁর দীঘি ও রাস্তা। তা ছাড়া দৈর্ঘ্যে আট মাইল ও প্রস্তে আট মাইল আয়তনের উক্ত এলাকার দশকানি গ্রাম জুড়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগে খনিত বহু দীঘি ও আরাকানী আমলে প্রতিষ্ঠিত মাটির দুর্গ কোট অবস্থিত। এসব প্রাচীন স্মারক নির্দশনাদির পরিচয়ের খোঁজে আমি অবসর সময়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কিত লেখা বইপত্র খুঁজে পেতে পড়াশুনা শুরু করলাম’। (আবদুল হক চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ : বাংলা একাডেমি, ১৯৯৬, পৃ. ১২৫-১২৬)।
আবদুল হক চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনার পূর্বে তাঁর আগে যাঁরা চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের কথা একবার বলে নেয়া যাক। তারকচন্দ্র দাশগুপ্তকে মনে করা হয় প্রথম লেখক, যিনি চট্টগ্রামের ইতিহাস রচনা করেছেন। কিন্তু খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খানের ‘আহাদিসুল খাওয়ানিল’ প্রকাশের সময়কালকে যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে তাঁকেই বলতে হবে চট্টগ্রামের প্রথম ঐতিহাসিক। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে আহাদিসুল খাওয়ানিন প্রকাশিত হয়। তারক বাবুর বই আরো পরে প্রকাশিত হয়েছে বলে জানি।
বহু ভাষাবিদ, ভারতত্ত্বাবিদ তিব্বত বিশেষজ্ঞ শরচ্চন্দ্র দাশগুপ্ত ‘Antiquity of Chittagong’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, এটিও উনিশ শতকে রচিত ও প্রকাশিত হয়। তবে পূর্বোল্লিখিত দুটি গ্রন্থের আগে নয়। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণচন্দ্র চৌধুরীর বহুল আলোচিত ও বহু পঠিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের নাম ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’। তাঁর কিছু পরে মনীষী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ‘ইসলামাবাদ’, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে বোয়ালখালীর আহ্লা নিবাসী শিক্ষক নুরুল হকের ‘বৃহত্তর চট্টল’ এবং ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আহমদুল হকের ‘A short History of Chittagong’ প্রকাশিত হয়। তারপর সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম লিখলেন তিন খণ্ডে-চট্টগ্রামের ইতিহাস-পুরানা আমল, নবাবী আমল ও কোম্পানি আমল এবং কতিপয় বিশিষ্ট পরিবার ও অলি-দরবেশের কাহিনী। কবি ওহীদুল আলমও চট্টগ্রামের ইতিহাস ও চরিতাভিধান নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন।
ভূমি রাজস্ব বিষয়ে কটন, অ্যালেন ও ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিনের তিনটি গ্রন্থ রয়েছে। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ড. আলমগীর সিরাজ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পিএইচডি থিসিসটি প্রণয়ন করেন এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা’ The Revenue Administration of the East India company in Chittagong 1761-1765 শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
কিছু গেজিটিয়ার শ্রেণির রচনাও লিখিত হয় চট্টগ্রামের ইতিহাসের উপকরণ সংকলন করে। প্রথম বইটি লেখেন হান্টার, তারপর ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ও মলি, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে রিজভী সম্পাদিত ‘চিটাগাং গেজিটিয়ার’ এবং ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ মুর্তজা আলী রচিত A short History of Chittagong প্রকাশিত হয়। আবদুল হক চৌধুরী ব্যথিত চিত্তে লক্ষ্য করলেন প্রচলিত ইতিহাসে সাধারণ মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা নির্মমভাবে উপেক্ষিত। যেমন প্রচলিত ইতিহাসে রাজায় রাজায় যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণিত হয়। কিন্তু তাদের যুদ্ধের কারণে যে নলখাগড়ার প্রাণ যায়, তাদের কথা সে সব ইতিহাস বেমালুম চেপে যায়।
চট্টগ্রামের প্রচলিত ইতিহাসেও বনেদী বংশ, বিখ্যাত ব্যক্তি, জমিদার, আমলা-মুৎসুদ্দীর কীর্তিগাথা পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষক, প্রজা, দিনমজুর, কুলি-কামিন, ক্ষেতমজুর, বর্গা চাষীর জীবন সেখানে অনুপস্থিত। আবদুল হক চৌধুরী ব্রাত্যজনের জীবনকে তাঁর গ্রন্থে তুলে ধরলেন এবং সেজন্য রচনা করলেন একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ ‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি’।
আবদুল হক চৌধুরী রাউজান থানার নোয়াজিশপুর গ্রামে ১৯২২ সালের ২৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আঠারশ’ শতাব্দির কবি ‘চন্দ্রাবতী’ প্রণেতা কোরেশী মাগন ঠাকুরের সপ্তম অধস্তন পুরুষ।
আবদুল হক চৌধুরী স্বশিক্ষিত মৌলিক প্রতিভা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত না হয়েও তিনি নিজের চেষ্টা, সাধনা ও অধ্যয়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজ সম্পর্কে বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হন। বিদগ্ধ ও একাডেমিক মহলেও তাঁর পাণ্ডিত্য স্বীকৃত হয়।
তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ইতিহাস যেমন রচনা করেছেন, তেমনি চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি ঔৎসুক্য সঞ্চারকারী বিষয়ে গবেষণা করে বিস্মৃতকালের কবল থেকে উদ্ধার করেছেন অনেক প্রাচীনতম অমূল্য সম্পদ। চট্টগ্রাম বিজেতা সুলতান নসরত শাহর আমলের কীর্তি, আরাকানী শাসনামলের ঐতিহাসিক নিদর্শন, উত্তর-পূর্ব চট্টগ্রামের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন, বার ভূঁইয়াদের অন্যতম নেতা ঈশা খাঁ সম্পর্কে নতুন তথ্য উদঘাটন, আরাকান রাজ্যের অন্যতম মন্ত্রী কবি কোরেশী মাগন ঠাকুর, কবি মোহাম্মদ মুকিম, কবি মোহাম্মদ আলী, কবি আজগর আলী প্রমুখ সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য-উপাত্ত হাজির করেন।
বাংলা ভাষায় মধ্যযুগের সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আবদুল হক চৌধুরী তাঁর গবেষণায় এই বিষয়টিকে বেশ প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বহু কবি-সাহিত্যিক ও গবেষক সম্পর্কে অনেক তথ্য যোগাড় করেন। গ্রন্থ: চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ (১৯৭৫), চট্টগ্রামের চরিতাভিধান (১৯৭৯), চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি (১৯৮০), সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ (১৯৮১), শহর চট্টগ্রামের ইতিকথা (১৯৮৪), চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা (১৯৮৮), চট্টগ্রাম-আরাকান (১৯৮৯), চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ (১৯৯২), প্রাচীন আরাকান, রোহাইংগা, হিন্দু ও বড়ুয়া, বৌদ্ধ আদিবাসী (১৯৯৪), বন্দর শহর চট্টগ্রাম (১৯৯৪)। এছাড়া তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ অপ্রকাশিত রয়েছে। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমি থেকে ‘আবদুল হক চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ’ (১৯৯৬) প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে রাউজান অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তাঁর পুত্রসহ ধৃত হয়ে নির্যাতন ভোগ করেন। তিনি আমৃত্যু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। মৃত্যু: ১৯৯৪ সালের ২৬ অক্টোবর।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, সংস্কৃতি সংগঠক












